Friday, September 14, 2018

ভাজ্য X ভাজক= ভাগফল -অভিজিৎ বেরা







একটা আলো আমরা ভাগ করে নিচ্ছি।

বাইরে ঝোড়ো হাওয়া। সমুদ্রের গর্জন। বারবার ছোট্ট আলোটাকে নিভিয়ে দিতে চায়।  মা তার মস্ত ডানায় আলোটিকে আগলে রেখেছে, আমাদের আড়াল করে রেখেছে। আলোটি তিরতির করে কাঁপছে,ব্যথায় ডানা টনটন করছে ,তবু নিভতে দিচ্ছে না। বাইরে নিকষ কালো। কতগুলি অজগর হাঁ করে বসে আছে। অন্ধকারে ওদের গায়ে ফসফরাসরা জাগে। জাগে বিষ মাখা  ক্ষুদে ক্ষুদে  চোখ।আমাদের উঠোনে একটা কামিনী গাছ। নোনা হাওয়ায় ওরা গন্ধ ছড়ায়। সাপের নেশা হয়। আমাদের ভয় ।

একটা গন্ধ আমরা ভাগ করে নিচ্ছি।

মায়ের ডানার গন্ধ। মায়ের গন্ধে অজগর পালায়। পালায় দরজার বাইরে ওৎ পেতে থাকা সামুদ্রিক হায়না। পালায় আর ফিরে ফিরে আসে। সংসারে অভাব। এতগুলো ভাইবোন। মাকে ডানা মেলে উড়ে যেতে হয়। রোজ। রুজির সন্ধানে। ওরা একদিন দিদিকে নিয়ে গেল। অনেক বছর পরে দিদিকে যখন ফিরে পাওয়া গেল, তখন দিদির আর কিছু নেই। একটি মূর্তিমান কংকাল ছাড়া। এক ভোররাতে দিদি ফিরেছিল। আমরা ঘুমের ঘোরে শুনলাম খোলা বাহিরের দরজায় কার আঁচড়ের শব্দ।

কতগুলো শব্দ আমরা ভাগ করে নিচ্ছি।

মা বলত ঘুম পেলে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পড়বে। জানলার শিকে দড়ি দিয়ে চুল বেঁধে রাখবে। চোখে সরষের তেল লাগাবে। ঝাঁজে চোখ জ্বলত। আমি চোখ  খুলে লুকিয়ে রাখতাম  বাক্সে। মা কান্না পছন্দ করত না। ল্যাকপেকে শরীরে আগুন জ্বলত। এখানে বাতাস স্যাঁতসেঁতে। সব আগুন নিভিয়ে দিতে চায়। তবু শব্দ থামালে চলবে না। উঠোনের ওপার থেকে রান্না করতে করতে মা শুনতে চায়। শব্দ। উল্কাপাতের । তারা খসার।

কতগুলো দৃশ্য আমরা ভাগ করে নিচ্ছি।

মায়ের ডানা থেকে পালক খসে খসে যাচ্ছে। মা বুড়ি হয়ে যাচ্ছে। আমরা সেই পালক কুড়িয়ে নিজেদের শরীরে গুঁজে নিচ্ছি। তা থেকে আমাদের শরীরে ছোট ছোট পালক গজাচ্ছে। ডানা। আমরা উড়তে শিখছি। কিন্তু উঠোনের বাইরে তো সমুদ্র। যতবার উড়তে যাই জলে পড়ে যাই। তবু কোত্থেকে যেন এক পেট খিধে এসে খুঁচিয়ে বলে— ওঠ। ওড়। আমরা উড়লাম। তিন ভাইবোনে। এমনকি দিদিও। আমার রুগ্ন মা যার ডানায় আর কোনও শক্তি  বেঁচে নেই, নীচ থেকে দেখল—আমরা উঠোনের ঝাউগাছ পেরিয়ে যাচ্ছি। জ্যাঠাদের বালিয়াড়ি পেরিয়ে যাচ্ছি। l জেলেদের বস্তি পেরিয়ে যাচ্ছি। পেরিয়ে যাচ্ছি লবণাক্ত হাওয়া, সমুদ্র্র আর মরা মাছ। নীচে ঢেউগুলো ধাক্কা খেয়ে ফিরে ফিরে যাচ্ছে। সামুদ্রিক অজগর আর হায়নাগুলি ঢেউয়ের সংগে সংগে ফিরে যাচ্ছে। তাদের আর চোখ জ্বলে না। নিজেদের ফসফরাসে নিজেরাই পুড়ে গেছে কবে।


কতগুলো স্মৃতি আমরা ভাগ করে নিচ্ছি। কতগুলো সময়।

শুধু  মাকে ভাগ করতে পারছি না কিছুতেই।


2 comments:

  1. গতকাল পড়েছিলাম। আবার আজও পড়লাম।এমন লেখা বারবার পড়তে ভালো লাগে।

    ReplyDelete
  2. কী অসাধারন লেখা, খুব খুব খুব ভালো লাগল।

    ReplyDelete

একনজরে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"ইস্কুল বলিতে আমরা যাহা বুঝি সে একটা শিক্ষা দিবার কল। মাস্টার এই কারখানার একটা অংশ। সাড়ে দশটার সময় ঘণ্টা বাজাইয়া কারখানা খোলে। ...