Friday, September 14, 2018

চিরন্তন আনন্দঋণ- পিয়াল রায়






সকালেই খবর পেলাম কবি পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, আই সি ইউতে তাঁর চিকিৎসা চলছে। আশা করি তিনি দ্রুত আরোগ্য লাভ করবেন।বাংলা সাহিত্যের তাঁর কাছে আরো কিছু পাবার আশা আছে। প্রথমে আমি যেভাবে এই লেখাটি শুরু করব ভেবেছিলাম, তা আর করা গেল না। কারন কবিতার কাছাকাছি থাকা এক পাঠক হিসেবে সকালের এই দুঃসংবাদটি মনকে উদ্বিগ্ন করে তুলল এবং যারপরনাই ব্যাকুল করে তুলল কবির স্বাস্থ্য সম্পর্কিত ভাবনাটি। একনিষ্ঠ কবিতা পাঠকের কাছে যে একজন অগ্রজ  কবি কতখানি শিক্ষকের ভূমিকা পালন করেন, তা আর নতুন করে বলে বোঝাবার প্রয়োজন নেই। কবি পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলালের কবিতার কাছে আমি তেমনিভাবেই ঋণী।  না, কবির সাথে সশরীর আলাপ আমার হয় নি, যেটুকু হয়েছে তা তাঁর কবিতার সূত্রে এবং আন্তরিক টানের এই সুতো যে কত মজবুত তারই প্রমাণ  আজকের এই মন খারাপ। ঘুম থেকে উঠেই দেখার কথা ছিল শরতের ঝকঝকে আকাশ, তার বদলে নেমে এল ঘনঘোর মেঘের চাবুক। কাকতালীয় ভাবে এর কিছুক্ষণ পরেই  এক বাল্যবন্ধু দুর্গাপুর থেকে ফোন করল যাঁর হাতে আমাদের বাংলা শিক্ষার হাতেখড়ি তিনিও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন আচমকা। উপায় নেই যে শুনেই ছুটে যাব স্যার কে দেখতে।  ঘরে বসেই ওলটপালট করলাম নিজেকে। প্রার্থনা করলাম দ্রুত সেরে উঠুন তিনি। গান আর কবিতার যুক্তবেণী রচনার শিক্ষা তো তিনিই প্রথম দিয়েছিলেন।

      কবি বিকাশ নায়ক আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন। কবিতার কলম ওর বেশ শক্তিশালী।  ইদানিং গল্প লিখতে শুরু করেছে, এবং প্রথম গল্পটিই পরিবেশিত হয়েছে আনন্দমেলার কচিকাচা পড়ুয়াদের কাছে। গল্পটি আমার পড়া হয়নি, কিন্তু জানি বিকাশ  ছোটদের জন্য যা লিখবে তা শিশুদের ধারণ ক্ষমতাকে অতিক্রম করে যাবে না।  প্রায়শই আমাদের গল্প হয় ফোনে। ওঁর চিন্তাধারার স্বচ্ছতা আমায় খুশি করে। শিশুদের মনস্তত্ত্ব যে বিকাশ এত ভালো বুঝতে পারে তার কারন শিশুদের সাথেই বেশির ভাগ সময় কাটাতে ও বেশি ভালোবাসে। সম্পূর্ণ বিনা পারিশ্রমিকে ও একটি আবৃত্তি ক্লাস চালায়, সেখানে ওদের থেকে শেখে নিত্যদিন। আর আমি শিখি বিকাশের কাছে। বাবামায়েরা যখন বেতন দেবার কথা বলে, সসম্মানে তাদের ফিরিয়ে দেয় বিকাশ। অর্থনৈতিক কোনো চাহিদা ওঁর নেই। শিশুদের কলকোলাহল যে আনন্দে বিকাশকে ভরিয়ে রাখে তেমনটা বোধকরি টাকাপয়সা বিনিময়ে সম্ভব নয়।বিকাশের নিজের কথাতেই অর্থের বিনিময় এলেই একটা কেজো দায়বদ্ধতা এসে পড়ে শিক্ষক এবং অভিভাবকের মাঝে। মাঝখান থেকে শেখা এবং শেখানোর  সারল্যটাই যায় হারিয়ে।যখন আমাদের কথা হয়, আবৃত্তি শিখতে আসা এই বাচ্চাদের কোনো না কোনো প্রসঙ্গ আসবেই। বাচ্চাদের চট করে শিখে ফেলার ক্ষমতা আনলিমিটেড। শঙ্খ ঘোষের সাথে ফোনে কথা বলে বলে বিকাশ কবিতায় ছন্দ আয়ত্ত করেছিল এবং আমার সাথে আলাপের পর সে শিক্ষা আমাকে চেয়েছিল দিতে। বলা বাহুল্য, আমার মতো নিরেট ছাত্রী বিকাশ ইহজন্মে দেখেনি, ফলে হাল ছেড়ে দিয়েছিল অল্প ক'দিন পরেই। আমি তো আর শিশু নই, হায়, কেন যে আমি আর শিশু হতে পারিনা?  

     কলেজে পড়ার সময় কণিকা বিশ্বাস ছিলেন আমাদের বাংলার শিক্ষিকা।  কেন যেন আমাকে বেশ স্নেহের চোখে দেখতেন। আমিও তাঁকে পছন্দ করতাম খুবই।  আমি একা নই, বাংলা ডিপার্টমেন্টের সব ছেলেমেয়েরাই পছন্দ  করত ওঁর পড়ানোর স্টাইল।এমন কোনো ছাত্রছাত্রী ছিল না যারা ওঁর ক্লাশ না করতে চাইত।সারাদিন আড্ডার পরে বেলাশেষের ক্লাশ থাকলেও কোনোদিন দেখিনি কে.বি.র ক্লাশ কেউ মিস করেছে। প্রশ্নই নেই।  তবে ব্যাপারটা শুধু পড়ানোতেই আটকে ছিল না। তিনি ছিলেন যেমন সুন্দরী  তেমনই ছাত্রদরদী। যখনই যে সাহায্য চেয়েছে, তা সে যে সাহায্যই হোক না কেন, তিনি হাসিমুখে সাহায্য করেছেন। এমন কি কলেজের ছাত্র ইউনিয়নও কে.বি.র কথা শুনতো মন দিয়ে, এমনই ছিল তাঁর সহজ ভালোবাসার টান।  কে.বি.র কাছে জীবনের অনেক সহজ কঠিন পাঠ নিয়েছি আমি নিজের এবং তাঁর অজ্ঞাতসারেই। অনেক ঋণ জমে আছে।  যখন দুর্গাপুর ছেড়ে লেডি ব্রেবোর্ণে চলে এলেন, তখন ওঁর ইচ্ছে ছিল কলকাতায় থেকে মাস্টার্স করি আমি। কলকাতায় ওঁর ফ্ল্যাটে থেকে পড়াশোনাটা করলে নানা ভাবে তিনি আমায় সাহায্য করতে পারবেন। কিন্তু ওই যে, কপাল, বঙ্গ,সঙ্গ, সর্বত্রই নাকি তারা একসাথেই যান। ইয়ে ফেবিকলকা জোর হ্যায়, টুটে গা নেহি।  বিস্তর বাধাবিপত্তিতে তা আর সম্ভব হয়নি, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই আমাকে কমপ্লিট করতে হয় মাস্টার্স।  ভারি খুশি হয়েছিলেন যে বিয়ের পর পড়াটা জলাঞ্জলি না দিয়ে সেটা শেষ করেছি দেখে। কিছুদিন আগেই আমার এক বোনের বর,তিনি আবার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক,   দেখা হয়েছিল কণিকা ম্যাডামের সাথে সম্ভবত লেডি ব্রেবোর্নেই(ঠিক খেয়াল পড়ছে না), শুনেছি আমার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন তার কাছে স্টাফ রুমে বসে। এসব কানে এলে আনন্দে বুক ফুলে ওঠে। এত দীর্ঘ ব্যবধানেও তিনি মনে রেখেছেন আমার মতো সামান্য এক ছাত্রীকে। আমার বিয়েতে তাঁর দেওয়া মহাশ্বেতা দেবী ও মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় সমগ্র এখনও যত্নে রাখা আছে। একমাত্র ছেলের বিয়েতে ম্যাডাম যে দুজন ছাত্রীকে নেমন্তন্ন করেছিলেন, আমি ছিলাম তারমধ্যে একজন।ততদিনে আমি দুর্গাপুর ছেড়ে শালবনী চলে এসেছি।মনে আছে বিয়ে উপলক্ষ্যে  আমাকে একটা ভীষণ জমকালো জারদৌসি শাড়ি দিয়েছিলেন। সে শাড়ি আজও তেমনি নতুনটি রাখা আছে, প্রাণে ধরে ব্যবহার করতে পারিনি। এক জীবনে সেসব অমূল্য সম্পদ।  শিশুর মতো মন ছিল তাঁর তাই সহজেই পারতেন আলো ছড়িয়ে দিতে। 
'তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা... '


     শিশুর মতো মনের প্রসঙ্গে আরো একজনের কথা না বললেই নয়, তিনি হলেন কবি মঞ্জুভাষ মিত্র। তাঁর কাছেও পড়ার সৌভাগ্য হয়েছিল দুর্গাপুরে থাকাকালীন।  পড়াতেন বৈষ্ণব পদাবলি।  ডায়াসে উঠেই উর্ধ্বমুখ। জানিনা ছাদের দিকে তাকিয়ে কোন্ ছাত্রছাত্রীকে তিনি কল্পনা করে নিতেন ও তাদের পড়িয়েই হন্তদন্ত বেড়িয়ে যেতেন। চুলে কোনোদিন চিরুনি চালাতেন কিনা বুঝতে পারতাম না। ভারী খামখেয়ালি মানুষ ছিলেন। অধ্যাপক সুলভ গাম্ভীর্য বিন্দুমাত্র ছিল না। মন খুলে কথা বলা যেত। কিন্তু তখনও আমার কবিতার রুচি গড়ে ওঠেনি, ফলে হাতের কাছে পেয়েও হারিয়ে ফেলতে হল কবিকে। এখন খুঁজি, কিন্তু পাই না। যখন দুর্গাপুর ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, এত ছাত্রছাত্রী থাকতে কেন যে আমার হাতেই তাঁর লেখা বৈষ্ণব গ্রন্হের একখানি কপি দিয়ে গেছিলেন, জানিনা। অবাক হয়েছিলাম প্রচন্ড। সে বইও রাখা আছে।এর পিছনে কে.বি.র কোনো হাত ছিল কিনা জানিনা। শিক্ষক ভাগ্য চিরকালই আমার বেশ ভালো তা স্বীকার করতেই হবে। এম এ করার সময় তাহের স্যারের কাছে যখনই বই চেয়েছি, তিনি দিয়েছেন। ছাত্রছাত্রী বই নিয়ে আর ফেরত দিতে চাইত না বলে তিনি একটা খাতায় ব্যাপারটা মেনটেন করতেন। কে কবে কোন বই নিল, কবে ফেরত দিল, তারিখ দিয়ে স্বাক্ষর করে রাখতেন। বই ফেরত না দিলে নতুন বই পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই থাকত না। সুখের বিষয় আমার বেলায় তেমন কড়াকড়ি করতেন না। নিজে থেকে সিলেবাসের ও সিলেবাসের বাইরের অনেক বই পড়তে দিয়েছিলেন। প্রচুর গবেষণাধর্মী বই ছিল তাঁর বাড়িতে। আমারও সুবিধে হয়েছিল সে সময়।এমনিতে আমি বই পড়তে নিলে সবসময়ই ফেরত দেওয়ার পক্ষপাতী এবং সেটাই আমি করে থাকি। কেউ কেউ বিশ্বাস করে দেয় কেউ কেউ দেয় না।  যতবারই কেউ দিয়েছে ততবারই পড়া হওয়ার পর ফেরত দিয়েছি। কিন্তু স্যারের  বই ফেরৎ দেওয়া আর হত না, তিনিও চাইতেন না। এই করে অনেক বই ওঁর বাড়ির তাক থেকে আমার বাড়ির তাকে এসে জমে বসে গেছে। বৃহৎ কলেবর সেসব বই আর ফিরে যেতে চায়নি পূর্বের ঠিকানায়। কেন যেতে চায় নি, এ ব্যাপারে আমাকে জিজ্ঞাসা না করাই ভালো, উত্তর মিলবে না। দু'হাত ভরে শুধু নিয়েই গেলাম, ফিরিয়ে দেওয়া হল না কিছুই। এ আনন্দঋণ শুধব তেমন আমার সাধ্য নেই। 




     আমার তো মনে হয় প্রেমের ফাঁদের মতোই ভুবনজুড়ে ছড়ানো আছে শিক্ষার ফাঁদ। কেউ তোমাকে ধাক্কা দিল আর তুমি গিয়ে পড়লে সে ফাঁদের মধ্যে। তবে শিক্ষা কতটা নেবে সেটা নির্ভর করবে কোন দরজাটা তুমি কতটা খুললে তার ওপর। যদি সদর অন্দর দুটোই খুলে দাও তাহলে পেয়ে গেলে বহুমূল্য মণিহার, যার ব্যপ্তির সীমানা নেই। অপরদিকে যদি শুধু সদর খোলা রইল অথচ অন্দরের দরজা রইল বন্ধ,  তাহলে সত্য এসেও ফিরে গেল নির্মম নিষ্ঠুরতায়। তবে প্রেমের সাথে শিক্ষার একটা মূলগত পার্থক্য হল প্রেম সদাই চঞ্চল। শুধু পাওয়ার জন্যই নয় ধরে রাখার জন্যও বিশেষ প্রয়াস প্রয়োজন,নইলে কপালে জোটে বাবাজি কা ঠুল্লু আর শিক্ষা একবার গৃহীত হলে তা আর ছেড়ে যায় না কোনোদিন।  প্রেমের ক্ষয়বৃদ্ধি থাকলেও শিক্ষার তা নয়। ক্ষয় নেই তার, যা আছে তা হল গহনে লুকিয়ে থাকা। খুঁজলেই আবার সামনে এসে দাঁড়ায়, এতদিন খোঁজ না রাখার জন্য অভিমান করে মুছে যায় না। বন্ধুতা, প্রেম, যৌনতা,রাজনীতি,  পৃথিবী, বর্হিপৃথিবী, পক্ষ, বিপক্ষ, একটা গোলাপ এবং তাকে রক্ষা করে থাকা কাঁটা,খাটো ইজেরে রাস্তার ধারে বসে থাকা শিশুটি সবাই এই শিক্ষার রসদ, জন বিশেষে তা আপেক্ষিক হতে পারে কিন্তু মূল্যহীন নয়।  মরুতেও ক্যাকটাসের সবুজ দেখা যায়, সে সবুজে ফুটে ওঠে রঙিন ফুল। আর সে ফুলের সৌন্দর্যরূপে মোহিত না হয় এমন বেরসিক কে আছে?  

No comments:

Post a Comment

একনজরে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"ইস্কুল বলিতে আমরা যাহা বুঝি সে একটা শিক্ষা দিবার কল। মাস্টার এই কারখানার একটা অংশ। সাড়ে দশটার সময় ঘণ্টা বাজাইয়া কারখানা খোলে। ...