Friday, September 14, 2018

শিক্ষকরা হারিয়ে যায় -- ঈশানী বসাক








শিক্ষকরা হারিয়ে যায়

স্কুল থেকে বকা খেয়ে বাড়ি ফিরে টকটকে লাল চোখে বাগানের নারকোলগাছটার তলায় বসতাম। তখন সেও শিশু ছিল অনেক। তার পাতা গুলো মুখের উপর এসে পড়তো। গরম জল এঁকেবেঁকে গড়িয়ে যেতো আর আমি মনে মনে ভাবতাম আমাকে অমন করে বললো মিস ? চোখ বন্ধ করলেই দেখতাম পাতাগুলো পদ্মের পাঁপড়ির মতো আমাকে জড়িয়ে বলছে , ধুর পাগল আমি বকে দেবো মিস কে।

মা বকা দিলে সবকিছু গিয়ে উগরে দিতাম নাইন ও ক্লক ফুলের গাছটার কাছে। ছোট ছোট পাতা দিয়ে সে তাকাতো। বলতো আমরা যারা গাছ তাদের মায়েরা বকতে চাইলেও পারে না। আমি তো শুনিনি মায়ের গলা কেমন।

শিক্ষক কথাটার মানে প্রতিটা বয়সে বদলেছে আমার কাছে। খুব ছোট্টবেলা থেকে স্কুলে যারা পড়াতেন তারা আমার কাছে মিস অথবা স্যার ছিলেন। শিক্ষক বলতে বুঝতাম আমার কষ্টগুলো যেখানে রেখে দিতে পারবো। আমি এমন ভাবতাম আর তাতে সঙ্গ দিতো আমার ছোট্ত নারকোল গাছ আর নাইন ও ক্লক।

একটু বড়ো হলাম যখন তখন যা কিছু রাগ সব কিছুর ভাগীদার ড্রয়িং খাতা। প্যাস্টেল রঙ নিয়ে বসে যার উপর রাগ তাকে বিবিধ রঙে বিচ্ছিরি করে আঁকতাম। আমার আঁকার খাতাটা সস্নেহে সেসব দেখতো। শিক্ষক মানে যে শিক্ষাদান করে এই গুরুগম্ভীর শব্দার্থ মোটেও মানতাম না। তা দিনশেষের শিক্ষক ছিলেন আমার সেই আঁকার খাতা। একটু বড়ো হতেই ঘরের কোণের টেবিলটা আমার কাছে আমার নিজের বাড়ি হয়ে উঠলো। সেই বাড়ির কাছে পড়াশোনা আঁকা লেখা ডায়েরি সব থাকতো। ওই তখন আমার শিক্ষক। কত কিছু ভেবেছি যার জায়গা ছিল টেবিলটা। এক একটা সময়ে নিজেকে শান্ত করেছি ওইখানে বসে।

আমার শেখার কাছে এসে বসে থাকতো যে জানালাটা তার বাইরে আমি প্রথম দেখেছিলাম বয়ঃসন্ধি। অনন্ত ঝগড়া আর ঘন্টার পর ঘন্টা ধৈর্যের সেসব অভিভাবকহীন মিনিট হারিয়ে আক্ষেপ হয়নি। লুকিয়ে যার সঙ্গে ফোনে সারারাত কথা বলতাম আর ভোরে স্কুলে ক্লাসে ঘুমিয়ে পড়তাম সেখানে ঘুমটুকু আমাকে শিখিয়েছে কিভাবে একমাত্র কষ্ট আমাদের শিশু বানিয়ে দেয়। তখন অত কবিতা গল্প পড়তাম না। এক ই কথা বলেও ক্লান্ত হতাম না। অথচ পুনরাবৃত্তি আমাকে ক্ষমা করেনি।
তখন বড্ড সরল ছিল মন। প্রথম ঋতুমতী চিহ্ন জুড়ে ভয় ছড়িয়ে। একঘন্টা পর বাথরুমের দরজায় ধাক্কা। কান্নার কাছে এসে মাসিমণি বসে বোঝালেন। শান্ত হলাম আর তার পর থেকে আজ ও ঠিক ওইদিনগুলোতে সংকোচে গুটিয়ে যাই। স্বর্গের কাছে হালকা গোলাপি রঙ মিশে গেলে সাদা মেঘে তার নাম যে নারী আর তার থেকেই যে আমাদের সৃষ্টি কথাটা ফিরে ফিরে এসে বসতো বাবার কাছ থেকে।

আমাদের পাড়ার তোতনদা। ভারি ভালবাসত আমাকে। এই বোন তোর জন্য চকলেট এনেছি । দেখ তোর জন্য কাশ্মীর থেকে এপ্রিকট এনেছি। সেই তোতনদা হঠাৎ শুনলাম হাসপাতালে। দাদুকে প্রশ্ন করতে জানলাম এডস হয়েছে। তখন কেউ ছুঁতো না দাদাকে। শেষে মৃত্যুর সময়টা কেউ ছিল না। যতবার আমি বললাম আমাকে যেতে দাও আমাকে কারা যেন শেখালো ওদের ছুঁতে নেই। আজ এই বয়সে বড় করুণা হয় সেসব শিক্ষকদের দেখে।

ঝিম ধরা সন্ধ্যে সেদিন। বেশ কয়েক বছর আগের কথা। হাসপাতালে দেখতে গেছিলাম কাউকে। ভেন্টিলেশনে ছিলেন তখন। আমার প্রতিদিনের কাজ ছিল দেখা তার ঠোঁট নড়ে কিনা। চোখের পাতা পড়ে কিনা। একটানা শ্বাস নিতে নিতে বুকটা চুপ করে থাকতো তখন। ওঠানামা দেখতে পেতাম না। আমাদের নিঃশ্বাস পশুদের মতো বোঝে । যেমন সুনামি আসার আগে সমস্ত পাখিরা টিলার উপর উঠে গেছিলো।

আমাদের পাখিরা কখনো ওদের গান শেখায়নি যদি ভিড় জমাই।

হাসপাতাল মানেই আমি সাদা রঙ দেখতাম। তারপর থেকে সাদা ফেনা দেখে সমুদ্রের বাবাকে জিজ্ঞাসা করতাম আচ্ছা তাহলে শরীর খারাপ হলে যারা সমুদ্রতটে আসে তাদের অসুখ বুঝি নোনা জল খেয়ে নেয় ? ঠাকুমা বলতো ওরে ঢেউকে বলিস নীলকন্ঠ। সে কথা শুনেই আমার চিরকালীন মনে হতো আমি শিবের মাথা কোলে নিয়ে বসে। তোমরা যখন ফুল্লরার গল্প শোনো আমি তখন প্রেমিকা হয়ে যাই।

রোজ রোজ দেখতাম লাঞ্চে একটা মাছের ঝোল দিতো, সঙ্গে তরকারি। তিনি শূন্য ভাবে তাকিয়ে থাকতেন। কৌশিককাকু বলেছিলো খেয়ে নিন না। ভাল লাগবে। মুখ থেকে অস্ফুটে তিনি বলতেন এখানে দুপুর নেই রাত নেই। খালি বসে থাকা আছে। আমি খাবার দেখেই বুঝি কটা বাজে। একদিন এক কাকিমা এলেন। তাকালেন মুখটার দিকে চুপ করে। তোর মনে পড়ে রে সেই যেদিন সুচিত্রা অন্তরালে গেলেন ? হাসলেন তিনি। বাবা শিখিয়েছিল আমাদের সবার বনবাস আছে।

একটা ঝিম ধরা ওষুধের গন্ধ পেতাম। ভারি ভাললাগতো। স্যালাইনের ভারি হ্যাপা শুনেছি। একটু নড়াচড়া করলে নড়ে যায় চ্যানেল। একটা টিপ পড়িয়েছে কে? ভারি মিষ্টি লাগে তাই। আমি সেখানে গেলে ছানার বাটি থেকে এক চামচ বাড়াতেন। বলতেন খাবি? ডাক্তার মানা করতো। আমি খেয়ে নিতুম। খাইয়ে তো অমন করে কেউ দিতো না।
ক্রমশ রোজ আসি। দেখতাম খাবার এখন পাইপ দিয়ে চলে যায়। মাঝে মাঝে ডাকি, এই যে শোনা যাচ্ছে? কে জানে মানুষ চাইলেও আমার ডাকার বিপক্ষে নিউটন এসে বসেন না। বিজ্ঞান তাই কোনোদিনই ভালোবাসতে পারলাম না।

বিকেল হলে তখন খালি মনে হতো ঘরটা খালি। সেদিন ফিরে খেতে বসলাম। আবার ডাক এলো। রেসপন্স নেই নাকি ওঁর। আমি গেলাম সামনে। বারকয়েক ডাকলাম। আমার মাথাটার দিকে হাতটা এলো না। ছানার বাটিটা এখন কেউ দেয় না। কে যেন বললো সন্ধ্যে সাতটা তেরো। আমি নীচে নেমে এলাম। খুব খিদে পাচ্ছিল হঠাৎ। ঢকঢক করে খানিক জল খেলাম। চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দেখি কারা যেন জুঁই ফুল নিয়ে আসছে। আসলে তাঁর চলে যাবার সময়টা আমাকে প্রস্তুত করলো দিন গোনার। আবার কোথা থেকে পাচ্ছিলাম সেই তীক্ষ্ম কাঠচাঁপা ফুলের সুবাস। আমাকে জানালো সে দেখা করবে ঘড়ির কাঁটা থেমে গেলে।

মা যেদিন ঠান্ডা হয়ে গেছিলেন সেদিন আমি দেখলাম কেমন নিমেষে সংসারে আমার নাম করুণা হয়ে গেল। শীতের বিকেলের সোয়েটার জড়ানো ব্যথা বলে ওঠে আমাদের গেছে যে শেখার কথা বাঁচার কথা তারা কথায়। কী করে বলি প্রতিটা অতীত আমাকে বলে বিষাদ আমার প্রকৃত শিক্ষক।

1 comment:

একনজরে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"ইস্কুল বলিতে আমরা যাহা বুঝি সে একটা শিক্ষা দিবার কল। মাস্টার এই কারখানার একটা অংশ। সাড়ে দশটার সময় ঘণ্টা বাজাইয়া কারখানা খোলে। ...