Friday, September 14, 2018

ধারাবাহিক গদ্য- চন্দন ঘোষ










চিকিৎ"শকিং" ডায়েরিঃ শ্রীনগরের সুনীল আকাশ


সিঁদুর মাখানো বটগাছটার ঝুপসি অন্ধকারে সাইকেল নিয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সৌম্য। সাতসকালে আকাশ একেবারে ভেঙে পড়েছে। আজ আর হেলথ সেন্টারে পৌঁছনো যাবে কিনা জানে না সে। সদ্য সদ্য সাইকেল চালানো শিখেছে। তার ওপর এই খোয়া ফেলা রাস্তা। আর নৈবেদ্যে কাঁঠালি কলা এই বিড়ালে-কুকুরে বৃষ্টি। এক হাতে ছাতা বাগিয়ে সাইকেল চালানো তার পক্ষে অসম্ভব। তাই এইভাবে ভেজা ছাড়া আর গতি নেই।

মাত্র পনেরো দিন চিত্তরঞ্জনে রেলের চাকরি করে একরকম পালিয়ে এসেছিল সৌম্য। ওই রেলের চাকরির ঔপনিবেশিক আদব-কায়দায় অতিষ্ট হয়ে গেছিল সে। কিন্তু তার ধারণা ছিল না, হেলথ সার্ভিসের চাকরি করতে এসে একেবারে কড়াই থেকে উনুনে এসে পড়বে। বারাসাত থেকে বহরমপুর এক্সপ্রেসে চাকদা, সেখান থেকে লোকাল বাসে বেলিয়া বাজার। তারপর এবড়োখেবড়ো রাস্তায় তিন কিলোমিটার ভ্যান বা সাইকেল। সাইকেল চালানো জানত না প্রথম প্রথম। ভ্যানের ঝাঁকুনিতে কোমর যায় যায় অবস্থা। অবশেষে সেকেণ্ড হ্যান্ড একটা সাইকেল দেড়শ টাকায় কিনে সাইকেল শেখা এই রাস্তাতেই। জয়েনিং-এর দিন লোকাল এম এল এ আর তার দলবল হাইজ্যাক করে তাকে। সাত বছর ডাক্তার নেই হেলথ সেন্টারে। হাসপাতালের শ্রীগণেশ করতেই হবে। একে তো ছাড়া চলবে না। সে ডেলিপ্যাসেঞ্জারিই সই।

চার দিকে ধু ধু মাঠ। আর দেড় মানুষ উঁচু পাট ক্ষেত। মাঝখানে আধভাঙা এক বাড়ী। সেখানে প্রথম দিনই ঘেরাও হল সৌম্য। একদল লোক, সব সিপিএম, ঘিরে ধরে বলতে লাগল, আপনার এই রেজিষ্টার জাল। এই সেন্টারে পুকুরচুরি হচ্ছে। ভিড়টার দিকে একবার তাকিয়ে সৌম্য ভাবল একটা হেস্তনেস্ত করতে হচ্ছে। যা হয় হবে। সে বলল, আপনারাই ঠিক বলছেন। ঠিক আছে, পুলিশ ফাঁড়িতে চলে যান। ওখানে গিয়ে কমপ্লেন করুন, হেলথসেন্টারে একজন ডাক্তার এসেছে, সে চোর। আর আমাকে ওরা ধরে নিয়ে জেলে পুরে দিক। এই শুনে ওরা যেন পুরো ব্যোমকে গেল। একদল বলল, আরে ডাক্তারবাবু এত রেগে গেলে চলে। তারা আবার অন্যদের ধমক দিয়ে থামাল। তারপর একটু এনকোয়ারি করে দেখবেন, স্যার, বলে হাতফাত মিলিয়ে চলে গেল। তারপর কতদিন যে চলে গেল এই শ্রীনগর হেলথ সেন্টারে।

এইসব সাত পাঁচ ভাবছিল সৌম্য। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ বলে উঠল, দাদাবাবু এখেনে ভিজতিছ কেন? চল ইখুনি। কাছেই একটা সাঁওতাল পাড়া আছে। সুনীলদের বাড়ির খুব কাছেই এসে সে যে দাঁড়িয়েছে তা সৌম্যর খেয়াল ছিল না। সুনীল ওর কাছে মাঝেমাঝেই আসে। ভ্যান চালায়। লোকাল ব্যাঙ্ক ম্যানেজারকে বলে সৌম্যই ওর ব্যাঙ্ক লোনের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। সে লোন শোধ করে নতুন লোন নিয়ে ধীরে ধীরে ও চারখানা ভ্যান করেছে। চারভাই চালায়।

 সুনীলদের বাড়ি এসে সৌম্য একটা বড়ো চালার নিচে আশ্রয় পেল। দেখে আগুনের মধ্যে সিঁক দিয়ে কী একটা পোড়ানো হচ্ছে। প্রথমে ভেবেছিল মুরগী, পরে বুঝল ওটা একটা ধেড়ে ইঁদুর। ওরা এসব খায়। পান্তা ভাত, লঙ্কা, নুন, তেল সব রেডি। সৌম্যর একটু গা গুলিয়ে ওঠে। সুনীল এসে একগাল হেসে বলে, দাদাবাবু একটু চা খাবি। সৌম্য না করে। একটু ইতস্তত করে সুনীল বলে, দাদাবাবু, একটু অসুবিধেয় পড়ে গিছি। তাই তোর টাকাগুলো এখুনি দিতি পারছি না। সৌম্যর মনে পড়ে মার অসুখের সময় সুনীল কিছু টাকা নিয়েছিল। সৌম্য মনেমনে প্রায় সত্ত্ব ত্যাগ করেই টাকাগুলো দিয়েছিল। তার প্রায় মনেই ছিল না টাকার কথা। সুনীল কিন্তু ভোলেনি। এরপর সুনীল প্যান্টের পকেট থেকে একটা খবরের কাগজের মোড়কে কী একটা বার করে আনে। বলে, দাদাবাবু এটা তুই রাখ ইখন। পরে টাকা হলে আমি ফেরত নিব। এ কিন্তু চুরিচামারির মাল না। আমার মায়ের বাপ আমাকে দিছিল অন্নপ্রাশনে। দেখ, দেখ আমার নাম লিখা আছে এখেনে। সৌম্য দেখে একটা বড়ো রূপোর তাবিজ, উপরে নাম লেখা "খোকা"। 

  সৌম্যর থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল। কোনো কথা সরছে না মুখ দিয়ে। বাইরে বৃষ্টি ক্রমশ ধরে আসছে। পৃথিবীতে খুব তাপ জমেছিল। সুনীলরা বৃষ্টি হয়ে সেই তাপ যেন মুছে দিয়েছে আজ।

No comments:

Post a Comment

একনজরে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"ইস্কুল বলিতে আমরা যাহা বুঝি সে একটা শিক্ষা দিবার কল। মাস্টার এই কারখানার একটা অংশ। সাড়ে দশটার সময় ঘণ্টা বাজাইয়া কারখানা খোলে। ...