Friday, September 14, 2018

কাঁকিরডাঙ্গা, সক্রেটিস ও বনলতা'র শিক্ষক দিবস -- উজ্জ্বল ঘোষ


     




                                     


কাঁকিরডাঙ্গা আঠারো-বিশ ঘরের একটা খুব ছোট জনপদ। আমাদের গ্রামেরই অংশ, কিন্তু গ্রাম থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন, প্রায় এক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটা পাড়া। লোকে বলে খাঁড়িয়াপাড়া। সে পাড়ার সঙ্গে আমাদের বিশেষ যোগাযোগ ছিল মূলত দুটি কারণে। প্রথমত সেখানে ছিল আমাদের খেলার মাঠ। প্রতিদিন বিকেলে খেলতে যেতাম দলবেঁধে। তাই খাঁড়িয়াপাড়ার ছেলেরা আমাদের বন্ধু ছিল, যাতে শ্রমিক-মালিকের চিহ্নিত দূরত্বও ছিল।তা ছিল নিজেদের অজান্তেই। তবুও খেলবার সময়টিতে হাতে হাত মিলে যেত অনায়াসে, কখনওবা আন্তরিক আলিঙ্গন হত দুর্দান্ত কোনো ক্যাচের পর।যোগাযোগের দ্বিতীয় কারণটা হল খাঁড়িয়াপাড়ার মহিলা পুরুষ সবাই ছিল আমাদের লেবার। দেখতাম মরদরা খালি গায়ে আর মহিলারা কাপড়ের ওপর জামা পড়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যেত ।আমরা বলতাম কৃষেণ।কেউ কেউ ছিল বাঁধা কৃষেণ।তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ওই দূরত্ব ডিঙিয়ে আর একটু ঘন হয়ে যেত।সবাই বলত খাঁড়িয়াদের মধ্যে আদিমতার অনেক বৈশিষ্ট বর্তমান। তারা পশুপাখির কাঁচা মাংস পুড়িয়ে খায়। স্বচক্ষে দেখেওছি অনেকবার ধেড়ে ইঁদুর পুড়িয়ে খাচ্ছে।একবার ছোড়দা লঙ অনের ওপর দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিল,বল পড়েছিল খাঁড়িয়াপাড়ার ভেতরে।বল কুড়োতে গিয়ে দেখি ইয়াব্বড় কাঁচা মাংসের স্তূপ। পরে জেনেছিলাম সেদিন তাদের পরব।গোটা পাড়া সেদিন একসঙ্গে খাবে আর রাতে,নারী পুরুষ নির্বিশেষে, হাঁড়িয়া ও মাদল সহযোগে চলবে উদ্যাম নৃত্য। এহেন খাঁড়িয়াদের অনেক আধুনিক ছোঁয়াও ছিল।তারা সেজেগুজে ভিন গাঁয়ের কালিপূজো দেখতে যেত।তারাও চাকরিবাকরির খবর রাখত। বাড়ি বয়ে এসে চাল, ডাল, মিষ্টি আর পূজোয় নতুন জামাকাপড়ের প্রতিশ্রুতি নিয়ে যেত।আশীর্বাদও করত মন খুলে। তাদের সন্তানদের জন্যও যে তারা স্বপ্ন দেখে সেকথাও যেতে যেতে অশ্রুস্নাত চোখে জানিয়ে যেত।

এরকমই এক স্বপ্নের নাম ছিল মনসা খাঁড়িয়া। পাটীগণিতের কঠিন কঠিন অঙ্ক সে করে ফেলত।স্যার "বিভীষণের প্রতি ইন্দ্রজিৎ " কাব্যাংশ পড়ানোর আগে সে রামায়ণের সেই কাহিনী শুনেয়েছিল গল্প বলে।স্যার শুনে মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন :"তোর ভেতরে দিন বদলের স্বপ্ন বোনা আছে। " কার কাছে শিখেছে জানতে চাইলে মায়ের কথা বলেছিল। লক্ষ্মী খাঁড়িয়া।খাঁড়িয়াপাড়ার একমাত্র পরিচ্ছন্ন মহিলা।মনসা ক'দিন ইশকুল না আসায় স্যারের আদেশে তার বাড়ি গিয়ে দেখি একখানা ঘর কী যত্নে সাজানো! নিকোনো, টানটান। দেয়ালে পটচিত্র আঁকা।বাঁশ আর পাটা দিয়ে বানিয়েছে বইয়ের তাক। তাতে মনসার পুরোনো " নব গণিত মুকুল ", নতুন "গণিত", "Learning English"রা রাখা আছে অত্যন্ত যত্নে।বই-এর তাকের ওপর মা সরস্বতীর ছবি আঁকা আছে।লক্ষ্মী পিসি বলেছিল মনসা পর্বতপুর গেছে কৃষেণ খাটতে। এক হপ্তা বাদে ইশকুল যাবে আবার।

আর ইশকুল যায়নি মনসা।কাঁঠালবাগানের ভাঁটিখানায় একপেট পাঁচুই খেয়ে সন্ধেয় বাড়ি ফিরছিল তার বাবা।নেশার ঘোরে উলটে পড়ে যায় সাইকেল সমেত নতুন পুকুরের জলে। মনসা দেখতে পেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দুজনেরই লাশ ভেসে থাকতে দেখেছিলাম। সে রাতে চোখের পাতা এক হয়নি। কাঁপা ঘরে মনসার মুখে লেগে থাকা তার মায়ের শেখানো কথাগুলো সারারাত শুনেছিলাম -- ঈশ্বর সর্বশক্তিমান।

                                                 
ঈশ্বর সর্বশক্তিমান? আমার বিস্ময় জাগে এই ভেবে যে ৪৭০ বি.সি.তে জন্মানো একটা মানুষ পূর্ণচ্ছেদের বদলে একটা জিজ্ঞাসা চিহ্ন রোপন করেছিলেন।সারাজীবন দিয়ে করেছিলেন প্রশ্নচিহ্নের সুচিন্তিত চাষ। মৃত্যু দিয়ে ঘরে তুলেছিলেন ফসল,যার নাম সত্য। পেলোপোনেশিয়ান যুদ্ধে বিধ্বস্ত আথেনিয়ান মানুষের সামনে যিনি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন প্রকৃত গণতন্ত্রের দর্শন ---In a democracy, the best way for a man to serve himself, his friends and his city--even during times of war, is by being loyal to,and by speaking publicly about, the truth. ( "Socrates on Trial" by Andrew Irvine) সক্রেটিস। 'ডাইড্যাকটিক'র যুগে 'ডাইলেকটিক'র প্রবর্তনকারী সেই প্রবাদপ্রতিম গ্রীক দার্শনিক। পৃথিবীর আদি সত্যানুসারীদের অন্যতম এক আশ্চর্য নতুন শিক্ষক। ছাত্রদের শেখালেন প্রশ্ন করতে।প্রচলিত নীতি,বিশ্বাসের কাছে অন্ধ সমর্পণ নয়, বরং প্রশ্নের মধ্যে দিয়ে যুক্তিনির্ভর সিদ্ধান্তে পৌঁছানোই যাদের উদ্দেশ্য। ফল যা হবার তাই হল। তার বিরুদ্ধে যুব সমাজকে বিক্ষুব্ধ ও করাপ্ট করবার এবং ঈশ্বরে অবিশ্বাসের চার্জ আনা হল।দেয়া হল মৃত্যুদণ্ড। সক্রেটিস সত্যের জন্য মৃত্যুকে বরণ করে নিলেন। অথচ ডাইকাস্টদের তৃপ্ত করে মৃত্যুকে এড়িয়ে যেতে পারতেন তিনি।তা না করে তিনি অমর করে গেলেন ধর্মান্ধতার বিপরীতে যুক্তিনিষ্ঠ অবস্থানকে। জিজ্ঞাসার ছোট ছোট শিখা জ্বলেই আলোকিত হয় সত্য।সেই সত্যের ছায়ায় রয়ে গেল গুরু-শিষ্য চিরন্তন পরম্পরা -- সক্রেটিস-প্লেটো-অ্যারিস্টটল...

                                                 
গতবছর শিক্ষক দিবসে একটা নাটিকা লিখে ছেলেমেয়েদের দিয়ে মঞ্চস্থ করিয়েছিলাম -- "প্রিয় হেমলক"।সে নাটকের পার্শ্ব চরিত্রগুলি ছিল মানব, ঈশ্বর ও প্রকৃতি। প্রোটাগনিস্ট ছিল একজন শিক্ষক-- নাম মনসা খাঁড়িয়া।নাটকটা বেশ সাড়া জাগিয়েছিল ছাত্রছাত্রীদের মনে।নাটক শেষ হবার পর একাদশ শ্রেণীর বনলতা হাঁসদা এসে জিজ্ঞাসা করেছিল : " আচ্ছা স্যার, কে বড় -- মানুষ, ঈশ্বর না প্রকৃতি? " মুহূর্তে সামনের পৃথিবীটা মাটির নীচে চলে গেল, মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এল আর একটা পৃথিবী যেখানে মনসা শাসকের উদ্ধত তরবারির সামনে  দৃপ্তকণ্ঠে বলছে my death will be the seed of many disciples who will surely convince you of your evil ways... মনসাকে অবাক বিস্ময়ে দেখছে প্লেটো, অ্যারিস্টটল ও বনলতা।দেখছি আমি এবং আরও অনেকে।দেখছে মহাকাশের উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক, সক্রেটিস।

2 comments:

একনজরে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"ইস্কুল বলিতে আমরা যাহা বুঝি সে একটা শিক্ষা দিবার কল। মাস্টার এই কারখানার একটা অংশ। সাড়ে দশটার সময় ঘণ্টা বাজাইয়া কারখানা খোলে। ...