থাকে শুধু..
অস্তের পর রেনবো জেম কেটে গিয়ে যে ভ্যানিলার বল উঠত আকাশে, তার গায়ে লেপটে থাকত।
অন্ধকার।
অন্ধ করে যে- সে আমায় শিখিয়েছে অনেককিছু।
শিখিয়েছে দিন মানে being sane ;
রাত মানে বনলতা সেন। দাদুর দস্তানায় লুকোন হিসেব আর অনুভূতির লম্বা নজরানা।
অন্ধকার শিখিয়েছে মূত্রনালী ফেটে পড়ার উপক্রম আর ভূতের পারস্পরিক সম্পর্ক। ড্রাকুলা আর কার্মিল্লা বা মিল্লার্কা বা মির্কাল্লার প্রেম ও বিয়ের সম্ভাবনা; এমনকী 'কচি তারা কথা ফোটে না 'গোত্রের রক্তচোষা পোলাপান অন্ধকারের আবিষ্কার।
ডিসি।
সন্ধ্যে হলেই লোডশেডিং, দেওয়ালগিরির সন্দেহজনক গন্ধ, প্রোজেক্টর দেয়াল, রহস্যময় আংগুল, ছায়া হরিণ- ওই অব্দিই দৌড় ছিল। দিদিভাই আরও অনেক কিছু পারত। কুকুর, উট, পায়রা। দিদিভাইয়ের হাতের কাজ ভাল বরাবর। সেইপ্রথম জানা গেল, ছায়ারও এমব্রয়ডারি হয়। রহস্যেরও সরু সরু চাকতি চাকতি শালপাতায় মোড়া কুলপি হয়, সিন্ডারেলা কিরণমালা সিন্দবাদ একই অন্ধকারে জিন্দেগী কা সফরে বেরিয়ে পড়ে মিলিয়ে যায়, বাকিটা.. কোই সমঝা নেহি, কোই জানা নেহি। লোডশেডিং এর ক্যাটারার বদলে যায়। গ্রীষ্মমেনু আলু- পটলের তরকারি, দৈবাত কুমড়োর ছক্কা। শীতমেনু আলু - ফুলকপির তরকারি বা ডালনা, তাতে শ্যাওলার কান্নাফোঁটার মতো কড়াইশুটি; টুপ কিংবা টাপ ।
খেয়েদেয়ে ছাদে গিয়ে গলিপথের দিকে চেয়ে থাকা। দিনগত 'পেচ্ছাপের গলি', বাতাসের অভিশাপে মুতের গন্ধে টিকতে না পারা গলি, রাস্তার কল থেকে অজগর - লাইনের ফণার সাথে লেজের একমগ জল নিয়ে ঝগড়া করার গলি, বাড়ি থেকে বেরিয়ে চলনপথ পেরনোমাত্রই রাস্তায় সদ্যজাত নরম কাঁচা ভৌ কলকা অলংকৃত গলি। বাড়ি থেকে বেরোলেই ডানদিকের আমৃত্যু গ্যারেজে ছুঁচো ইঁদুর আর বিড়ালের ফুলশয্যা লেবাররুম ও ক্রেশ আর গ্যারেজ ছাড়িয়ে রাস্তায় পা রাখলেই ডানদিকে একটা ডাস্টবিনের গাড়ি, তাতে চব্বিশ ঘন্টা এক বা দুই বা তিন বা চারটে কুকুর লাফিয়ে পড়ে খাবারের খোঁজে। মলয় বাতাসে মুতের সাথে সেই ডাস্টবিনের গন্ধ, কুকুর ও গ্যারেজের প্রাণীদের বর্জ্য ও উপস্থিতির গন্ধ সম্মিলিত গলিতেও - একটা মায়াস্নিগ্ধবিরতি ঢেলে দিত অন্ধকার।
অন্ধকারই জানিয়েছিল, এ গলিরও একটা সৌন্দর্য আছে; এই রাস্তাটা শুধুমাত্র কল্যাণচক্র অভিযাত্রী ক্লাবে ধাক্কা খেয়ে পিছন দিকে সো - ও -ও - জা সাঁ করে চলে গিয়ে চক্রবেড়িয়ায় পড়ে এদিকে পূর্ণ বা ওদিকে জগুবাজারে মিশে না গিয়ে নির্ঘাত স্বর্গের দিকে বা জ্যোতস্নার দিকে যাত্রা করে, যেমন শিবের কথা আকাশ থেকে নেমে আসে বজ্র হয়ে, তেমন এই রাস্তা পেচ্ছাপের গলির কথা নিয়ে যায় অমরা ঐশ্বর্যে।
এই গলির লাল রকেও বৃন্দাবন নামিয়ে দেয় অন্ধকার। কলেজ, কোচিং কামাই করা দৈবাত দুই রোমাঞ্চিত মাংস বাংময় যখন লাল রকে ঈষৎ নীল, সেই নীলের প্রতি এপাশে ওপাশে যখন রক্তচক্ষুর কানাঘুষো অভিভাবকত্ব আর 'প্রেম করা মহাপাপ ও নষ্টামি'র পবিত্র মন্ত্র উচ্চারিত - অন্ধকার আমাকে শেখায়, অন্ধকারের বুকে মহামোহময়ী অদম্য নির্লজ্জ বিদ্ধংসী দুষ্টু বিরাজে।
একঘুম হওয়া একরাতে জানলার ওপারে বিন বিন করে কাঁদা এক রহস্যময়ীর অবয়ব। পাড়া পড়শীর জেগে ওঠা- 'ওখানে কে?? ' খিঁচিয়ে উঠে ভয়ার্ত নারীকে আরও ভয় পাইয়ে ভাগিয়ে দিয়েছিল অন্ধকার। এক বা একাধিক রিকশাওয়ালা হয়তো তাড়া করেছিল, তার নিজেরও হয়তো সম্মতি ছিল, তারপর ভয় পেয়ে পালিয়ে এসে এখানে লুকিয়েছে। অনেক ফিসফাস ছিল সে রাত - বাতাসে। অন্ধকার বলেছিল, সতীসাধ্বীর বাইরেও একটা প্রাগৈতিহাসিক থাকে বা চির আস্তিত্বিক।
সেই আস্তিত্বিক অন্ধকার আমাকে জানায়, ওই ফুট দিয়ে আনমনা ঢুলুঢুলু চোখ চাপদাড়ি ঢোলা জিন্সের হেঁটে যাবার সংগে রাতের পাশবালিশের সম্পর্ক। মাসিকের ন্যাকড়ার বদলে যখন থেকে ন্যাপকিনের ব্যবহার শুরু হল, তখন অন্ধকার জানাল,সে ঘনালে তবে ব্যবহৃত কর্ণন্যাপকিন আদা লংকা রসুন আনার ছোট প্লাস্টিকে পুরে তার উপর কুটনোর খোলা ফেলে সমাধি সম্পূর্ণ করে গা ঢাকা দিয়ে অতর্কিতে গোপনে ডাস্টবিনে দাদা বাবা কাকাদের চোখ বাচিয়ে ফেলতে হয়, মাসিক একটা ছি ছি ছ্যা ছ্যা ব্যাপার তো। সে আরও জানায়, মাসিকের ন্যাপকিনটাও অন্ধকারে বা খবরের কাগজে মুড়িয়ে আনতে হয়। পাপীতাপী প্লাস্টিকটা ডাস্টবিনে ছুঁড়তে না ছুঁড়তেই কুকুর এসে শুঁকতে শুরু করে। গা গুলিয়ে ওঠে ঘেন্নায়। ভয় হয়। যদি বার করে ফেলে - লজ্জার একশেষ। তবে ন্যাপকিনে পাপীয়সীর নাম লেখা থাকে না ভেবে ভরসা হয়। অবশেষে আনন্দ হয়। যাক, কেউ তো গুরুত্ব দিচ্ছে পৃথিবীর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার নেপথ্য অমোঘকে।
অন্ধকার আমাকে মুখোমুখি বসায়। হাজার বছর ধরে পথ হাঁটায়। পথে কাঁটা বিছোয়। নীল শাড়ি পরে যমুনায় জল আনতে পাঠায়।পাগল হয়ে বর্ষারাতে বাড়ির বাইরে বার করে শ্যামসায়রে নাইতে শেখায়। যমুনার বুকে হ্যাঁচড় প্যাঁচড় করতে করতে ভিজে লতপতে ভারবাহী প্রেম আর কোল্ড এলার্জি সামলে ওপারে কুমীরের মতো বুক বেয়ে উঠে যখন হাপর - হাঁপে জর্জরিত, দেখি, বাঁশীটা ফেলে গেছে অশ্যামশালা। ঝেড়ে ঝেড়ে ঘাট থেকে ঘাত আর প্রতিঘাত বার করছেন বিভূতিভূষণ। দোবরু পান্নার পূর্বপুরুষদের আরণ্যক টিলাসমাধির সামনের এক ঢিবিতে বসিয়ে তিনি যখন আমার হাতে বুনো তেউড়ির ফুল তুলে দিলেন, আমি সন্দিগ্ধ চোখে তাকালাম তার দিকে আর কদম ফুলের সাথে এই ফুলের কতটা সাদৃশ্য বা বৈসাদৃশ্য আছে, তা মাপতে থাকলাম। ঠিক এইরকম একটা সময়ে তারকোভস্কি' ঘর খুলে যায়, জানলার কাচ ভেংগে অচিনপাখি পালায়, সাদা লেসের পর্দা হাওয়ায় দুলতে থাকে, আমি এগোতে থাকি, অন্ধকার আমার হাত ধরে। আমি এগোতে থাকি। অন্ধকার আমার কানে মুখ রেখে বলে,
'রাইজন্ম ছাইজন্ম, যদি না পড়ো ধরা..'
No comments:
Post a Comment