গ্রন্থ- দুব্বোঘাসের লেখা, বুবুন চট্টোপাধ্যায়
প্রকাশক- সপ্তর্ষি প্রকাশন
প্রচ্ছদ - মৃণাল শীল
৬০ টাকা
নব্বই দশকের কবিতার আরও এক বৈশিষ্ট্য বলে মনে হয় ব্যক্তিগত জীবনকে সমষ্টির জীবনের প্রেক্ষিতে দেখা। এই প্রবণতা প্রায় কম বেশি সকলের মধ্যেই দেখা যায়। তবু কয়েকজনের মধ্যে দেখতে পারি, শেষ পর্যন্ত তা ব্যক্তিগত ন্যারেটিভ হয়েই থাকল। কিন্তু আগামী সময় তো আর তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের প্রেম ইত্যাদি শুনতে আগ্রহী হবে না। বরং আগামী সময়ের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যাবে, সেই ব্যক্তিগত জীবনদর্শন বা জীবনযাপনের মধ্য থেকে উঠে আসা জীবনের ভাঙাচোরার শব্দগুলি।
বুবুন চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার মধ্যে এই ভাঙাচোরার শব্দ ভীষণভাবে ছোঁয়া যায়।
দুর্দিন পা-ঝুলিয়ে বসে আছে
পাঁচিলের উপর
একা একা শিস দিচ্ছে
পাঁচিলের শরীর বেয়ে মরচে পড়া রোদ
ওই রোদে পিঠ সেঁকছে আজন্মের শোক।
(দুর্দিনের জার্নাল)
কত সহজ ভাষায় বুবুন ঢুকে পড়তে পারেন আমাদের জীবনের সংকটের দর্শনে। সেই ভাষার মধ্যে কখনও কখনও ঢুকে পড়ে জাদুবাস্তবতাও। আর সে জাদুবাস্তবতা কখনওই প্রক্ষিপ্ত বলে মনে হয় না, যখন আমরা পড়ি-
পৃথিবী আত্মহত্যা করিয়াছে এ কথা বলিয়া সুতানুটি চলিয়া গেল দ্বীপান্তরে। কেন সুতানুটি এ হেন বলিয়া গেল? পৃথিবী মরিলে সুতানুটির তো মৃত্যু অনিবার্য ছিল।... (সুতানুটি)
এই কবিতাটিই শেষ হচ্ছে এইভাবে-- আরও কত পৃথিবী আত্মহত্যা করিবে সুতানুটির প্রেমে?
তথাকথিত শোক নয়, বরং দুঃখের এক গোপন জার্নাল যেন লেখা হয়ে চলে এই কাব্যগ্রন্থে। তার ভাষায় বরং আশ্রয় নেয় এক তির্যক রস, শ্লেষ।
আমরা পড়ি-
দ্বারে কি প্রহরী ছিল? সদ্যপ্রসবিত প্রহর বৃদ্ধের কানে
কর্তাল বাজাইয়া চলিয়াছে অবিরাম।
এ সবে বৃদ্ধের মন নাই।
মন নাই কুসুমে...
মন শুধু ঘুরিয়া মরে শেয়ারবাজারে।
(বয়ঃক্রম)
এই সংকট্ময় বিশ্বের প্রতিনিধি হয়েই আমাদের কাছে ফুটে ওঠে ডায়েরির কিছু অংশ, কানেকানে এবং বিষজন্ম-এর মতো বহুবছর মনে রাখার মতো কবিতা। এই কবিতাগুলি যেহেতু সময়কেই গুলে খায়, তাই এই কবিতাগুলির মধ্যে সময়ের সঙ্গে এক টক্কর নেওয়া ভাষাই কাজ করে চলে। এই বইয়ের দ্বিতীয় অংশ স্ট্রবেরি ফিল্ডে লক্ষ্মী সর্দার। এই অংশে রয়েছে উড়ো খইয়ের মতো নাট্যকবিতা। রয়েছে রাকা-মনসিজের কথোপকথনের মধ্যে মুহূর্তের মধ্যে দিয়ে অনন্তের সংকটকে এক মুহূর্তে ধরে ফেলা। এ এক অত্যন্ত তীক্ষ্ণ কবিতার কাজ। যেমন এই তীক্ষ্ণতাকে খুঁজে পাওয়া যায় সমবয়সী চাঁদ এবং গাছ হওয়ার গল্প কবিতাদুটির মধ্যেও প্রতিফলিত হয়। গাছ হওয়ার গল্প- কবিতাটির শেষ পংক্তি তো মনের মধ্যে ঘুরতেই থাকে। হয়ত সকলের মনের মধ্যেই প্রতিধ্বনিত হয়।
মনসিজ তুই কি এখন
সবাইকে বলে দিবি
আমরা কী একটা করতে করতে
গাছ হয়ে গেলাম
বুবুন চট্টোপাধ্যায়ের এই কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতার মধ্যেই এক চোরা বিষাদ কাজ করে। ধূসর এক মৃত্যুচেতনা ছায়া ফেলে আছে কবিতাগুলির উপর। আবহে বাজছে দূরের এক ভায়োলিন। প্রচুর ধোঁয়া। হাওয়া দিচ্ছে। কথাগুলি ভালো করে শোনা যাচ্ছে না। তবু কবি কথা বলে চলেছেন। আশা করছেন, তাঁর কাছে কেউ না কেউ আছেন, যিনি শুনবেন। কিন্তু তিনি নিজেও জানেন হয়ত কেউ শুনবে না। এই আশা করাটাই সার হবে। আর পড়ে থাকবে এই কথাগুলি।
কতদিন পর
তবু মুঠোভর্তি বিষন্নতা ছড়িয়ে দিয়ে গেলে
শৈশবের ক্ষতমুখে
একটি রঙিন পালকও ছিল
সেই পালকটি ছুঁতে চেয়েছি আজীবন
এই পর্বের অনেকগুলি কবিতাই মনের মধ্যে দাগ কেটে যায়। শুধুমাত্র অনুভূতিমালাই নয়, বলা যায় মেধাবী অনুভূতিমালা। প্রথম দশকের কবিদের কাছেই নয়, তার পরের দশকের কবিদের কাছেও বুবুন চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার এই মেধাবী অনুভূতিমালা ছড়িয়ে যাবে আশা করা যায়। কারণ তাঁর কবিতা অনেক যন্ত্রণাকে বুকের মধ্যে পুষে রেখে আছে। অথচ কবিতার অন্তরাত্মাকে স্পর্শ করে আছে।
'... নাড়ুদার শ্বশুর ভেন্টিলেশনে
ননদের বরের ঘুসঘুসে কাশি
শাশুড়ির বোনপো ইউএস গেল
বয়েই গেল...
ঘন্টাদুয়েক ভুবনগ্রামে পাড়ি
আমার জন্য আমিই পারি
চলিত এবং রাঢ়ি।
(আমার জন্য)
হ্যাঁ তিনি তাঁর জন্যই লেখেন। কিন্তু কবিতার মাধ্যমে হয়ে ওঠেন সকলের। আগামী সময়েরও।
No comments:
Post a Comment