Friday, September 14, 2018

তোমার আছে তো হাতখানি-- শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী





ব্যবহারবিদ বি এফ স্কিনার বলতেন ,"শিখিয়ে দেওয়া বুলি ভুলে যাবার পর যতোটুকু স্মৃতিতে থেকে যায়,তারই নাম শিক্ষা "।অথচ আমরা সারাজীবন সেই বাঁধাবুলির ওপরেই যাবতীয় মনোযোগ রেখে চলি ।ত্রুটি বিচ্যুতি ঘটলে রেগে যাই । আবার নিজেদের যারপরনাই প্রচেষ্টা শেষ হলে স্বচ্ছন্দে তাদের ঠেলে দিই পরের প্রজন্মের দিকে ।অথচ এমন তো কথা ছিল না ।কথা ছিল ভুলবার ।এমনই কয়েকজন মানুষ ,যাঁরা আমাকে ভুলতে শিখিয়েছেন ,ভুলে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছেন ,সেই ভাবনায় বিশ্বাস প্রতীষ্ঠা করতে শিখিয়েছেন ,তাদের কথা বলব আজ ।


১।পাম এভিনিউয়ের করিডর


করিডর ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে চলেছেন একটি বছর আটেকের ছেলেকে ।গন্তব্য হেডমিস্ট্রেসের ঘর ।যেতেই মাঝপথে থমকে দাঁড়ালেন ।ছেলেটি থতমত খেয়ে রয়েছে ।তার বিরুদ্ধে অভিযোগ বেশ গুরুতর ।ক্লাসে লাস্ট বেঞ্চে বসে সে সামনের দিকে আঙুর ছুঁড়ছিল ।নির্ঘাত সাসপেন্ড হবে ।এই পরিস্থিতিতে হঠাৎ সুনন্দা মিস দাঁড়িয়ে পড়লেন ।বললেন ,"বলো তো ,আঙুর আর তোমার এই পৃথিবীর মধ্যে মিলটা কোথায় ?"
ছেলেটি থতমত খেয়ে ভাবতে থাকে ।সুনন্দামিস বলেন "পরের বার আঙুর ছুঁড়ে দেবার আগে ভাববে ।দুজনেই ইলিপ্সয়েড ।"
ভাবতে ভাবতেই পার হয়ে গেল এক যুগ ।মাধ্যমিকে স্কুলের মধ্যে ভূগোলে সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়ে খুঁজতে গেলাম সেই করিডরে ।সুনন্দামিস অবসর নিয়ে নিয়েছেন ।হেড দিদিমণি ফোনে কথা বলিয়ে দিলেন ।মিস শুধু বললেন ,"ভালো থাকিস বাবু ।অনেক বড়ো হ ।"

২। অদ্বৈত আশ্রম অভিযান


তখন হাইস্কুল ।একতলায় আমাদের ক্লাসরুম ।প্রথম দিন ।বাংলা পিরিয়ড ।ভাবছি কে আসে কে আসে ।এমন সময়ে খদ্দরের পাঞ্জাবী আর ধূতি পরে অভিযানদা এলেন ।প্রথম দিন পাঠ্যপুস্তকে হাতই পড়ল না ।আমরা শুনলাম শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের "যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো" ,শঙ্খ ঘোষের "বাবরের প্রার্থনা" ,সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের "নীরা" আর নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর "কলকাতার যীশু" ।মুগ্ধতায় কেটে গেল চল্লিশ মিনিট ।সেই প্রথম প্রাপ্তবয়স্কতার ছোঁয়া ,সেই প্রথম কাব্যময়তার সামনে শিড়শিড়ানি অনুভূতি ।এর অনেক পরে একবার অদ্যৈত আশ্রমে একটা রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল ।রচনার বিষয় ছিল "স্বামীজির ছেলেবেলা" ।আমি বরাবরের মুখচোড়া ।পেটে খিদে ,অথচ ...।অভিযানদা বুঝতে পেরেছিলেন ।তাই আমাকে না জানিয়েই আমার নাম দিয়ে দেন সেখানে ।সেবার প্রথম হয়ে অনেকগুলো বই পেয়েছিলাম আশ্রম থেকে ।পুরস্কার প্রদানের দিন মহারাজ আমায় জিজ্ঞেস করলেন "তোমার প্রিয় বিষয় কি ?" বললাম "ইতিহাস "।বললেন "ভারতের ইতিহাসের কোন যুগ তোমার কাছে সোনার যুগ মনে হয়েছে ?"বললাম "গুপ্ত সাম্রাজ্যের যুগ।আজ ভাবি ।আজ কেউ এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে কী উত্তর দিতাম ?ভাবি ।হয়তো বলতাম "নাট্যশাস্ত্রের যুগ" ,"মেঘদূতম যুগ","গীতগোবিন্দমের যুগ","মেঘনাদবধের যুগ",বা "আরণ্যকের যুগ" ,"শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণার যুগ " ।ভাবতে ভাবতেই আড়চোখে হঠাৎই দেখলাম পিছনের সীটে বসে আছেন অভিযানদা ।মিটিমিটি হাসছেন ।টেক্সট বইয়ের বাইরে বেরিয়ে এসে আমাকে পড়তে শিখিয়েছেন তো অভিযানদাই ।সেই প্রথম দিন থেকে ।

৩। রামমোহন ব্লক


তখন হাসপাতাল জুড়ে আমার আর আমার সহকর্মী অনুব্রতর নাম ছড়িয়ে পড়েছে ।রামমোহন ব্লকটাই নাকি আমাদের বাড়ি ।আমরা অবশ্য নেহাতই হাউজস্টাফ ।তবু এখনকার মতো তখন চিকিৎসকদের নিয়ে এতো ইতরামি ছিল না ।আমাদের আউটডোরের পর দিব্বি প্রশ্রয় জুটে যেত ।রোগীর বাড়ির লোকের আমাদের ওপর অগাধ ভরসা ছিল ।সেই ভরসার আসল কারণ অবশ্য আমি নই ,অনুব্রতও নয় ।সেই ভরসার আসল কারণ অধ্যাপক ডাঃ সৌমিত্র ঘোষ ।
আসলে স্যার আমাদের মধ্যে এক অদ্ভুত মাদকাসক্তি ঘটসয়েছিলেন ।কোনও মারিজুয়ানা নয় ,ওয়ার্ডে ভর্তি রোগীদের সেবার নেশা ।সকালবেলা আমাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা লেগে যেত ।এক একটি ঘরের দায়িত্ব এক একজনের ওপর থাকতো ।আমরা একে অপরকে ছাপিয়ে যেতে চাইতাম ।রোগীর ব্যাপারের নাড়িনক্ষত্র কন্ঠস্থ থাকতো আমাদের । তাদের ডায়াগনোসিস ,প্রগনসিস ।আউটডোর শেষ হতো বিকেল সাড়ে চারটেয় ।ততক্ষণে অন্যান্য ইউনিটের লোকজন বহির্বিভাগ পরবর্তী কাজকর্ম সেড়ে কেউ ক্যান্টিনে আড্ডা মারছে ,কেউ টিটি করছে ,কেউ প্রেম করছে ।কিন্তু স্যারের ইউনিটের লোকজনের প্রেম বলতে একটাই ।রামমোহন ব্লকের প্রেম ।রামমোহন ব্লক হলো আমাদের মেডিসিন বিভাগের নাম। সারাটা দিনের পর স্যারও কিন্তু বাড়ি যেতেন না ।আবার নৈশ রাউন্ড শুরু হতো ।এই সময়টা স্যার আমাদের পড়াতেন ।চিকিৎসাবিজ্ঞানের নানান কঠিনতম পহেলির সমাধান করে দিতেন ।তারপর আমরা হাসপাতালেই ইউনিট রুমে থেকে যেতাম ।একসেট জামা রাখা থাকতো পরের দিনের জন্য আলমারিতে ।ঘরে বসে পড়া ঝালাতাম ।আর দুজনে মনে মনে ভাবতাম পরের দিন কে আগে শুরু করবে রাউন্ড ।স্যার আমাদের শিখিয়েছিলেন রোগী চিকিৎসায় শুধু ডায়াগনোসিসটাই আসল চিকিৎসা নয় ।আসল পথ্য হল ধৈর্য ,আস্থা আর কঠোর অধ্যাবসায় ।এমন সুবর্ণ দিনও একদিন শেষ হয়ে গেল ।স্যারকে ছেড়ে যেতে হলো আমাদের ।কেন ছেড়ে গেলাম আজও জানিনা ।তবে এটুকু জানি ,শেষ দিন স্যারকে একটা চিঠি লিখেছিলাম ।অতো বড় চিঠি আর কখনো কারোকে লিখিনি আমি ।বাবাকেও না ।লিখতে লিখতে কয়েকটা জায়গা ঝাপসা হয়ে গেল ।ঝর্ণাকলমে লেখা তো !অনেকবছর পর একদিন স্যারের সঙ্গে দেখা হলো ।প্রণাম করতেই বললেন ,"তোমার চিঠিটা এখনো রেখে দিয়েছি আমি শুদ্ধেন্দু ।"কী বলবো ?বিগ্রহের সামনে যেমন বসে থাকি ,ঠিক সেইরকম ক্যাবলার মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম ।বুঝতে পারলাম স্যার আমার অজান্তেই আমার ঝাপসা হয়ে যাওয়া লেখাগুলো পড়ে ফেলেছেন কখন ।স্যার পারেন ।একমাত্র স্যারই পারেন ।


৪। প্রফেসর ক্যালকুলাস


অনেকের কাছে এই নামের সঙ্গে টিনটিনকে মনে পড়বে ।তবে আমার কাছে এই নামটা মনে করিয়ে দেয় দেবাশীষদাকে ।প্রফেসর দেবাশীষ সান্যাল ।তার আন্তরিকতা আমাদের "দাদা" সম্বোধনের অধিকার দেয় ।কেন ক্যালকুলাস বলতে গেলে একটু ফ্ল্যাশব্যাক আনি ।তখন দিনকাল ভালো যাচ্ছে না আমার ।সংসারে ভালোরকমের অর্থকষ্ট ।অথচ সমাজের যে স্তরে আমি তখন রয়েছি তাদের বলে "নিম্ন মধ্যবিত্ত" ।এই নামের একটা মজা আছে ।একদিকে যেমন গাড়ি চেপে বেড়ানোর স্বপ্ন দেখা কপোলকল্পনা ,অন্যদিকে তেমনই ভিক্ষাবৃত্তি করা সামাজিক অপরাধ ।ফলত জোয়াল তুলে নিলাম কাঁধে ।সপ্তাহের সাতদিন চার পাঁচ জায়গায় খেপ ।একটা খেপ শেষ হতে না হতেই আর একটার শুরু ।খাওয়াদাওয়া কখনো নার্সিং হোমের ক্যান্টিনে ।কখনো বা চা বিস্কুট ।টাকা ফুটে পাত্রে ঢালবার মতো শেষ হয়ে যাচ্ছে দেনা মেটাতে মেটাতে ।এমনই সময় ঈশ্বর সদয় হলেন ।মনোবিজ্ঞানের দরজা খুলে গেল ।স্নাতকোত্তর হবার সুযোগ পেয়ে গেলাম ।আমারই কলেজে ।সেই রামমোহন ব্লক ।মানসিক রোগ বিভাগ ।সেখানেই স্যারকে প্রথম দেখি ।তখন আমাদের বিভাগীয় প্রধান কৃষ্ঞা ম্যাডাম ।ডাঃ সুবীর হাজরাচৌধুরী মনোচিকিৎসার পাশাপাশি অরবিন্দ আদিগা ,রেড সরঘাম পড়াবার প্রশ্রয় দিচ্ছেন ,সিনিয়র পিজিটি রঞ্জনদা (এখন স্বনামধন্য মনোরোগ বিশেষজ্ঞ) আমাদের নানান বিপদআপদ (উটকো প্রশ্নবাণ) থেকে আগলে রাখছে ।এরই মধ্যে দেবাশীষদা আমাদের শেখালেন মনোবিজ্ঞানের বৃহত্তর জগত ।
    হাতের কড়ি গুণে স্ট্যাটিস্টিক্স করে ফেলা কোনও বড় ব্যাপার ছিল না স্যারের কাছে ।মাঝেমাঝে মনে হত কোনও বিখ্যাত গণিতবিদের সামনে বসে আছি আমরা ।সমান্তরালে চলতো মনোসমীক্ষণ ।গবেষণা কীভাবে করতে হবে হাতে করে শিখিয়ে দিলেন তিনি ।
এর পরে আরো অনেক দুর্দান্ত শিক্ষক পেয়েছি মনোরোগবিদ্যায় ।আর জি করে পেয়েছি অধ্যাপক গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়কে ,যিনি কথা বলতে বলতে এঁকে দিতে পারতেন গিরীন্দ্রশেখর বসুর মুখ ,পেয়েছি অধ্যাপক ওমপ্রকাশ সিংহকে ,নীলাঞ্জনাদিকে ,ভাস্করদাকে ।কিন্তু পুরো ব্যাপারটাই অপূর্ণ থাকতো যদি প্রফেসর ক্যালকুলাস না থাকতেন আমার পাশে ।কীভাবে ?সেই কথা বলি ।
আসলে বিয়ে করে ফেলেছি তখন ।বিয়ের পর যা হয় আমারও তাই হলো ।সবাইকে সামাল দিতে দিতে দ্রুত পালটে যাওয়া পরিস্থিতির সামনে বসে হঠাৎ একদিন ঠিক করলাম রোজগার করতে হবে ।লেখাপড়া ছেড়ে দেব ।কেউ বলেনি ।তবু নিজে থেকেই ভেবে বসলাম ।দেবাশীষদা আন্দাজ করেছিলেন হয়তো ।একদিন বাড়িফিরতি গাড়িতে তুলে নিলেন আমায় ।নিজের জীবনের কথা বললেন ।সংগ্রামের কথা বললেন ।বললেন হাল না ছাড়তে ।আজ বুঝি সেদিন সত্যিই মনোবিজ্ঞান সান্নিধ্য ছেড়ে দিলে আজ হয়তো সবকিছুই হারিয়ে যেত ।আমার পরিবার আমাকে যেমন আশ্রয় দিয়েছে ,ঠিক তেমনই ডাঃ দেবাশীষ সান্যাল আমাকে শিখিয়েছেন ,হেরে যেতে নেই ।তাঁর আমাকে ঘিরে স্বপ্ন অপূর্ণ থাকার কারণ আমার ব্যর্থতা ।কিন্তু আমার প্রতি তার বিশ্বাস অটল থেকেছে ।আজও ।নিশ্চিত জানি ।


৫ । আমার আখ্যানমঞ্জরী



তখন বেশ জটিল সময় চলছে আমার ।ব্যাপারটা আর কিছুই না ।কয়েকটা লেখা লিখেছিলাম ।বেশ আবেগপ্রবণ লেখা ।কিন্তু বুঝে উঠতে পারছি না কী হয়েছে শেষমেশ ।এদিকে কার কাছে যাবো বুঝতে পারছি না ।তখন দুই কবি অগ্রজ সমরেশ মুখোপাধ্যায় ও গৌতম মন্ডল আমায় নিয়ে গেলেন তাঁর কাছে ।আর প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা যে নেহাত সুখস্মৃতি হল ,তাও নয় ।আমতাআমতা করে কয়েকটা লেখা রেখে এলাম তার কাছে ।বললেন ,"এক সপ্তাহ বাদে ফোন করো ।"সেই এক সপ্তাহ এই যায় আর সেই যায় ।ক্যালেন্ডারে ঢেড়া দিয়ে রাখি ।এই আর তিনদিন বাকি ।এই দুইদিন ।সমরেশদা বললেন ।গৌতমদা বললেন ।ভালো লিখেছ ।কিন্তু একসপ্তাহের মাথায় স্যারকে ফোন করতেই বজ্রাঘাত ।কেমন হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই বললেন ,"লেখ ।তবে ছাপতে দিও না ।আরো পড় ।বিষ্ঞু দে পড় ,সুধীন্দ্রনাথ পড় ।"ব্যাস ।পুরো ভেঙে পড়লাম ।ঠিক করলাম আর লিখবোই না ।স্যারের ওপর খুব অভিমান হলো ।ভাবলাম আর কক্ষনো যাবো না কৃষ্ঞনগর ।যখনই ভাবি "কক্ষনো করবো না" তখনই একটি শক্তিশালী বিপরীত প্রবণতা কাজ করে ভেতরভেতর ।সেই সুবাদেই দশদিন যেতে না যেতেই আবার স্যারের বাড়ি গিয়ে হাজির ।ভাবলাম বকুনি খাবো ।আমাকে অবাক করে দিয়ে স্যার বললেন ,"লেখা কই ?"আমি অবাক হই ।স্যার তো লিখতে মানা করেছেন !স্যার আমায় শুধরে দিলেন ।বললেন ,"লিখতে মানা করিনি ।ছাপতে মানা করেছি ।"কেন ?এইসব কৌতূহল তখন মাথায় নেই ।আমি তখন ভিতরভিতর ধেইধেই করছি ।পরের সপ্তাহেই এক গোছা লেখা নিয়ে হাজির ।স্যারের গলায় প্রশ্রয় ।বললেন ,"আরো  লেখ আরো পড় ।ছাপবার জন্য তোমার সারা জীবন পড়ে আছে ।"যে জীবন যাপনের কথা তিনি বললেন তা তাঁর ক্ষেত্রেই বড়ই বিচিত্র ।গ্রামবাংলার অগণিত বাউল ফকিরদের সঙ্গে বসবাস ,গবেষণা ।উপন্যাসের ধার দিয়ে না ঘেঁষে শুধু আখ্যানকে আধার বানিয়ে যুগনায়ক হয়ে ওঠা ।একদিন স্যারের স্ত্রীর কাছে পেলাম একটি সিডি ।স্যারের স্বকন্ঠে গাওয়া কয়েকটি বিরলতম গান ।কী তার আর্তি কী তার মূর্ছনা ।চুপিচুপি তুলে ফেললাম বাড়িতে বসে ।কিন্তু স্যারকে শোনাবার সাহস কে জোগায় ?সে সুযোগও মিলে গেল ।স্যারই একদিন বললেন ,"গানটা গেয়ে শোনাও দেখি ।"গান শুনে বললেন "বেশ হয়েছে ।তা তুমি ডাক্তারি করো কখন ?"ব্যাপারটা হয়েছে কি প্রথম প্রথম অনেক পত্রিকা আমার নামের আগে "ডাঃ" জুড়ে দিত ।এতে আমার বেশ আপত্তি ।আরো বিরক্তিকর কবিসভায় ডাক্তারি আলোচনা ।আমি এইসব বিপজ্জনক অঞ্চল এড়িয়ে যেতে শুরু করলাম ।রাণাঘাটে একটি কবিতাসভায়  ঘোষণা করা হল "এখন কবিতা পড়বেন বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ  ...."।কবিতা না পড়েই নেমে এলাম ।ভাবলাম কবিতা পড়বেন তো কবি ।তার সঙ্গে "বিশিষ্ট" "মনোরোগ বিশেষজ্ঞ" কেন বলা হবে ।বিশেষ না অবিশেষ তা তো পাঠক বিচার করবেন ।স্যারকে বলতে স্যার আমাকে শান্ত করলেন ।বললেন "তুমি একজন কবি ।তোমার এই দোলাচল মানায় না ।"একদিন অভিমান করে বললাম স্যারকে ,আসলে আমি সাহিত্যের ছাত্র নই তো ।সেইজন্য এতো অবহেলা ।আমি বাংলায় স্নাতকোত্তর হবো ।আমাকে অবাক করে দিয়ে স্যার আমাকে খোঁজ দিলেন কোথায় কোথায় পড়া যায় ।আর মুখে বললেন "তুমি একজন লেখক ।এটাই তোমার পরিচয় ।তুমি সাহিত্যের ছাত্র না বিজ্ঞানের ,তাতে কিছু যায় আসে না ।"এই রকম প্রশ্রয়ে একদিন আমি আমার লেখকসত্তা খুঁজে পেলাম ,আত্মবিশ্বাস এলো ।আর এলো এক অবাকআত্মীয়তার টান ।কৃষ্ঞনগরে গেলেই মনে হয় একবার দেউলে যাই ।সেই দেউলে আছেন আমার গোপিনাথ ।আমার শিক্ষক ।আমার স্যার ।অধ্যাপক ও বিশিষ্ট লোকগবেষক শ্রী সুধীর চক্রবর্তী ।

৬।বিন গুরু জ্ঞান মুকতি নাহি হোবে


আমার গান প্রশিক্ষণের অধ্যায়টি বেশ মজার ।মোট আধডজন সঙ্গীতবিদের কাছে ছোটবেলা থেকে আমার তালিম নেওয়াবার চেষ্টা করেছিলেন মা ।কেউ দু সপ্তাহ কেউ তিন হপ্তা টিকলেন ।আসলে সঙ্গীত সাধনার কঠোরতার সামনে এলেই আমি গুটিয়ে যেতাম ।এর চেয়ে গুণগুণ করা বেশ সহজ মনে হতো ।পরে যখন পিতৃত্ব ঘটলো ঠিক করলাম আমার জীবনের ভুল ছেলের ক্ষেত্রে ঘটতে দেব না ।আমার সহধর্মিনী একদিন অদিতিদির সন্ধান দিলেন ।ছেলেকে নিয়ে যেতাম ।ভাবলাম নিজে শিখলেই বা দোষ কোথায় ?কিন্তু ভিতরভিতর ছটফট ছটফট ।দিনরাত কোনো গান শুনলেই দিদিকে মেসেজ ।"দিদি ।এটা কোন রাগ ?ওটা কোন রাগ ?"বলামাত্রই উত্তর মিলতো ।কখনো ভীমপলশ্রী ।কখনো বা সিংহেন্দ্র মধ্যম ।অবাক হতাম ।বলতাম "দিদি আপনি ঈশ্বর "।দিদি মাথা নেড়ে বলতেন "না ।আমি তোদের গুরুমা "।বলতেন "একদিন তুইও পারবি ।শুধু একটু সময় দে আমায় "।এই সময়েরই তো বরাবর বড়ো অভাব আমার ।তাই মুখে হ্যাঁ বললেও ভেতরভেতর তড়বড় করছি ।ভাবটা এমন যেন আমার জীবনটা কালকেই শেষ হয়ে যাবে ।দিদি এতে বিচলিত হতেন না ।শুধু বলতেন "রেওয়াজ করে যাবি"।ছেলেও শিখছে ।আমিও শিখছি ।এমনই সময়ে একদিন দেখলাম মনে হলো এতদিন যা জানতাম ।সব ভুল ।এই তাড়াহুড়ো ইউ টিউব দেখে বন্দিশ তোলা ।বায়বীয় ।ভাবতে ভাবতেই মনে হল এবার গুরুমার দেখানো পথেই হাঁটবো ।তারপর মনে হলো গুরুমাকে আমার আরো আগে পাওয়া উচিত ছিল ।ভেতরের চঞ্চলতা শান্ত হয়ে এলে দিদি একদিন বললেন "এইবার সুরে নিজেকে বসাও।"যেন এক তপস্যা ।সাধনা ।তার সিদ্ধি সুরসপ্তকে ।সেই পথে আমরা সকলে হেঁটে চলেছি ।আমার গুরুমার নাম শিল্পী অদিতি ভট্টাচার্য ।

No comments:

Post a Comment

একনজরে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"ইস্কুল বলিতে আমরা যাহা বুঝি সে একটা শিক্ষা দিবার কল। মাস্টার এই কারখানার একটা অংশ। সাড়ে দশটার সময় ঘণ্টা বাজাইয়া কারখানা খোলে। ...