একটা সময় থাকে জীবনে যখন আতাফুলের গন্ধ ছেয়ে থাকে আনখশির। মাথা থেকে পা পর্যন্ত
টলমল করে এক অজানা পবিত্র বিষাদের ভারে। বিকেলের দিকে ধুলো ওড়ে। ঘাসের মধ্যে, মাটির
মধ্যে মুখ ডুবিয়ে কাঁদতে ইচ্ছ করে খুব। সেই প্রথম আমরা একটু একটু করে বুঝতে পারি আমরা
আসলে এক বেদনার সন্তান। পুরোপুরি যে বুঝেও
উঠতে পারি তাও নয়। একটা ইশারা নির্জ্ন পুকুরের কালো জলে ছোট্ট শরপুঁটির মত একবার লাফ
মেরে ডুবে যায় অন্ধকারে। জেমস জয়েসের ‘অ্যরাবি’ গল্পের সেই কিশোরের মত শুধু নির্জনের
দিকে চলে যেতে ইচ্ছে করে। কবিতার কামড়ের দাগ ধীরে ধীরে ফুটে উঠতে থাকে ঘাড়ে, বুকের
বাম পাশে।
আরও একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটে।
সবার জীবনেই ঘটে। বন্ধুর চোখে, কিছুটা অগ্রজের চোখে চোখ রেখে দেখতে ইচ্ছে করে কবিতা
কি তাকেও গিলে খেতে এসেছে! সেই চিহ্ন দেখতে পাওয়া মাত্র , সে বন্ধু। তাকে ঘুম থেকে
তুলে কবিতা শোনানো যায়। তাকে অকারণে টেনে নিয়ে যাওয়া যায় শহরতলীর সেই দিকে, যে দিকে
খুব কম মানুষের আনাগোনা।
আমারও এমন এক আতাফুলের গন্ধমাখা
পর্ব ছিল। কিন্তু সেই আতাফুলের গন্ধমাখা দিনের দিকে তাকিয়ে যে মানুষটিকে দেখতে পাই
তিনি সারা জীবনে একটাও কবিতা লেখেননি।
তিনি ছিলেন আমার শিক্ষক। যে
স্কুলে পড়তাম তিনি সেই প্রায়-প্রত্যন্ত গ্রামের একটি স্কুলের বাংলার শিক্ষক ছিলেন।
এবং সব থেকে শ্লাঘার বিষয়, তিনি ছিলেন আমার মায়ের বেড়ে ওঠা গ্রামের বাসিন্দা। জীবনের
সব থেকে বেশী ও গুরুত্বপূর্ণ সময়টুকু তিনি কাটিয়ে ছিলেন সেই গ্রামটিতেই। বাংলার মত উদাসীনতার হারামিপনা-মাখা ভাষার লেখক না হয়ে
তিনি যদি অন্য কোনও ভাষার লেখক হতেন, তা হলে এতদিনে নিশ্চয় তাঁর লেখা নিয়ে আরও অনেক
বেশী আলোচনা ও ‘কাজ’ হত। কিন্তু ভাষাটি যে বাংলা। ফলে প্রকৃত অর্থেই বিশ্বমানের আশ্চর্য
সব ছোট গল্প লেখবার পরেও তিনি বেশ কিছুটা উপেক্ষিতই রয়ে গেলেন। না, ভুল বললাম। উপেক্ষা
তো বাংলাবাজার করে না। যেটা করে সেটা হল এক নীরবতার সাধনা। তো সেই তন্ত্রসাধনা ফল দিয়েছে।
তাঁকে বেশ কিছুটা মুছে দেবার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। (দয়া করে কেউ এটা বলতে আসবেন না যে
লেখককে মুছে দেওয়া যায় না, তাঁর লেখাই তাঁর সব থেকে বড় প্রমাণ হয়ে থেকে যায়, ইত্যাদি
… ইত্যাদি। এ সব কথা অজস্রবার শুনে পাথর হয়ে গেছি। এই সাইলেন্স যে কী পরিমান ক্ষতি
করে দিতে পারে একটা সাহিত্যকে তার প্রমাণ এত বেশী চোখের সামনে যে সে সব দেখে এই জাতীয়
কথা শোনাও পাপ বলে মনে হয় আজকাল)।
যে
স্কুলে পড়তাম তার নাম রঘুদেবাটী সাধারণের বিদ্যালয়। হাওড়া জেলার দক্ষিন-পূর্ব
রেলের নলপুর নামে একটি স্টেশনে নেমে বেশ কিছুটা খোয়া বিছানো পথ পেরিয়ে যেতে হত
স্কুলে। স্কুলটি সর্ব অর্থেই সাধারণের। শুধু অসাধারণ ছিলেন বেশ কিছু মাস্টারমশাই।
তাঁদের মধ্যে এমন অনেকে ছিলেন যাঁরা বাংলা ও অঙ্ক একই দক্ষতায় পড়াতে পারতেন। ছিলেন
আমাদের প্রিয় শচীনবাবু। স্কুলে ভর্তি হয়ে প্রথম যে মানুষটিকে চেনা লেগেছিল তিনি ঐ
শচীনবাবুই। কারণ তিনি আমার মামার বাড়ির গ্রামের বাসিন্দা। তাঁকে তো সেই ছোটবেলা
থেকেই দেখেছি এক বিশাল পড়ন্ত জমিদারবাড়ির বারান্দায় বসে থাকতে। তিনি তো আমার কাছের
মানুষ। কিন্তু মুশকিল হল, তাঁকে আমরা পেতাম না নিচু ক্লাসে। তিনি উঁচু ক্লাসের
শিক্ষক। মানে ক্লাস নাইন থেকে টুয়েলভ পর্যন্ত দাদা-দিদিরা তাঁর ক্লাস পায় বেশী।
তাদের মুখে শুনতাম তাঁর আশ্চর্য ক্লাস নেবার কথা। টেক্সট পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে নেমে
আসত আশ্চর্য সব অনুসঙ্গ। একটু একটু করে শুনে ফেলছি, তিনি খুব বড় লেখক। ছাপার
অক্ষরে পত্রিকায়, খবরের কাগজে তাঁর লেখা বের হয়। হায় রে, তখনও কী জানতাম তিনি সত্যি সত্যিই কত বড় লেখক। তিনি
যেহেতু ছড়া লেখেননি বা ক্লাসে এসে নিজের লেখা নিয়ে একটাও কথা বলতেন না, তাই তখনও
তাঁর একটা লেখাও আমার পড়া হয়ে ওঠেনি।
২
বিজয়ার
প্রণাম করতে বহুবার গেছি তাঁর বাড়ি। ঘটা করে সেটাকে ‘যাওয়া’ বলারও কোনও মানে হয়
না। কারণ আমার মামার বাড়ি থেকে বেরিয়ে কিছুটা গিয়ে একটা গেট পেরুলেই তাঁর
বাসাবাড়ি। ঢুকে পড়লেই হল। কিন্তু লেখক শচীনবাবুর কাছে যাই অন্য এক মানুষের হাত
ধরে। তখন বাউড়িয়া থেকে প্রায় রোজই সাইকেলে সাত-আট কিলোমিটার পথ পেরিয়ে তাঁর কাছে
চলে যেতেন অমৃত সাহা। সঙ্গে গোপাল শর্মা, সোমনাথ ঘোষ সহ আরও অনেক কবি। হাওড়ার
বিভিন্ন জায়গা থেকে চলে আসতেন তরুন কবি-সাহিত্যিকেরা। না, কোনও টেলিফোন দেখিনি
তাঁর বাড়িতে। আসলে ঐ অঞ্চলে সেই সময়ে ফোনের সংযোগই ছিল না। ছিলেন তিনি। এবং তাঁর
কাছে বিনা টেলিফোনেই যাওয়া যেত।
অমৃতদা
তখন দু-হাত ভরে গল্প-কবিতা লিখছেন। বড় কাগজে সহ বিখ্যাত সব লিটল ম্যাগাজিনে তাঁর
লেখা দেখে বুক ভরে যাচ্ছে। চোখের সামনে জীবন্ত কবি-সাহিত্যিক দেখে বুক কেঁপে যাবার
একটা বয়স তো থাকেই।
সেই
অমৃতদার মুখেই রোজ শুনতাম শচীনবাবু কত বড় সাহিত্যিক, সেই কথা। যে গ্যালাক্সিতে
বিমল কর শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অভিজিৎ সেন-সহ আরও অনেকে সেই
গ্যালাক্সির সবাই চেনেন শচীনবাবুকে। শীর্ষেন্দু একবার এসেছিলেন তাঁর সেই
বাসাবাড়িতে। সেই অমৃতদাই আমাকে হাত ধরে প্রবেশ করিয়ে ছিলেন শচীনবাবুর লেখার মধ্যে।
একবার প্রবেশ করার পর আর বের হবার পথ নেই সেই সব লেখার ভেতর থেকে। কিন্তু নিজের
লেখা নিয়ে কী অসম্ভব নির্লিপ্তি দেখতাম তাঁর মধ্যে। মাত্র একবার ছাড়া তাঁকে আমি খাতা-পেন
নিয়ে লিখতেও দেখিনি। বিকেলবেলায় পাড়ার কয়েকজনকে নিয়ে তাস খেলতে বসতেন। কোনও কোনও দিন
দেখতাম চওড়া এক বারান্দায় বালিসে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে আছেন। বিকেলের হাওয়া খেলে যাচ্ছে
তাঁর চুলে। এত সুদর্শণ পুরুষও খুব কম দেখেছি আমি। সিগারেট খেতেন ঘনঘন। ট্রেন থেকে নেমে
স্কুলে যাবার সময় প্রায় রোজই দেখতাম পাউচ থেকে মশলা বের করে নিপুন আঙুলে লিফ পাকাতে
পাকাতে তিনি হাঁটছেন। যে সব মানুষকে চারপাশে ঘুরতে দেখতাম তাদের অনেকেই উঠে আসতেন তাঁর
গল্পে। চমকে যেতাম।
চমকে গেছিলাম সেদিনও। আমাদের
স্কুলে সরস্বতীপুজো হত। কিন্তু ছাত্রছাত্রিদের খাওয়ার পর্বটা কেন জানি না চালু ছিল
না। আমাদের স্কুল জীবন শেষের দিকে। ওনারও অবসর নেবার পালা দরজায় কড়া নাড়ছে তখন। শোনা
গেল এবার স্কুলে খাওয়ানো হবে। দেখেছি সকাল থেকে একটা হাই-বেঞ্চে বসে তদারকি করছেন গোটা
বিষয়টার। চমক সেখানে নয়, চমক ছিল তারও পরে। তার কিছুদিন পরেই ‘দেশ’ প্রকাশিত হয়েছিল
তাঁর একটি গল্প, ‘মৌলবাদীরা কোথায় থাকে’। স্মৃতি প্রতারণা না করলে গল্পের নাম এটাই
ছিল। আশ্চর্য হয়ে গেছিলাম পড়ে। কারণ গল্পের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে সেই পুজো। সেই অঞ্চল।
চেনাশোনা মানুষজন। আর মৌলবাদের শিকড়ের দিকে তাকিয়ে কেঁপে ওঠা এক লেখকের স্বত্তা।
চার-আনার লেখকদের মাথার চারদিকে আজ জ্যোর্তিবলয়। দেখি, আর হাসি পায়। কী যত্নে ইনি
মুকুট নামিয়ে রেখছিলেন। প্রথম গল্প প্রকাশের পর আলোড়ণ পড়ে গিয়েছিল। ঐ সময় কয়েকটি ছোটগল্প।
তারপর অনেক দিন আর লেখেননি। কয়েক বছর পর ফিরে এসে আবার একের পর এক ছোটগল্প। উপন্যাস
কয়েকটি। যে aura তৈরী হয়েছিল সেটা উনি অনায়াসে carry করতেই পারতেন। করেননি। আশ্চর্যভাবে
বেঁচেছেন। মনে পড়ে একবার সাহিত্যিক অমিতাভ সমাজপতি শবর রায় অমৃত সাহা সহ আরও অনেকে
ওনার বাড়িতে। সকাল থেকে আড্ডা জমে উঠেছে। লেখা নিয়ে গুরুগম্ভীর আলোচনা একদমই নেই সেখানে।
কী ছিল?
ছিল অমিতাভ সমাজপতির গান। শচীনকর্তার
গান উনি খুব ভালো গাইছিলেন সেদিন। মাস্টারমশাই শুনছেন। মাঝে মাঝে বলছেন মীরা রায়বর্মনের
কথা। কত প্রসঙ্গ। খাওয়াদাওয়া। বাঙালীর আশ্চর্য ও নিজস্ব বাঁচা। আর যখন লেখালিখি নিয়ে
কথা হত তখন সেই নক্ষত্রদের মাঝখানে আমি নীরব শ্রোতা। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কোনও
দিন ওনাকে ফিলসফি আওড়াতে দেখিনি। একবার একটা লেখা শুনে বললেন, সব আছে, লেখায় চিট-টা
কম। মানে কবিতার একটা লাইন থেকে যে স্বাভাবিকতায় পরের লাইনে চলে যাওয়া যায় সেখানে খামতি
আছে। পরে, অনেক পরে ভেবে দেখেছি এর থেকে সার্থক কথা খুব কমই হয়।
মাঝে মাঝে ভাবি, গ্রামের স্কুলে
পড়ানো আর এক প্রত্যন্ত গ্রামই কি তাঁর না-লেখার কারণ হয়ে গেল শেষ পর্যন্ত? চূড়ান্ত
উদাসীন একটা জীবন যাপন করতে দেখছি তাঁকে আমি। আবার ভাবি কি হবে এই
বাংলায় পাতার পর পাতা লিখে? তাঁর শতাধিক ছোটগল্পের থেকে মাত্র দশটির নাম উল্লেখ
করা যাক এবার - কৃষ্ণকীর্তন, পিঞ্জর, হাঁস মুরগীর প্রতিপালক, রাজার এঁটো, ছদ্মবেশী
বিধবা, বিয়ের আগের দিন, তৃতীয় মহাযুদ্ধ, শশাঙ্ক-বনমালা কথা, অন্ধকারে মেহগনি
বৃক্ষ, বিপন্ন পুতুল ...
এবার
নিশ্চয় পাঠকের বোঝার অসুবিধা হচ্ছে না সেই মাস্টারমশাইকে চিনতে। হ্যাঁ, তিনি রতন
ভট্টাচার্য। আমার মাস্টারমশাই শচীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য আসলে তিনিই। তিনি লেখায় রতন
ভট্টাচার্য। তিনি একদিন বৃষ্টির দুপুরে হঠাৎ আমাদের ক্লাসের ছেলেমেয়েদের গাইতে শিখিয়ে
ছিলেন রবি ঠাকুরের গান।
বহুবার
পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছি। আজ আর সেই সুযোগ নেই। পরম্পরা প্রকাশনের করা পঁচিশটি
গল্পের সংকলন ছাড়া মাথা খুঁড়লেও আর তার লেখা পড়াবার সুযোগ নেই এই প্রজন্মের পাঠকের
কাছে। একশোর ওপর অসামান্য ছোটগল্প হারিয়ে যাচ্ছে। মিলিয়ে যাচ্ছে কোনও এক অন্ধকারে।
হাহাকার করা ছাড়া আর কিছুই করা নেই।
কার কাছে ক্ষমা চাইব স্যার?
এই বাংলায় লিখতে গেলে ভীষণ ভয় করে আজকাল।
No comments:
Post a Comment