কবি পরিচিতি : মারিনা স্ভেতায়েভার কবির নাম ইংরেজি উচ্চারণ করলে হয়- Marina Ivanovna Tavetaeva. এটি মূল রুশ উচ্চারণের প্রায় কাছাকাছি। বাংলায় রুশ উচ্চারণ অনুসারে পদবির উচ্চারণ করলে সেটি বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে।
বাঙালি অনেক পাঠকের কাছে হয়তো মারিনা ইভানোভা স্ভেতায়েভার খুব একটা পরিচয় নেই তাছাড়া অন্যান্য বিদেশী কবি/ সাহিত্যিকদের মতো তাঁর কবিতার অনুবাদও বিশেষ নেই। হয়তো তাঁর রচনা তেমনভাবে অনুবাদকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন নি কারন হয়তো তাঁর রক্ষ ও অমসৃণ শৈলী।
মারিনা স্ভেতায়েভার শহর ছিল মস্কো। এটা যেন তাঁর শহর, একান্ত নিজের। এই শহর যেন তাকে কোন জাদু করেছিল। এই ভাললাগা ছিল তাঁর নিজস্ব ও ব্যাক্তিগত।
১৯১০ সালে তাঁর প্রথম বই 'ভিচেরনি আলবুম' (সন্ধ্যার অ্যালবাম) তাঁর প্রিয় শহর মস্কো থেকে প্রকাশিত হল। এই বইয়ের বেশির ভাগ লেখাই ছিল তাঁর পনেরো বৎসর বয়সের রছনা।এই বইতে ছিল তাঁর শৈশবের মুগ্ধতা, ছিল তাঁর ছোটো ছোটো ব্যাপারের স্বতঃস্ফূর্ততা আর ছিল অচিন্তনীয় এক আবেগের প্রকাশ।
এরপর ১৯১৫ সালে তিনি পিটারবুর্গে পাড়ি দিলেন। সেখানে মারিনা ইতিমধ্যে সেখানথেকে স্ভেতায়েভার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ 'বলশেভনি ফোনার' (জাদু লণ্ঠন) প্রকাশিত হয়েছে এবং পাঠক মহলে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। তারপর পিটারবুর্গের নামি পত্রিকা 'সিবির নিয়ে জাপিস্কি' (উত্তরের নোটে) তাঁর বেশ কিছু রচনাকে কেন্দ্রকরে কবিতা পাঠকদের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল।
তাঁর জীবনটি কেটেছিল নানান প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে। ১৯২২-এ মে মাসে মারিনা স্ভেতায়েভা মস্কো শহর ছাড়লেন এবং বার্লিনের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিলেন। দীর্ঘ ১৭ বছর পর তিনি মস্কোতে ফিরে এসেছিলেন কিন্তু মস্কো তাকে গ্রহন করে নি। ততদিনে রাশিয়ার বিখ্যাত কবিদের মধ্যে তিনি একজন। আখমাতোভা, মায়াকোভস্কি, ও অন্যান্য কবিদের সাথে তাঁর নাম ও সমান ভাবে উচ্চারিত হতে লাগলো। তথাপি তাঁর ব্যাক্তিগত জীবন সুখের ছিল না। বহুবার ধংসের মুখোমুখি হয়েছেন খুব দারিদ্রের মধ্যে জীবন অতিবাহিত করেছেন এতো প্রতিকূলতা সত্ত্বেও মারিনা স্ভেতায়েভার কোনোদিনই নিজেকে ভাগ্যের হাতে সঁপে দেন নি। অসহায়তায় , অক্ষম সমর্পণে ছিল তাঁর তীব্র অনীহা।এই সবের বিরুদ্ধে লড়াই ছিল তাঁর সৃষ্টির প্রেরনা। একটু শান্তির জন্য তিনি এদেশ থেকে ওদেশ ঘুরে বেরিয়েছেন। দুবেলা অন্ন্যের জন্য তিনি লড়াই করেছেন।হয়ত পুরোপুরি সফল হন নি। সেটা বড় কথা নয়। দুঃখভার সইবার শক্তি ছিল তাঁর অসীম।
১৯৪১ সালের ৬ই অগস্ট কামা নদীর তীরে এলাবুগা নামক একটি জীর্ণ , পোড়ো এক শহরে তিনি আত্মহত্যা করেন। ফাঁসের জন্য ব্যাবহার করেছিলেন শণের দড়ি।
১
পনেরো বছরে বয়সে সুর আর ধ্বনি ঝঙ্কার তোলে,
মনের গভীরে পনেরো বছর গেঁথে রাখা এই শব্দ,
কীসের জন্য বাড়ে বয়স, কেন বেড়ে উঠি আমি?
বাঁচতে চাই না, আমি স্তব্ধ হতে চাই।
সকাল থেকেই ভীষণ অগোছালো, কাল পর্যন্ত পালিয়ে ফিরেছি,
দারুণ শাসনে আর বেতের কৈশোরের সাথে দুষ্টুমিতেই ছিলাম আমি প্রাঞ্জল।
দূরের ঘণ্টা বসন্তের সুর তুলে আমায় বলেছে 'ছুটে যা রে মেয়ে, তুই ছুটে যা'।
দুষ্টুমি ভরা শব্দেরা দিলো তাতে সম্মতি।
প্রতিটি পা ফেলায় উঠেছিল ফুটে সেইসব কথা।
কী আছে সামনে? ব্যর্থতা? তবে কী তার ধর্ম?
ভুলের ভেতরে নাকি শাসনের ভেতরে?
চোখের জলে বিদায় দিয়েছি প্রিয় ছেলেবেলা
এভাবে বিদায় আমার প্রিয় পনেরো বছরে।।
ভ পিৎনাৎসাৎ লিয়েৎ , ১৯১১
২
মার্জনা করো আমায়, আমার পাহাড়েরা
মার্জনা করো আমায় আমার যত নদী
মার্জনা করো আমায় আমার ভরা ক্ষেত
মার্জনা করো আমায় আমার বুনোঘাস।।
সৈনিকের মা পরিয়ে দিয়েছে ক্রুশের হার,
মা চিরবিদায় নিয়েছে ছেলের কাছ থেকে
ভেঙ্গে যাওয়া এক কুঁড়ে আমি বার বার বলি -
মার্জনা করো আমায় যত নদী।
মই গোরি, ১৯১৮
৩
পার্নেসুস
পার্নেসুস নয়, সিনাই নয়
সে জেনো-শিবিরের মতো
এক সামান্য ছাউনি।
জোট বাঁধো সব!
চালাও এবার গুলি!
আমার চোখেই কেন
তবে, যদিও অক্টোবর
থাকা আর না থাকায়
তখন মে মাসে
পাহাড় স্বর্গ মনে হল?
৪
১৯১৬
তোমাকে কিছুতেই ফেলে যাবোনা
আমি যে কয়েদি,
তুমি আমার প্রহরী, তুমিই আমার বিধিলিপি,
আর যে এক আকাশ শূন্যতা!
দুজনে মিলেই কাঁধে তুলে নিয়েছি
সওয়ারী হওয়ার ফতোয়া জারি করেছে।
উথাল পাথাল মন একেবারে স্থির হয়ে যায়
চোখের ওপর থেকে সরে যায় সমস্ত পর্দা,
ও আমার প্রহরী, এইবেলা আমাকে যেতে দাও
পাইনের বলে একটু এলোমেলো ঘুরে আসি।
৫
সবকিছুই আড়াল করেছো, সূর্যালোক পর্যন্ত।
তীব্র রশ্মি, সমস্ত নক্ষত্রদের মুঠোতে ভোরে রেখেছো।
তবুও যদি একবার খুলে যায় দ্বারপথ,
বাতাসের মতো উড়ে তোমার কাছেই চলে আসতাম
তারপর, আদুরে শব্দে, লজ্জায় রাঙা হয়ে
চোখের লাজুক দৃষ্টি আড়াল করে
তোমার বুকে ঝঁপিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়তাম
ঠিক যেভাবে একটি শিশু ক্ষমা চায়।
৬
সত্যিটা আমিই জানি! অন্যান্য সত্যিগুলো - সরিয়ে নাও!
নিজেদের মধ্যে কারণ হীন যুদ্ধ, হানাহানির কোনো প্রয়োজন নেই।
একবার চোখ মেলে দেখো সন্ধ্যে হোলো,
দেখো রাতও নেমে আসছে।
কেন এই যুদ্ধ উত্তর দাও, হে প্রেমিক, কবি ও সৈনিক?
দেখো ঝড়ও থেমে গেছে এবং শিশিরে স্নাত ঘাস,
তারায় তারায় যুদ্ধও জেনো থামবেই।
এই মাটির নীচে শত্রু, মিত্র নির্বিশেষে একদিন শান্তিতে ঘুমোবো
আমরা, যারা এই মাটির ওপরেই একে অপরকে ঘুমোতে দিই নি।
৭
বিষাদ প্রতিমা তুমি, তোমার তুলনা তুমিই।
পাগলকরা উন্মাদ ছায়া মতো যে জ্যোৎস্না,
পাঠিয়েছো রুশ দেশময় তুষার কালো ঝড়,
আমাদের বিঁধেছে তীরের মতো, তোমার বেদনা।
আমরা ঘোড়া মতো লজ্জিত হই, আবার গিলেও ফেলি,
বহুবার উচ্চারিত তোমার অঙ্গীকারে - আহ্!
আখমাতোভার নাম, এক দীর্ঘশ্বাসের মতো।
যে নাম গভীরভাবে ঝরে পড়ছে, এক নামহীন হয়ে।
আমরা রাজভাষন শুনি, ভারি কুজকাওয়াজে,
একই তো পৃথিবী, একই আকাশ মাথার ওপরে।
এই অমোঘ মৃত্যু যন্ত্রণার ভার, যে বইতে পারে,
অমর সে অন্তিম শয্যায়। দেখো চোখ মেলে,
সমস্ত মিনার দাউ দাউ করে জ্বলছে।
আমার সেই পুরোনো সুরের শহরে।
অন্ধ ভিখিরি বিশ্বাস নিয়ে গেয়ে চলেছে ঈশ্বরের গান।
ঘন্টাধ্বনিতে ভরা আমার প্রাণের শহর তোমায় দিলাম।
আখমাতোভা - আমার এই হৃদয় তোমাকে দিলাম।
৮
একে অপরকে ছেড়ে আসার সময়ে কিসের এই অনিয়ন্ত্রিত আবেগ,
আমাদের দেখা হওয়ার সাথেই কেন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার তাড়া?
হাতের ওপরে মাথা ভর দিয়ে গভীর রাতের দিকে চেয়ে বুঝলাম যে,
যারা যারা আমাদের চিঠিগুলো পড়েছে, তারা এটা বুঝতে অপারগ,
আমরা কতখানি পরিপূর্ণ ভাবে এবং গভীরভাবে একে অপরের প্রতি অপবিত্র ছিলাম,
এটাও বোঝায় :আমরা কতখানি সৎও ছিলাম।
৯
আমার এই কবিতাগুলো, এতো আগে লেখা, যখন আমি নিজেই জানতাম না, আমি একজন কবি,
আমার কবিতারা একটা ফোয়ারা থেকে বেরিয়ে আসা বিন্দু বিন্দু জলকনা,রকেট থেকে বেড়িয়ে আসা স্ফুলিঙ্গ,
একটি শান্ত, সমাহিত সুগন্ধি দেশে, হঠাৎ জেগে ওঠা ছোট্ট ছোট্ট দানবের মতো।
আমার কবিতাগুলো, যৌবন এবং মৃত্যুর,
আমার কবিতারা আজও অপঠিত -
বইয়ের দোকান ধুলোর আস্তরণে ঢাকা থাকে।যেগুলো কখনো কেউ কেনে না।
আমার কবিতারা দামী মদের মতো, সঠিক সময়ের অপেক্ষায়।
১০
মিথ্যেই তুমি আমাকে হাসাও কবিতা
নানান প্রসাধনে তুমি নির্মাণ করো স্বপ্ন
আমাকে ক্লান্ত করে তোমার সাময়িকতা
যেমন মিথ্যে প্রশংসায় বিদ্ধ করো আমায়
কিন্তু তুমি নিজেকে বিশুদ্ধ করো
শতাব্দীর পর শতাব্দীর আলোয়
এবং তুমি সেই ছোট্ট বালিকার মত
যে কিনা সবার প্রিয়।
আমাকে হাসায় মিথ্যে আলোকচ্ছ্বটা
যা আমার কাছে শুধুই বর্ণহীন
তোমার বুদ্বুদেরা ফেরেনা তোমার কাছে
কবিতা, তবুও শুধু তুমিই স্বর্গীয় কেবল।।
No comments:
Post a Comment