Friday, September 14, 2018

পথের দেবতা --পম্পা দেব






"  You enter it by the Ancient way
Through Ivory Gate and Golden "

সেই কৈশোরে তার সাথে দেখা হওয়া বিভূতিভূষণ
বন্দোপাধ্যায়ের 'পথের পাঁচালী 'তে। একই সাথে ট্রিলজি। শেষ উপন্যাসটা অবশ্য তাঁরই পুত্র সাহিত্যিক শ্রীতারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের । সেই অপূর্ব কুমার রায়ের একটা ছবি ভেসে থাকা মন। অপুর ছবি। সাহিত্য পড়ে যে কল্পনার জন্ম হল মন তোলপাড় করে , পরবর্তীতে সিনেমাটা যখন দেখা গেল , তখন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মুখচ্ছবি এসে বসল সেই সাহিত্যের অপুর  মনস্তত্ত্বে । একদিন খবরের কাগজে সেই ছবিটা । অপুর সংসারের অপুর ছবি। মুখ ভর্তি সদ্য গজানো দাড়ি। গায়ে চাদর জড়ানো। হাতে একটা কাপড়ের ঝোলা গোছের। চোখের সেই সুদূর প্রসারিত দৃষ্টি । বিষন্ন,  দুখী । তাহলে এই বিষন্ন,  দুখী মানুষটাই চিন্তা চেতনা র জাগ্রত দেবতা হয়ে উঠলেন। কী আশ্চর্য । কী সেই তরঙ্গ । কোন সুদূরের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে সেই চরিত্রটি পথের পাশে আড়াল হয়ে থাকলেন। 

একইসাথে রোমান্টিক, কিন্তু দুখী । বিষন্ন অথচ আনন্দময়। অনুভব করা যায়। একলা একলা পথ চলতে গিয়ে তাকে পিছু ফিরে ফিরে দেখতে পাওয়া যায় । আসলে সে তো তখন অস্তিত্বের নামান্তর  হয়ে উঠছে অজান্তে , অবচেতনে, দারুণ অবগাহনে।
জন্মগত কারণে যা অর্জিত পরিবার ও প্রকৃতি থেকে, তার ভেতর দিয়ে যেতে যেতে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা বিষন্ন গানওয়ালা, হজমি আচার বিক্রেতার অলস মধ্যাহ্ন,  গোধূলি আলোয় খেলা শেষের একলা মাঠ , নির্জন টিউবওয়েল, ঝাঁক ঝাঁক বনটিয়া , গঙ্গার ওপারে ঝাপসা হাওড়া ব্রিজের ওপর বিন্দু বিন্দু আলোর চলাফেরা, নভেম্বরের রাতে আকাশ প্রদীপ, পূর্বজন্মের মতো নেমে আসা একটা আস্ত শৈশব, যার সামনে চোখ বুজলে ভেসে আসে কুমিল্লা আর ফরিদপুরের গাছগাছালি পাখপাখালির গান, সার সার আমবাগান, হারাণ মাঝির দরিয়ার চরে অলৌকিক জ্যোৎস্নার ভেতর রাত্রি যাপন, তার নাকি মাথা খারাপ হয়ে গেল সেবার। এইসব তখন প্রায়ই শুনেছি দিদিমার মুখে , যিনি ছিলেন বড়িশালের বিখ্যাত অশ্বিনী কুমার দত্তের পরিবারের একজন উত্তরসূরী । কখনও বাবার কাছে তাঁর দেশের বাড়ির গল্প । তাঁর খুব ছোটোবেলাকার কুমিল্লার আকাশ বাতাসের কথা।

এইসবের মধ্যে কোথা থেকে একটা নিরবিচ্ছিন্ন পাঠ থেকে নিশ্চিন্দিপুরের পথঘাট, নীল অপরাজিতার ঝোপ, বনকলমী , তেড়ো পাখি, প্রসন্ন গুরুমহাশয়ের পাঠশালা, মনসাপোতা এইসব কিছু ছাড়িয়ে তার সাথে দেখা হচ্ছে লীলার, কলকাতার রাস্তা, ট্রামের ঘন্টি, কলেজস্ট্রিট ফুটপাথ, আর বুকের ভেতর বয়ে বেড়াচ্ছে মাস্তুলের স্বপ্ন । উপন্যাসের স্বপ্ন । দারিদ্র্য, দুঃখ, কষ্ট, প্রিয়জনের মৃত্যু, এই সব কিছু ছাপিয়ে ক্রমশ বড় হয়ে উঠছে তার জীবনের জন্য বাঁচার আনন্দ। হয়ত জন্ম জন্ম আয়ু নিয়ে এই বিশ্ব এমনকী গ্রহ, নক্ষত্রলোকের মধ্যে অন্য এক গ্যালাক্সির অন্বেষণে।  কৈশোরের ঐ একটা উপন্যাস, তারপর চলচ্চিত্রের অপুকে দেখে কোথাও মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল অপু আর আমার জীবন। সে যেন অদৃশ্য বন্ধু হয়ে উঠল। অনুভূত হচ্ছে   চারপাশের সবকিছু থেকে অনেক কিছু গ্রহণ করতে পারার অনাবিল আনন্দ । অনুভূতির তীক্ষ্ণতা দিয়ে সবকিছু চেতনাতে ধারণ করার  সক্ষমতা ।  ঝড়ের ভেতর , বৃষ্টির ভেতর,  অচেনা ফুলের গন্ধে, বুনো ঝোপের তিক্ত গন্ধের ভেতর ,  চিনতে পারা  গাছেদের ডাক নাম । পাখসাট । এক জীবনসাধক, তপস্বী, ঝড়ের ভেতর, স্রোতের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হতে হতে জীবনের এক অনুপম অনুসন্ধান করে যাওয়া এক চিরবালক । চিররহস্য। যা ব্যক্তিগত পরিসরে নাড়া দিয়ে গেছে  কৈশোর কাল। এ এক আশ্চর্য অনুভব আর উপলব্ধি । যার অমিত উল্লাস  , সৌমদিপ্তী , নির্জন নিভৃতি জীবনের অবিচ্ছেদ্য ছায়াসঙ্গী হয়ে পায়ে হাঁটা পথের আড়ালের এক দ্বৈতস্বত্ত্বা হয়ে উঠল।

পরবর্তীতে আমার গুরুজী শ্রীব্রাত্য বসুর নির্দেশিত ,তাঁরই নাট্য 'বোমা ' তে একটি ছোট্ট চরিত্রে অভিনয়ের সৌজন্যে  আলোকপ্রাপ্ত হওয়া । ঋষি অরবিন্দ ঘোষের শিষ্যার  চরিত্রের ভেতর  আশ্চর্য এক অনুভূতির সম্মুখীন হওয়ার অপূর্ব অপার্থিব আনন্দ  । তারা ভরা আকাশের নীচে এক শান্ত আশ্রম। নিকটেই সমুদ্র । কোথাও কোনো হিংসা নেই, ঈর্ষা নেই, কলহ নেই, কদর্যতা নেই , কেবলই ঈশ্বরের আরাধনা । ঈশ্বর অর্থাত সত্য। সত্যনিষ্ঠ একাগ্রতার অন্বেষণের নিরন্তর সাধনা । অনুভবে এক প্রশান্তি লাভ করা ছাড়া আর কীই বা । ছায়ায় মায়ায় ভরিয়ে দেওয়া আজন্মকাল, জন্ম জন্ম সোনাঝুরি ।

No comments:

Post a Comment

একনজরে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"ইস্কুল বলিতে আমরা যাহা বুঝি সে একটা শিক্ষা দিবার কল। মাস্টার এই কারখানার একটা অংশ। সাড়ে দশটার সময় ঘণ্টা বাজাইয়া কারখানা খোলে। ...