Friday, September 14, 2018

আমার শিক্ষক -- অ্যালবার্ট অশোক





একজন মানুষকে জীবনে নানা বিষয়ে ধাতস্থ হতে হয়, তার শরীর সম্পর্কে, অন্য মানুষের সম্পর্কে, তার পরিবেশ সম্পর্কে, তার নিজের মনের সম্পর্কে ইত্যাদি অনেক কিছুর সম্পর্কেই তাকে সঠিক প্রতিক্রিয়ার জন্য শিক্ষিত হতে হয়। স্কুল কলেজের পড়াশুনা, নিঃসন্দেহে একটা প্রাথমিক জ্ঞান দেয়, কিন্তু সেটা সম্পূর্ণ জ্ঞানের একটা ছোট্ট অংশ।মা- বাবা, পাড়া- পড়শী কিছু শেখায়, বন্ধুরা কিছু শেখায়, মানুষ যেখানেই যায় সেখান থেকেই কিছু শেখে, স্কুলে  যায়, কলেজে যায়, অফিসে যায়, ভ্রমনে যায়, সব জায়গা থেকেই সে আঁজলা ভরে, তার প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে। এই নিরিখে, শিক্ষক একজন নয়, অনেক। যদি বাস্তবিক একজনকে ধরা হয়, শিক্ষক হিসাবে তাহলে মিথ্যা বলা হবে।জীবন একটা বিষয়ের উপর নির্ভরশীল নয়।

আমি স্কুলের গন্ডী ডিঙ্গোতে পারিনি। তবু শিক্ষা জগতে এসেছি, সাংস্কৃতিক কর্ম কান্ড নিয়ে কাজ করি। লিখেছি প্রায় শ’ খানেক বই, প্রচুর প্রবন্ধ, এঁকেছি প্রচুর ছবি। পেয়েছি আন্তর্জাতিক সম্মান, ঘুরেছি ভারতের নানা রাজ্য প্রদর্শনী করে। দৈনিক পত্র পত্রিকা থেকে সমসাময়িক নানা খবর মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছি। সংগঠিত করেছি অনেক সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড। এই যে, আমি এত করেছি। নানা ধরণের কাজ- প্রতিটী কাজের পিছনে আমার একজন দৃশ্যগত বা অদৃশ্যগত শিক্ষাদাতা ছিল।না হলে এত কাজ করতে পারতামনা। আমার মত অনেক বন্ধুই ছিল, কই তারাতো আমার মত হতে পারেনি। সম্ভবত, তারা ঐরকম শিক্ষকের মূল্যবোধে, বা কাজের গুরু হিসাবে কাউকে দেখে নিজের মনে আলোড়িত হতে পারেনি।মানুষের মনে আলোড়ন না জাগলে সে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেনা, বা করতে শেখেনা কেউ সরাসরি কাউকে গুরু হিসাবে মেনে বিশেষ কোন কাজ শেখে, কেউ কাউকে আদর্শ মনে করে তার মত হতে চায়, এই দুটি জায়গাতেই মানুষ তার স্বাভাবিক সত্ত্বাকে, গতিকে ইচ্ছা করে পালটায়। এই পাল্টানোর জন্য একজন শিক্ষকের দরকার, শিক্ষার দরকার। লিখিতভাবে নয়, আমি কাউকে আদর্শ মনে করেছি, ও তাকে অনুসরন করেছি। তাকে আমার শিক্ষক মনে করেছি। তিনি না থাকলে আমি হয়ত সেই কাজটিই করতামনা। কাজটির প্রতি আগ্রহই জন্মাতনা। তাকে আমি ভুলিনা, সদা মনে রাখি।তিনি সদা শ্রদ্ধেয়।

আমি অতি দরিদ্রঘরে জন্মেছি। এমন পরিবেশে জন্মেছি, লোকে বলে ব্যাকোয়ার্ড ক্লাশ backward class, অনুন্নত শ্রেণী। অশিক্ষা আর কুসংস্কার ঘেরা অন্ধকারে।আমার বাবা তৃতীয় শ্রেণী অব্দি পড়াশুনা করেছিল।তার পিতৃবিয়োগ হওয়ার জন্য, ঐ ছোট বয়সে, সে আর পড়াশুনায় মন রাখতে পারেনি। পেটের দায় তাকে অর্থ রোজগারে পথে টেনে নিয়ে গেছিল। আমার কাছে পরিষ্কার ছিলনা, কি করে আমার বাবা আর্থিক দৈন্যতায় ডুবে গেছিল। কারণ আমার ঠাকুরদাদা, বাবার বাবা, একজন বিশাল ডাক্তার ছিলেন, আমরা তার নামাঙ্কিত ব্রিটিশদের পদক দেখেছিলাম, আর ইটের মত ওজন বিশাল বিশাল ইংরেজি বইয়ের ভান্ডার দেখেছি। বাবা সেগুলিকে আগলে রাখতেন।বড় একটা শোকেসে।টিনের বাক্সে। আর তখনকার দিনে প্রাচীনরা বাবাকে ডাকতেন, ‘ও ডাক্তারের পুত’। সম্ভবতঃ আমার ঠাকুরদাদু যখন মারা যায় তার বয়স ছিল ৩০ থেকে ৩৫ এর মধ্যে। অর্থকড়ি কিছু তেমন রেখে যায়নি।আমি ঠাকুর দা’র এই বিশাল ‘ডাক্তার’ প্রশংসা শুনে, অনুপ্রাণিত হতাম, ডাক্তার হব, বাঞ্ছা ছিল। বাবা বলত, পড়াশুনা কর, আমার যা আছে তা বিক্রীবাটা করে তোদের পড়াব, ডাক্তার বানাব।আমরা লুকিয়ে ঠাকুর দাদুর সেই বিশাল বিশাল বই, দুহাতে আলগি দিতে পারতামনা। ভেতরের ছবি, মানব দেহের গঠন ও কঙ্কাল এবং নারী শরীরের ভেতর বাচ্চা- এসব ছবি দেখে উত্তেজিত হতাম। সারা শরীর শিরশির করে ভরে যেত। এই অদৃশ্য মানুষটার প্রভাব, আমার জীবনে প্রথম বড় হবার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল।উচ্চাশা যোগাবার আমার প্রথম শিক্ষক। আমাকে মানুষ হতে হবে, ডাক্তার হতে হবে, বা বড় কিছু হতে হবে।

প্রথম হাতে কলম ধরিয়েছিলেন বাবাই। আমি আবার ভাগ্যহীন। আমার মাতৃবিয়োগ হয় আমার জন্ম বছরেই। ঘরে সৎমা। তার কোন দোষ ছিলনা, কিন্তু আমি তাকে গ্রহন করতে পারতামনা।তাই ঘরে আমার সুখ ছিলনা। ফলে বাবাই আমাদের যোগবিয়োগ, ঈশপের গল্পের মতন নীতি গল্প বলতেন, আমাদের চালাক বানাবার জন্য। বাবার গল্পে দেখেছি কতগল্পে শেয়াল চালাক, অনেক পশুপাখীর চেয়ে। ঠাকুরমা শোনাতেন রামায়ন মহাভারতের গল্প। আর আমাদের বাড়ির বেড়ার লাগোয়া উত্তরের বাড়িটায় থাকত অমরেশ, বয়সে সে আমার চেয়ে কয়েক বছরের বড় ছিল। অমরেশরা সাত ভাইবোন। সে ছিল সবার ছোট। তার বড় দাদার একটা ছেলে ছিল আমার বয়সী। অমরেশ রা আমাদের চেয়ে অনেক স্বচ্ছল, প্রাচুর্যতা পূর্ণ।গাড়ি বাড়ি দোকান ইত্যাদি ছিল। অমরেশের দাদা বা দিদিরা অমরেশকে নানা উপহার দিত। রংতুলি এনে দিত খেলতে।অমরেশ সেই রংতুলি দিয়ে বড় বড় কাগজে ছবি আঁকত আর তাদের ঘরের দেয়ালে বাঁধিয়ে ঝুলিয়ে রাখত। তখন আমরা নিতান্তই ছোট। আমার প্রথম শ্রেণিতে পড়া। পড়াশুনা আমার মাথায় ঢুকতনা।কেউ কিছু বুঝিয়ে দিলে বুঝতাম। মাথা থেকে উদ্ভাবনী কিছু ছিলনা। আমি অমরেশকে আমার গুরু মানতাম। সে কি করে রঙ তুলি দিয়ে নাড়ুগোপাল, ওই ক্যালেন্ডার দেখে দেখে বানায়। আমার কাছে তাজ্জব হবার মত ঘটনা। স্কুলে যেতাম, পিছনের বেঞ্চে শিক্ষকরা আসেনা, ছাত্রদের জিজ্ঞেস করেনা পড়া। সেখানেই আমার স্বচ্ছন্দ। স্কুল থেকে ফিরতাম। আর এবাড়ি ওবাড়ির আনাচে কানাচে ঘুরে সময়পাত করতাম। অমরেশ বাড়ি থাকলে, ওর বাড়ির লোকেরা আমাকে পছন্দ করতনা, সারাদিন ঘুর ঘুর করি বলে। আমি তাই বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখতাম ঘরে কে আছে। একদিন দেখি, অমরেশ একটা ক্যালেন্ডারের উপর ছাপ দিয়ে, নকল করে ছবি আঁকছে। দরজা বন্ধ। আমি গিয়ে কড়া নাড়তেই সে দরজা খুলে দিল। তখন আবার যথাযথ আমাকে দেখেই বোধ করি, ক্যালেন্ডারের ছবিটা সামনে রেখে রঙ দিতে লাগল। আমি বললাম, তুই কি করে আঁকিস? সে বলল, দেখছিস তো, আমি দেখে দেখে আঁকি। তারপর রঙ লাগাই। তো আমি তার কাছ থেকে কি করে দেখে দেখে ছবি আঁকে, তার প্রথম পাঠ নিলাম। বাড়িতে এসে আমিও পেন্সিল দিয়ে শুরু করলাম আঁকা। আঁকা আমার নেশা হয়ে গেল। অমরেশ, অনেক কিছু বানাতে পারত। মেলা থেকে ছোট ছোট পোড়া মাটির মুর্তি- গরু ছাগল, মানুষ, খেলনা বাটির মত তার দাদা দিদিরা কিনে দিত আর সেগুলির মত এঁটেল মাটি পুকুর থেকে তুলে বানাত। ষাঁড় বানানো থেকে নরনারীর যৌনাংগ আমরা লুকিয়ে লুকিয়ে বানাতাম রোদে শুকাতে দিতাম। নরনারীর যৌনাঙ্গ বানানোয় একটা আলাদা রোমাঞ্চ শিহরণ খেলত। বড়রা দেখলে নির্ঘাত মারবে। অন্তত কান টেনে লাল করে ফেলবে। কান জ্বালা করতে থাকবে গরম হয়ে।

একদিন, আমি তখন ফাইভে পড়ি, পড়াশুনায় ৩০ শতাংশ বা তার ন্যূনতম কিছু বেশী পেয়ে উপরের ক্লাশে উঠছি। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি। অলিভ কালারের প্যান্ট আর গোলাপী শার্ট।নেতাজী স্কুলের (নেতাজি সুভাষ বিদ্যানিকেতন, আগরতলা)ছাত্র, সবাই বলত ত্রিপুরার সেরা স্কুল। বুঝি না বুঝি, একটা অহংকার ছিল। অমরেশ পরীক্ষায় ফেল করত। তারও পড়া মাথায় ঢুকেনা।পড়া ছাড়া অন্য সব ব্যাপারে মাস্টার। রবিবার শনিবারে সে এন সি সি N C C করে। একটা খাকী রংগের ড্রেস, জামাতে আস্তিনে কি সব থাকত।সাদা সাদা বিল্লা। আবার পিতলের তারকাও মিলিটারিদের মত থাকত। বুক পকেটে থাকত হুইসেল, একটা দড়ি দিয়ে বাঁধা। স্কুলের মাঠে প্যারেড করত। এন সি সি র জন্য, পরীক্ষায় ফেল হলেও তাকে পাশ করিয়ে দেওয়া হত। তার ঐ নেতাজির মত মিলিটারির ড্রেস দেখে আমার ভাল লাগত।আরো ভাল লাগত, প্যারেডের পর তারা অনেক মিষ্টি খেত, রিফ্রেশমেন্ট হিসাবে। সেটা এন সি সি র টাকায়। মানে বিনা পয়সায়! আমার অমরেশের এন সি সির গল্প শুনে লোভ লাগত। আমি এন সি সি করলে আমিও মিস্টি খেতে পারব বিনা পয়সায়। আমি ক্যালেন্ডারে নেতাজীর মিলিটারির ড্রেস দেখেছিলাম। বড়রা বলেছিল নেতাজি আর মহাত্মা গান্ধী – এরা বড় বিপ্লবী। বিপ্লব কি জিনিস দেখিনি। কিন্তু বিপ্লব – শব্দটা শুনলে কিছু রোমাঞ্চ আর পুলক শির শির করে সারা শরীরে বইত। একদিন অমরেশ বলল, এন সি সি তে নাম লেখাবি, মিস্টি খেতে পারবি, আর রাইফেল শুটিং করতে পারবি। ওমা! রাইফেল! অমরেশ কি সুন্দর কত রাইফেল শুটিংয়ের গল্প করে। টু পয়েন্ট টু, থ্রি নট থ্রি, কোন রাইফেল পিছনে কাঁধে ধাক্কা মারে, টাইট করে ধরে রাখতে হয়। আমি এসব গল্প শুনে অভিভূত হতাম। আমি অমরেশের প্রস্তাবে লাফিয়ে উঠলাম। আমি এন সি সি তে নাম লেখালাম, আর প্রত্যেক শিনিবার বিকালে, আর রবিবার সকালে খাকী ড্রেস পরতাম, মাথায় টুপিতে পিতলের অশোক স্তম্ভ লাগানো। বীরের মত হাত পা মিলিটারিদের মত ছুঁড়ে লেফট- রাইট, লেফট- রাইট করতাম। আর মিস্টি খেতাম। একবছর পর সার্জেন্ট হলাম, মিলিটারির ক্যাম্প ছিল কলেজ টিলাতে (আগরতলাতে) সেখানে এক উপত্যকার মত চারিদিকে পাহাড় ঘেরা ঢালু জমিতে উপুর হয়ে শুয়ে কনুইয়ে ভর দিয়ে পঞ্চাশ গজ দূর টার্গেটে থ্রি নট থ্রি রাইফেল চালাতাম।

একদিন সকালে, অমরেশ, জিমনাস্টিক দেখাচ্ছে। বাড়ির সামনেই। কিছু ছুটে এসে হাতে মাটি পুশ push করে স্প্রিং spring করল। কার্ট হুইল  cartwheel করল। তার লাফানো দেখে আমি অভিভূত। সে আমাকে গেদুমিঞার বাড়িতে বিকালে নিয়ে গেল। আগরতলার এই জিমনাস্টিক স্কুলটার বেশ নাম ছিল।(১৯৭২-৭৩ র কথা বলছি) দলীপ সিং বলে একজন কোচ ছিলেন যিনি পুরো জিমনাস্টিক gymnastic স্কুলটির দায়িত্বে ছিলেন। মন্টু দেবনাথ বলে একটি নামী জিমনাস্ট ছিল। সে অনেক পুরষ্কার পেয়েছিল।রাশিয়ায় নাকি গিয়েছিল। সে অনেক টাকাও পায় জিমনাস্টিক করত বলে।লোপামুদ্রা ঘোষ বলে একটা মেয়েও ভাল ফ্লোর এক্সারসাইজ floor exercise করত সিঙ্গলবার single bar আর বিমের beam balance উপর তার জিমনাস্টিক অসাধারণ ছিল। মেয়েটাকে আমার ভীষন ভাল লাগত।আমি তার সারা শরীর স্তন, পেট কোমর দেখে রোমাঞ্চিত হতাম।তাকে সবাই, ( ছেলেরা) এল এম জি বলে ডাকত। আর কি হাসি! অমরেশ আমাকে নিয়ে গিয়ে সেখানে ভর্তি করে দিয়েছিল। কিন্তু নিজে আর গেলনা। কেননা, পারেনা বলে একদিন স্যার তাকে জুতো নিয়ে তাড়া করেছিল।হ্যা, তখনকার দিনে স্যারেরা খুব মারত। আমাকে রাধারমন বলে একজন স্যার শেখাতেন, আমি তার মার খেয়েছি, কিন্তু আমার অগ্রগতি দেখে স্যারটি আমাকে অনেক ভালবাসতেন। একদিন বড়দের গ্রুপে ঢুকিয়ে দিলেন। আমি বললাম, ‘স্যার, ওদের সাথে আমি পারবনা।‘ তাতে রাধারমন রাগ করে বললেন, ‘গাধা গরুর আগে থাকলেও গাধা গরু হয়ে থাকবে। আর ভালদের সাথে পিছনে থাকলেও ভাল বলেই থাকবি’। স্যারের এই কথাটার মানে সেদিন আমি ঠিক বুঝিনি কিন্তু পরবর্তী জীবনে এই কথাটার গুরুত্ব বুঝেছিলাম।তিনি আমার জীবনে মস্তবড় একটা সূত্র দিয়েছিলেন। অমরেশ আমাকে অনেক ভাল জিনিসের শুরু করে দিয়েছিল। আমি তা চর্চা করে গেছি শেষ পর্যন্ত। ও উল্লেখযোগ্য ফল পেয়েছি। কিন্তু অমরেশ কোনটাই শেষ করতে পারেনি। তার চোখ ছিল প্রগতির দিকে, সে বুদ্ধিমান, সংসারের অনেক কিছুই নজরে আনে। নজরে রাখত। কিন্তু কোনটাতে সার্থক হয়নি। তার ছবি আঁকার ইচ্ছা ঘুচে গেছিল, পরবর্তী অন্যকোন অধিক আকর্ষনে।একটা ছেড়ে আরেকটা ধরে।পড়াশুনা ভাল লাগতনা, সম্ভবত মাথায় ঢুকতনা, আমার মতো তাই সিক্সের পর আর পড়েনি। ওর বাড়িতে, পরিবারের লোকেরা বলেছে, ওর মাথায় ঢুকেনা, কেন পড়বে। পড়াশুনা না করলে লোক বাঁচেনা? ওদের বড় কাঠের দোকান আছে। দোকান চালাবে। আমি অধিক কৌতূহলে যেটাই ধরেছি, চালিয়ে গেছি। ছবি আঁকা আজও চালাচ্ছি। অমরেশ আমার শৈশবের শিক্ষক বা গুরু। আমার বাবা, এই ছবি আঁকা, এন সি সি করা, জিমনাস্টিক করা পছন্দ করতেননা। বলতেন পড়া কর, এগুলি করলে ভাত খেতে পাবিনা। বাবা হয়ত সত্যি কিছু বলতে চেয়েছিলেন, আমি নিতে পারিনি। আজও আমার প্রতিদিনের অন্ন সংকট হয়। পকেটে পয়সা থাকেনা শষ্যদানা কেনার।পড়াশুনা করলে হয়ত এই দুরাবস্থা আমার ঘটতনা

আমি তখন পঞ্চম শ্রেণিতে। লক্ষ্য করতাম ক্লাশের প্রথম বেঞ্চিতে বসা চারটে ছেলেকে ক্লাশের সব স্যারেরা ভালবাসে। আর তারাও কি সব বলে, স্যারেরা খুশী। ওদের কাছে নানা বই থাকত। বড় লোকের ছেলে। দেখতে বেশ সুন্দর ও স্মার্ট লাগত।তাদের শান্তনু নামে একটি ছেলে ছিল, সে ক্লাশের মনে হয় ফার্স্ট বয় ছিল।একদিন ইয়া এক বড় রঙিন বই সে স্যারকে দেখাল, স্যার খুব খুশী হয়ে তার পিঠ চাপড়ে আদর করে দিল।কত মিষ্টি মিষ্টি কথা বলল। ওরকম মিষ্টি কথা স্যারেরা আমাকে কোন দিন বলেনি। আমি পিছনের বেঞ্চিতে বসে সব দেখছি। পড়া মাথায় না ঢুকলেও, কেউ কিছু করলে সেদিকে নজর যায়। প্রতিদিন দেখতাম, স্যার ওদের আদর করছে। আমার অন্তর জ্বলে যেত, এই আদর দেখলে। আমার বন্ধুদের মায়েরা, যখন আমার বন্ধুদের আদর করত আমি মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকতাম। আমাকে আদর করার কেউ নেই। স্কুলেও নেই। শান্তুনুকে স্যার দিদিমনিরা এত ভালবাসে, সে বড়লোকের ছেলে বলে?আদর খাওয়ার যোগ্যতা লাভ করতে হয়। আমার মন আমাকে বলে দিল। তুমিও আদর খাওয়ার যোগ্য হও। আদর পাওয়ার লোভে আমি লেইজার পিরিয়ডে আদর পাওয়ার গুপ্ত রহস্য জানার জন্য শান্তুনুকে জিজ্ঞেস করলাম, এই বড় বইটা স্কুলের পাঠ্য বই? আমার বাবা আমাকে কিনে দেয়নি। কি নাম বইটার, আমি বাবাকে বলব কিনে দিতে। আমার বাবার পয়সা নেই স্কুলের পাঠ্য বইও সব কিনে দেয়না। বলে সব বই কিনতে হয়না। কিছু বই বন্ধুদের কাছ থেকে দেখে পড়ে নিতে হয়।আর আমরা কখনো নতুন বই পেতামনা। বাবা খোঁজ করে আমাদের উঁচু ক্লাশে যে ছেলেটি উঠে গেছে তার পুরাণো বই কিনে দিত। বাবা বুঝতনা, নতুন সংস্করনের বইয়ে পুরানো অনেক কিছু পালটে গেছে। এমন বাবা আমাকে আর কোন বই বছরের মাঝে কিনে দেবেনা, জানি। তবু জিজ্ঞেস করা, যদি কোন ক্লু clue পাওয়া যায়।শান্তুনু হাসতে হাসতে বলল, ‘আরে বোকা!এটা আমি লাইব্রেরি থেকে এনেছি।লাইব্রেরিতে অনেক বই। তুই লেন্ডিং কার্ড Lending card কর তুইও বই পড়তে পারবি অনেক। গল্পটা স্যারকে বললাম স্যারের ভাল লেগেছে।’ আমি শান্তুনুর ব্যাগ থেকে নিয়ে বইটা দেখলাম। ইংরেজি বই। আমিতো ইংরেজি বুঝবনা।বাংলাই বুঝিনা সঠিক বলতে গেলে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুই ইংরেজি লেখা পড়তে পারিস? সে হাসতে হাসতে বলল, ‘না ডিকশানারি Dictionary দেখে নিই।’ জিজ্ঞেস করলাম ‘ডিকশনারি’ কি জিনিস। সে বলল, অভিধান। আমার মাথায় সেদিন ঢোকেনি অভিধান বা ডিকশনারি কি জিনিস। আমি শান্তুনুকে বললাম, তুই আমাকে জিনিসটা এনে দেখাস। সে বলল, ‘আরে ডিকশনারিও একটা বই। তাতে সকল ইংরেজি শব্দ বাংলায় লেখা থাকে। পকেট ডিকশনারি পাওয়া যায় এ টি দেবের, আমি কাল এনে দেখাব।’ শান্তুনু আমাকের পরের দিন পকেট ডিকশনারি দেখিয়েছিল। আর তার কাছ থেকেই হদিশ পেয়েছিলাম শিশুগ্রন্থাগার ‘গান্ধীঘাট চিলড্রেন লাইব্রেরির’। আমাদের নেতাজি স্কুলের পাশেই, মিনিট তিন হাঁটতে হয়।প্রতিদিন বিকালে খুলে। সেখানে প্রচুর বাংলা ইংরেজি বই ছিল। লেন্ডিং কার্ড করে বাড়ি আনা যায় আর রিডিং কার্ড Reading card করে সেখানে বসে পড়া যায়। আমি এরপর লেন্ডিং কার্ড করে নিয়মিত পড়তে যেতাম, বাড়িতে বই নিয়ে আসতাম। বই পড়তে ভাললাগত।আমি শান্তুনুর জানানো পথে আমার জীবনের সাহিত্যের দরজার সন্ধান পাই।ওখানে বাচ্চাদের অনেক বিদেশী রংবেরঙ্গা ছবি বহুল  illustrated  বই যেমন পড়েছি, তেমন বিশ্ব সাহিত্যের বইগুলির, দেবসাহিত্য কুটিরের, অনেক অনুবাদ বইও পড়েছি। যেমন আঙ্কল টমস’কেবিন থেকে শুরু করে শার্লক হোমস ইত্যাদি, এছাড়াও বাংলার বিখ্যাত সাহিত্যগুলি, বঙ্কিমচন্দ্র, শৎচন্দ্র, তারাশঙ্কর প্রমুখ থেকে শুরু করে পুরান , বাইবেলের গল্প পড়েছি। আমার মনে হয়েছিল, এ এক ঐশ্বর্যের ভান্ডার। তখন বাজারে সস্তার লেখক স্বপনকুমারের ‘কালনাগিনী’ সিরিজের বই আমরা স্কুলে বেঞ্চির তলে রেখে লুকিয়ে পড়তাম। বড়রা বলত ঐ বইগুলি বাজে।স্কুলের বই ভাল লাগতনা। গ্রন্থাগারটি গান্ধীঘাটে এখন আর নেই। শান্তুনুর বাবা ছিলনা ওকে ওর মা বড় করেছে। আর আমার মা ছিলনা আমার বাবা আমাকে বড় করেছে। আমাদের মধ্যে এই বইয়ের জন্য সখ্যতা গড়ে উঠেছিল।

তখন ক্লাশ সেভেনে। বাড়িতে কেউ জানতনা, স্কুল পালিয়ে ৭৫ পয়সায় থার্ডক্লাসে সিনেমা দেখতাম। যত আজে বাজে সিনেমা। সূর্যঘর, চিত্রকথা, রুপছায়া আর রুপসী ইত্যাদি সিনেমা হল ছিল আগরতলায়। বাবা একদিন জানতে পেরে খুব বেধড়ক পিটিয়েছিলেন। রক্তারক্তি কান্ড। বলতেন, বাপের বেটা হলে একটা সিনেমা হাউস বানিয়ে দেখিস। এখন ঘর থেকে পয়সা চুরি করে অন্যের হলে দিয়ে আসিস, এই পয়সা জমালে কাজ হবে। আমাদের সিনেমা দেখার নেশা কমেনি। সিনেমার পয়সা নাকি ভূতে যোগাত। আমার বাবার মতো সুকুমার স্যার ছিলেন। সুকুমার স্যার আমাদের অঙ্ক করাতেন। আর তিনি ছিলেন আমাদের স্কুলের এন সি সি র ইন্সট্রাকটর। শনি রবিবার সবসময় উপস্থিত থাকতেননা। যখন থাকতেন একেবারে মিলিটারির মতন ড্রেস পড়তেন, যেন বড় মেজর বা কমান্ডারের মতন। সবাই তাকে স্যালুট দিত। মাঝে মধ্যে মিলিটারিরাও স্যারের সাথে দেখা করতে আসতেন, তারাও স্যারকে স্যালুট দিতেন, পা দুটি দুম দাম মাটি চাপড়ে ফেলে এক বিচিত্র নজর কাড়া কায়দা। দেখতে বেশ ভাল লাগত। স্যার বলতেন অঙ্কই সকল সমাধান। এই পৃথিবীকে অংক করেই চেনা যায়। তিনি আমাদের পীথাগোরাস শিখিয়েছিলেন। তিনি একদিন গল্পচ্ছলে বলেছিলেন, কেউই দড়ি ফিতে নিয়ে মাউন্ট এভারেস্ট মাপতে যায়নি। স্রেফ অংক করে এভারেস্টের উচ্চতা জানা যায়। তার মুখেই শুনি রাধানাথ শিকদারের গল্প। তিনি বড় একজন অংকবিদ্‌ ছিলেন। মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা তিনি অংক করে বলেছিলেন। স্যার নানা সময়ে আমাদের ক্লাশে অংকের ফাঁকে অমনোযোগী ছাত্রদের টিপ্পনী কেটে গল্প বলতেন।একদিন এক গল্প বলেছিলেন, দুষ্ট ও অমনোযোগী ছাত্রদের উদ্দেশ্যে। আমি নীরস মস্তিষ্কের ছাত্র। দুষ্টুমি করিনা, কিন্তু, কিছু করতেও পারিনা। বেকার। ক্লাশে চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া। স্যার বলছেন, এই দেখ, একটা দুষ্টু ছেলে ছিল, সে এক বুড়ির ভাঙ্গা ঘরের খড়েরচালার উপর বেয়ে উঠল, তার কী বীরত্ব!। সে এত উঁচুতে বুড়ির খড়ের চালা ভেঙে উঠেছে। বুড়ি লাঠি নিয়ে তেড়ে এল, আর সে অমনি চালাটা আরো ভেঙ্গে পালিয়ে গেল। তোদের কি মনে হয়, সে বীর? আর ঐদিকে এভারেস্টের চূড়ায় তেনজিং নোরগে আর এডমন্ড হিলারী উঠে সারা পৃথিবীকে দেখিয়ে বলল, দেখ, আমরা কত উঁচুতে উঠেছি। এভারেস্ট জয় করেছি। এই দুটি গল্পের মধ্যে কোনটাতে আসল বীরত্ব?
স্যার আমাদের এমন প্রশ্ন ছূঁড়ে দিতেন। বাকী ছাত্রদের কেমন লাগত স্যারের কথা আমি জানিনা, আমার কিন্তু স্যারের মূলনীতি বা তার দেখিয়ে দেওয়া দ্বিতীয় গল্পটিই উদ্বুদ্ধ করেছিল। এভারেস্টের চূড়ায় উঠতে পারাটাই বড় কাজ।সম্ভবতঃ তার কাছেই শিখেছিলাম নির্বাচন। জীবনের পথ নির্বাচন। ছোটবেলায়, কৈশোরেই আমাদের মন কোনদিকে ঝুঁকে পড়ে। কোনদিকে প্রবণতা উপলব্ধি করে। কেউ ডাক্তার , কেউ ইঞ্জিনীয়ার, কেউ রাজা, মন্ত্রী, হিসাব রক্ষক, শিল্পী সাহিত্যিক, ইত্যাদি। যে যেটাকে বড় দেখে, আগ্রহ পায়, সেই পথকে নির্বাচন করে। আমার কাছে, মনে হয়েছিল, সাহিত্য রচনা, দর্শন, আর আঁকা। আমি সিক্সে যখন পড়ি তখন ‘রামের সুমতি’ গল্পটি ভীষন ভাল লেগেছিল, আমিও তেমন অনুরুপ গল্প বানিয়েছিলাম। স্যারদের দিয়েছিলাম পড়তে। স্যারেরা পড়েনি, কিন্তু উৎসাহ দিয়েছিল। মাইকেল মধুসূদনের কবিতা পড়ে আমার মনে হত বিশ্বের সেরা কবি। আমার তখন বিশ্ব জানার কিছুই ঘটেনি। অত্যন্ত ছোট মানুষ, ১২/১৩ বয়সের। মাইকেলের মতন সনেট লিখতাম, ১৪ অক্ষর বিন্যাস করে। অষ্টক ষটক মিলিয়ে ১৪ লাইনের। পড়াশুনা মাথায় ঢুকতনা। এসব করতাম। পরবর্তী সময়ে দেখেছি, আর মনে হয়েছিল খুবই কাঁচা সে লেখা। কিন্তু অনুশীলনের জন্য একটি কিশোরবেলার উৎকৃষ্ট চর্চা। সেইসব লেখার কিছু পান্ডুলিপি আজও বুকে আগলে রেখেছি। বুঝেছিলাম পড়া হল আসল শিক্ষক। যত পড় তত তোমার তথ্য জানা হবে। তথ্য জানাই মানুষকে ঈপ্সিত বস্তুর সন্ধান দেয়।

সব শিক্ষক সবাইকে নাড়া দেয়না। মোটিভেট বা কোন বিশেষ দিকে প্রলোভিত করেনা। আবার পত্রপত্রিকায় অনেকের সাক্ষাৎকারও অনেকের জীবন আলোড়িত করে। কৈশোর ও যৌবনের সন্ধিক্ষণে অনেক সিনেমার পত্র পত্রিকা পড়তাম। তখন আনন্দলোক, টেলিভিশান সহ নামী অনামী কাগজ ছিল। একটা পত্রিকায় একবার অপর্না সেনের সাক্ষাৎকার পড়েছিলাম। তাতে তিনি বলেছিলেন। প্রতিদিন জীবনকে অর্গানাইজ organise করে নিতে হয়। আবার কোন একটা ইংরেজি কাগজে পড়েছিলাম  Every morning you have to chalkout your day. জীবনকে শৃঙ্খলায় গুছাতে হয়। না হলে নানা সমস্যা দেখা দেয়। এই দুটি কথা আমার জীবনে ভীষণ প্রভাব ফেলেছিল। আমি আক্ষরিক অর্থেই, খাতা কলম নিয়ে প্রতিদিনের মেমো memo লিখতে বসতে পড়তাম। ‘থিংস টু বি ডান’ Things to be done লিখে, নীচে এক দুই করে সারাদিনের কাজগুলি নথিবদ্ধ করতাম । সেই অনুযায়ী দিনটা ব্যয় করতাম। এমন ভাবে, পুরোজীবনটাকেই ছকে বেঁধে চলেছি। তাতে আমি খুবই আশানুরূপ ফল পেয়েছি। এই শিক্ষাটা আমি পত্রপত্রিকা পড়ে পেলাম।

নবম শ্রেনীতে উঠে, আর মাথা কাজ করছিলনা। ছবি আঁকা শিখব,মনের ভেতর অনেক তাড়না জমেছে। আলোড়িত করে ফেলছে। সত্যজিৎ রায়ের শিক্ষক নন্দলাল বসুর কাছে যাব। শান্তিনিকেতন। সেখানে উনার সান্নিধ্য পেলে আমার জীবন উতরে যাবে, যেমন সত্যজিৎরায়ের শিল্প শিক্ষা হয়েছিল। নন্দলাল বসু ১৯৬৬ সালে মারা গিয়েছেন। কিন্তু আমি জানিনা ওসব খবর। পড়াশুনা ছেড়ে রুটি রোজগারের জন্য বাদাম, মটর ভাজা বিক্রী করছি। আর লোকে অবজ্ঞার চোখে দেখছিল। একদিকে স্বপ্ন, অন্যদিকে দারিদ্রতা। একদিন বাড়ি ছেড়ে পালালাম। শান্তিনিকেতনের উদ্দেশ্যে। শিক্ষক নন্দলাল বসুর সাথে দেখা করব। ধর্ম নগর থেকে বিনা ভাড়ায় ট্রেনে চাপলাম। পথে অনেক কষ্ট গেছে। তার অশ্রুসজল বিবরণ নাই বললাম। করিমগঞ্জে এসে টি টি ই  train ticket examiner র ভয়ে ট্রেন থেকে নেমে এক চায়ের দোকান, পরে এক হোটেলে কাজ করছি। হোটেলটি মাঝারি স্টাটাসের। কলকাতার অনেক লোক সেই হোটেলে উঠত। আমি, লক্ষ্য করতাম যারা ক্যাল্কেসিয়াম (কলকাতার ভাষা)বলে, তাদের কথার উচ্চারণে পার্থক্য থাকে, বোঝা যায়। আমি সেই কলকাতার লোকদের বলতাম ‘ আমাকে কলকাতায় একটা কাজ দেবেন। কখনো ভুলেও বলিনি আমি শিক্ষকের খোঁজে শান্তিনিকেতনের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছি। তেমনি একজন বিজয় বসু, (তিনি বহুকাল হল মারা গেছেন, আমার কাছে একজন সদয় ব্যক্তিত্ব) শিল্পী বিজন চৌধুরী, কোন একসময় তার বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। পরে বিজন চৌধুরি সেই এলাকাতেই বাড়ি কেনেন।সমবায়পল্লী , সাহেব বাগান, বালী।  বিজয় বসু বললেন, আমি তোমাকে একজন লোকের সাথে পরিচয় করে দিতে পারি, তার কাছে গেলে  তুমি মানুষ হয়ে যাবে। ১৯৭৯ সাল।আমি বিজয় বাবুর কথায় কলকাতায় ট্রেনের টিকিট কেটে চলে আসি। দেখা যাক, পরে নাহয় শান্তিনিকেতনে যাব। বোকা তো ছিলামই। বিজন চৌধুরির বাড়িতে বিজয়বাবু আমাকে নিয়ে আসেন ও আমি একটি সময়ের জন্য ক্ষণস্থায়ী বাসস্থানও পাই। বিজন চৌধুরির বাড়ির লোকেরা আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করত। কারণ আমি একেবারেই অজ্ঞ মূর্খ মানুষ।গ্রামের ছেলে। সরল সাদাসিদে। আর্ট সম্পর্কে কিছুই জানিনা। সংসার সম্পর্কেও কিছুনা। বুঝলাম আমার শান্তিনিকেতনে যাওয়া বৃথা। নন্দলাল বসু নেই। তখন মনে হল নন্দলালের ছাত্র সত্যজিৎ রায়ের বাড়িতে যদি কাজের লোক হিসাবে থেকে কিছু শিখি, তিনি তো কিছুটা নন্দলাল বসুর শিক্ষা আমায় দেবেন। প্লানটা কাউকে বলিনি। যদি সবাই হাসে। লোকে হাসলে আমার লজ্জা লাগত। মেনে নিতাম আমি বোকা, কিন্তু হাসার কারণ কি থাকে! বিজন চৌধুরির বাড়িতে আমি নয় মাস ছিলাম। বিজন চৌধুরী আমাকে আক্ষরিক অর্থে কোনদিন কিছুই শেখাননি। তিনি আমাকে তার সাহায্যকারী হিসাবে, ক্যানভাসে, বোর্ডে চওড়া তুলি দিয়ে রঙ ভরতে দিতেন। আর কোন ছবি দেখিয়ে আমাকে বলতেন এই কাজ টা কর।আমি তার লে-আউট layout দেখে সেই ছবি করে দিতাম। বিজন চৌধুরি পরে তার মত ব্রাশ চালিয়ে ঠিক করে নিতেন।তিনি আমাকে একজন স্বল্প জানা শিল্পী হিসাবে দেখতেন। আমি আশা করেছিলাম তিনি আমাকে অ্যানাটমি ড্রয়িং, রঙ লাগাবার বেসিক প্রণালী ইত্যাদি হাতে ধরে শেখাবেন। না। তিনি তেমন কিছুই করেননি। আমি আশাহত। কিন্তু কাউকে বলার মত নির্ভরযোগ্য পাইনি। বরং মেজদা আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। ধরতে গেলে ছবি আঁকার চোখ খুলে দিয়েছিলেন। মেজদা মানে মানস চৌধুরি। বিজন চৌধুরী ভ্রাতৃষ্পুত্র। কালিঘাটে থাকতেন। দিল্লির একটি নাম করা পত্রিকায় কাজ করত। ক্যারাভ্যান caravan  ।মেজদা, অসম্ভব আকর্ষনীয় ও মেধাবী। গভর্ণমেন্ট আর্ট কলেজ থেকে সোনার পদক পেয়ে পাশ করেছিল। তার ড্রয়িং বিদেশী দের মত।সে আমাকে একদিন ড্রয়িং এর ব্লক দেখায়। কি করে ইলাস্ট্রেশান করে দেখায়। এগুলি সবই দশ পনেরো মিনিটের টিউটোরিয়াল।তাতেই আমার শিক্ষা হয়েগেছিল। বিজন চৌধুরির বাড়িতে একটা জিনিস আমাকে আমূল পরিবর্তন করেছে। সেটা হল আমার সম্যক ধারণা। শিল্প কি বা ছবি কি জিনিস। বিজন চৌধুরির বাড়িতে আমি গৃহভৃত্যের মত নয় মাস অতিবাহিত করেছি। ওই সময়কালে, আমি কলকাতার বহু শিল্পী যারা আজকে নামী ও বরেণ্য, তারা তখন নামী ছিলেননা। তাদের আড্ডা ও কথোপকথন বা চাল চলন আমি দেখেছি, শুনেছি। চিত্রসমালোচক সন্দীপ সরকার, প্রকাশ কর্মকার রবীন মন্ডল এরকম বহু মানুষের, তখনে নাম জানতামনা তাদের। দু একজনের জেনেছিলাম । কেউ কাউকে ডাকলেই কার নাম কি জানা যায়। এইভাবে। সুনীল দাসের ঘোড়ার আলোচনা হত। কিন্তু বিজন কাকুর কাছে ছিল নিখিল বিশ্বাসের ঘোড়া দুর্দান্ত। তাছাড়া বিজন চৌধুরি নিজেও অনেক ঘোড়া এঁকেছেন।

ছবি আঁকতে গেলে প্রচুর পড়াশুনা দরকার হয়। এই তথ্যটি বিজন চৌধুরির বাড়ি থেকেই উপলব্ধি হয়েছিল।যদি আমি তার বাড়িতে না উঠতাম তাহলে হয়ত অ্যালবার্ট অশোকের শিল্পী হিসাবে জন্মই হতনা। আরেকটা উপলব্ধি হয়েছিল, সেটা হল, কাউকে গুরু মেনে তার ছায়া হয়ে কিছুকাল কাটাতে হয়। ওই সময়টা অধিকাংশই তিক্ততা দিতে পারে। যেমন গুরুর ফাই ফরমায়েশ খাটা, তা যত বাজে হোক, মূল্য হিসাবে দিতে হবে। তবে বাস্তব কিছু শেখা যায়। আমি যদি মাসিক মাইনে দিয়ে বিজন চৌধুরির মত কারুর কাছে আঁকা শিখতাম, তাহলে সম্ভবত আমি ছবি আঁকার টেকনিক্যাল জায়গা ছাড়া কিছুই শিখতে পেতাম না।আর যা শিখেছি বিজন চৌধুরির ছায়া হয়ে ফাইফরমায়েশ খাটতে গিয়ে তা কোনদিন কিতাবে পাবনা। শিল্প এক গভীর সমুদ্র। সঠিক নাবিক ছাড়া জানা হয়ে উঠেনা। সঠিক নাবিক হাজারে লাখেতে একটা মিলে। ভারতীয় সংগীত ঘরানায় এর বিস্তর গল্প আছে। বিশ্ববিদ্যালয় একটা কাগজ দেয় পড়াশুনার শেষে যাতে করে লেখা আপনি পন্ডিত হয়েছেন। তাতে আপনি একটা বড় চাকরি পাবেন। বিশ্ববিদ্যালয় কাউকে শিল্পী লেখক বানায়না। তার জন্য গুরু লাগে।

 আমার শেষ শিক্ষকের কথা বলে এই লেখা শেষ করব। তিনি ডঃ অব্রাহাম কভুর Dr. Abraham Kavoor.।আমি ছোটবেলা থেকেই ঈশ্বরের অনুরক্ত। বড় হয়ে চার্চে রবিবারে না গেলে মানসিক শান্তি পেতামনা। কিছু খারাপ সময় হলেই প্রার্থনা করা অভ্যেস। বলতে পারেন গোঁড়া। একদিন কলেজস্ট্রীটের ফুটপাত ধরে হাঁটছি। হঠাৎ নজরে এল ফুটপাতে পুরাণো বইয়ের দোকান। মাটিতে বিছানো অনেক বই। সবই পুরাণো। ফিকশন থেকে শুরু করে নানা ধরণের সংগ্রহ।মোটামুটি ইংরেজি বইয়ের সম্ভার। এর আগে ‘ভুত ভগবান শয়তান’, এরকম নাম গোছের অনেক বই ডাঃভবানীপ্রসাদ সাহু, প্রবীর ঘোষ প্রমুখদের লেখা বাংলায় যুক্তিবাদীর দল ও সিপিএমের লোকেরা পাড়ায় কোন অনুষ্ঠানে স্টল দিয়ে বিক্রী করত। আমি ঐ বইগুলি ফালতু বলে খুব দেখিনি। কিন্তু অব্রাহাম কভুরের নামটা শোনা ছিল। এই পুরাণো বইয়ের ভিড়ে অব্রাহাম কভুরের নাম দেখে কৌতূহলী হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। কলেজস্ট্রীট সীতারামঘোষ স্ট্রীটের মুখে। ঈষৎ নুইয়ে দেখলাম বইটার নাম ‘বি গান গাডমেন’ Be gone Godmen.।স্বাভাবিক ভাবেই হাতে তুলে নিলাম বইটার কন্টেন্ট কি দেখছি। পাল্পব্যাক কভার। পাতলা । ছোট। সূচীতে প্রথম যে বাক্যটি আমার নজরে এল তা হল,’ Bible is the dangerous book of the world.’ ওরে ব্বাস! কে তিনি? বাইবেল যদি পৃথিবীর বিপজ্জনক বই হয় তাহলে পৃথিবীর সকল ধর্মীয় বই বিপজ্জনক। আমার খুব রাগ হল। আমি বইটা কিনলাম। মূল্য মাত্র ৫টাকায়। দোকানদার ১০ টাকায় চেয়ে ছিল। আমি এমন ভান করলাম আমার এরকম পুরানো বইয়ের দরকার নেই। বাড়ীতে এনে যথারীতি পড়তে বসলাম, যেন আমি ডিটেকটিভ উপন্যাস রুদ্ধ শ্বাসে পড়ছি। বহুকাল তেমন ভাবে কোন বই পড়িনি। লোকটার( ডাঃ অব্রাহাম কভুরের) জীবনী, এবং পরিচিতি সহ তার বক্তব্য, এত সুচারু যুক্তি আমার মত গোঁড়া ধার্মিক প্রাণকে নাড়িয়ে দিল। আমার মনে হল, যে প্রশ্নগুলি আমাকে কুড়ে কুরে খাচ্ছিল সারা জীবন, এই প্রাণের জন্ম, বিশ্বব্রম্মান্ডের জন্ম, টোটাল সোলার সিস্টেম, তার উৎপত্তি , তার রহস্য- সমস্তই জানা যায়। আর ভূত আর ভগবান বা শয়তান এগুলি মানুষের ভ্রম ও ক্ষতিকারক উপাদান। আমি স্টিফেন হকিং, কার্ল সাগান প্রমুখদের প্রতি আগ্রহী হয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে ব্যস্ত হলাম , মনে হল অ্যাস্ট্রোনমি আর ফিজিক্স পৃথিবীর সকল মানুষের প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম। আমার হাতের আঙ্গুলে নানা জ্যোতিষের দামী দামী পাথর ছিল। আমি সব খুলে ফেললাম। দুঃসময় মনে হলে শরীরে ক্রশ আঁকতাম তা বন্ধ করে দিলাম। রবিবারে গীর্জা যাওয়া বন্ধ। বাইবেল কে একটি নেহাত ইতিহাস বই ছাড়া আমার কাছে এর আর কোন দাম রইলনা। কারণ ডাঃ অব্রাহাম কভুর দেখিয়েছেন, সব ধর্মীয়বইগুলি  বিপজ্জনক। প্রগতির পরিপন্থি।

 আজ বহু বছর। আমার মনে হয়েছে।ডঃ অব্রাহাম কভুর আমাকে নিজেকে চিনতে সাহায্য করে গেলেন।আমার হাজারো সংস্কার থেকে মুক্তি দিলেন। আমার এখন আর মনে হয়না কোন ঈশ্বরের হাত আমার ভাল মন্দের জন্য। আমি আমার কাজের জন্য দায়ী। যুক্তি ও বিজ্ঞান দিয়ে আমার সকল কাজকর্ম ভবিষ্যৎ ভাবতে শিখেছি। আমার নব জন্ম হল। নতুন শিক্ষা পেলাম। অব্রাহাম কভুর আমার শেষ শিক্ষক।

No comments:

Post a Comment

একনজরে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"ইস্কুল বলিতে আমরা যাহা বুঝি সে একটা শিক্ষা দিবার কল। মাস্টার এই কারখানার একটা অংশ। সাড়ে দশটার সময় ঘণ্টা বাজাইয়া কারখানা খোলে। ...