Friday, September 14, 2018

‘কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়’ -- প্রগতি বৈরাগী






বৃহৎ ও ক্ষুদ্রের সমন্বয়, স্বচ্ছতোয়া জলধারা বয়ে চলেছে দুর্মরবেগে। হিম হিম পার্বত্য খাত থেকে ক্রমশ সমতলে যাত্রা, পথ ভাসিয়ে চলেছে সে গাঁগেরাম, নগর উজিয়ে সমুদ্রের দিকে। যাবার পথে পরম দাক্ষিণ্যে ভরে দিচ্ছে শাখাপ্রশাখা, গৃহস্থের ঘরের কাছের হাঁটুজলের নদীগুলি। ছোট নদীটি, তার দেয়ালা টলমল, ঘুমিয়ে থাকে পাড়ের ভেলভেটি ঘেঁষে। যেন গৃহস্থের শান্ত পুকুরঘাট, পাতাঝাঁঝিরা মিলেমিশে একটুখানি জোট, উড়ছে জলপিপি, ঘাসফড়িং, সবুজাভ জলের ধারে ধারে ডাঁটো হয়ে ওঠা, আরো ঘন সবুজ হোগলা বনের ছায়া। বর্ষা বাড়লে সেই নরম নদীই শ্যামগম্ভীরা সরসা অথবা ছন্নমতি উলটচণ্ডাল।

শিক্ষক সেই তুঙ্গ জলধারা, ছোট নদীটি ছাত্র এবং তীব্র বর্ষাধারা... জীবন।

এক নিঝুম মধ্যরাতের ভাদ্রদুহিতা আমি, আপ্তবাক্য সত্য করে শূন্য মন্দিরের অধিকারিণী। স্বভাবে বেইমান, ঠোঁটের চাপে গলে যাওয়া ঈষৎ কষাটে আদি মাতৃক্ষরণ, খুড়খুঁড়িয়ে হাঁটতে শেখা, প্রথম ভাতের দলা গিলে নেওয়া, শ্লেটপাথরে প্রথম আঙুল ঘষে ঘষে দাগা বুলোনো, ...কাউকেই দিতে পারিনি দুর্বা চন্দন গুগগুল ঢালা নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ। আবুধা অহঙ্কার মাটিতে নামিয়ে রেখে কাউকে বলতে পারিনি, “এই নাও, দিলাম নিজেকে, নোকতা নোকতা করে সব অপ্রয়োজন ঝরিয়ে ফেলো, ছেনিহাতুড়ি দিয়ে, আগুনে পুড়িয়ে, জলে ডুবিয়ে।”

আজন্মকাল ঠেকে শেখার দলে নাম লেখানো আমায় ব্যক্তিগত পাঠ দিয়েছে কুহকী দেওয়াল, ছেঁচা কপাল, কালশিটে পড়া হাঁটু, কনুই আর আমার হাঁচোড়পাচোড় করে উঠতে চাওয়ার দু্ঃসাহস।

বাবা-মা দু'জনেই অফিস যেতেন, সেই কুঁড়িবয়সে যিনি দেখাশোনা করতেন, তার ঘুম অথবা সিরিয়াস টিভি পর্বের ফাঁকে টুপ করে খসে পড়তাম দুপুরের বিছানা থেকে। ভেসে বেড়াতাম সারা বাড়ি, কাঁচের আলমারিতে পিঠে পিঠ হেলানো বই, নাক আর চোখ ডুবিয়ে বের করে আনা সেই সেইগুলো, যেগুলো আরো একটু বড় হয়ে পড়ার কথা বলা হয়েছে। কৃষ্ণকলি পড়তে পড়তে নিজের শ্যামলা হাতে আঙুল বুলোনো, নিজের শরীরকে প্রথম চিনতে শেখা। আচ্ছা, যুগল ভুরুর বিদ্যুৎ কেমন করে তৈরি হয়? গোর্কির “মা”-এর মলাটে মুঠো মুঠো কাগজ উড়িয়ে দিচ্ছেন একজন, পাভেলের থেকে আমার আন্দ্রিউশাকে ভালো লাগে, কেমন নরম! কিন্তু আমার সোফিয়া নয়, সাশা হতে ইচ্ছে করে, মাথার মধ্যে পেরেক পুঁতে পুঁতে খোদাই হয়ে যায়, বড় বড় চোখের একটা মেয়ে, লম্বাটে কালো জামা পরে চলে যাচ্ছে শীতে কুঁকড়ে আসা শিরদাঁড়া টান করে, অন্ধকারে বরফ ভাঙতে ভাঙতে।

“এই বন্দীই আমার প্রাণেশ্বর।” ভেজা চুলে, ধোয়া শাড়ির আঁচল গায়ে জড়িয়ে রোজ প্রদীপ দেখায় মা, সিংহাসনে সারসার ঠাকুর, ঈশ্বরেরা। প্রদীপের আলোতে চকচক করে তাদের চোখ, ধরাচূড়া। ছমছম করে টানাটানা তুলির আঁচড়ের ডাগর ডাগর চোখের পাতা। এদের মধ্যে কোনটি প্রাণেশ্বর! দুদশক পার করে এসে আজ বুঝি, প্রাণেশ্বর চিরকালীন একটি মিথ মাত্র, তিনি জনমভর আত্মগোপন করে থাকেন অভ্রকুচির মত অপেক্ষার বনে। হেঁটে গেলে বুকের মধ্যে মড়মড় করে ভাঙে সহস্রাধিক শুকনো অলিভপাতা আর রোজ রাতে সাবাইঘাসের বিছানায় শুতে যাবার আগে ধনুকে শর যোজনা করেন, হৃদপিণ্ড লক্ষ্য করে নিয়মমাফিক ছুড়ে দেন প্রাত্যহিক অনিদ্রার তীর।

শুধু বই পড়ে আর ছবি এঁকে কাহাতক সময় কাটানো যায়! বেড়ালের মত পা টিপে টিপে বেরিয়ে পড়ি, গ্রিলের দরজা খুলে বেরোলেই বাড়ির বাগান। আম, জাম, জামরুল, পেয়ারার কেজো বাগিচা। পাল্লা দিয়ে দুপুরের নিঝুম ভাঙছে হাঁড়িচাচা আর বড় বড় ছাতাড়ে। আমগাছের নীচের জল জল ছাইমাটিতে দল বেঁধে তিন চারটে কুবোপাখি, আমাকে দেখাশোনার দিদিমাসি বলে, “দ্যাশে এই পক্ষীগুলানরে মোরা কানাকুয়া বলতাম।” তাদের ঘাড়ের কাছে ময়ূর পেখমের নীল, কালচে শরীরে আগুনলাল ডানা, লাল পুঁতির মত চোখ ঘুরিয়ে তাকালে বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ। জামরুল পেয়ারার তল দিয়ে ঘুরে বেড়াই, ভেজা মাটিতে বুক ঘষে চলেছে কেন্নো, আপেল শামুক, কেঁচোয় মাটি তুলেছে জামগাছের গোড়ায়, ডোবার ধারে একটুখানি উইঢিবি।

কুষি‌ কুষি পেয়ারা ধরেছে, একটু উঁচু ডালে উঠে পায়ে চাপ দিয়ে হাত বাড়াই, মচ্ শব্দ আর তারপরই রোলার কোস্টার থেকে নামার মত চোখের সামনে স্যাট্ করে নেমে আসে পৃথিবী। মাটিতে পড়ে প্রথম ঠাওর পাই না, তারপর দেখি বাঁ থাইয়ের শ্যামলা চামড়া ছিঁড়ে বেরিয়ে এসেছে সাদা মাংস, ফুটে ফুটে উঠছে গোল গোল লাল। ব্যথা বোঝার আগেই তারা গড়িয়ে পড়ছে,... ভেজা মাটি আরো ভেজা, কালচে। মিশে যাচ্ছে কাদাজলে, জলের ঘোলাটে রং গর্তের ধার ঘেঁষে ক্রমশ লাল, তারপর গাঢ় খয়েরি।

ছুটে ঘরে যাই, দিদিমাসির আচমকা ঘুমভাঙা “কী হইছে, কী হইছে”-এর মাঝেই থাবা দিয়ে খুলি রঙের বাক্স, আঁকার খাতায় ঢেলে দিই অনেকটা মস গ্রিন আর তারপরই ঘেঁটে দিই ব্রাশবোঝাই রুবি রেড। এই তো, এই রংই তো দেখে এসেছি বাগানের কাদাজলে! আমার রং মেলাতে ভুল হয়নি আর কখনো।

বোধ হবার পর জীবনের প্রথম পনেরো ষোলোটা বছর আমার বইপত্র আর ছবি আঁকা নিয়ে, খোলাহাট হৃদয় কপাট পাইনি আর কোথাও, অথবা আমিই খুলতে পারিনি নিজেকে আর কারো কাছে। তারপর এক সামান্য ঝড়ে ছন্নমতি আমি, চণ্ডরাগে গাঁটছড়া খুলে ফেলছি বাংলাভাষা আর কবিতার থেকে। একটু একটু করে এক খোলস থেকে আর এক খোলসে, এক শহর থেকে আর এক শহরে... আমার বাংলা আখর, বইকেতাব, রং শুকোনো ইজেল রয়ে গেছে মফঃস্বলের গোঁসাঘরে, জমাট ধুলোর পরতে।

দিনগুলো কেটে কেটে যাচ্ছিল ঝলমলে রত্নখচিত অপচয়ে। হঠাৎ একদিন ফোনের ওপাশ থেকে বিষাদবিদ্ধ করে ঝরে পড়ে অবেলার ট্রেন। এক বিষণ্ণ পূর্বজন্ম বলে, “আপনি দশবছর বাংলা কবিতা না পড়ে বেঁচে আছেন?” তাঁর গলা থেকে ঝরে পড়ে মগ্নতা, বিষাদ আর কবিতা, ঝোড়ো পাতার মত এমেরেল্ড রং, স্যাফায়ার রং, বহুবর্ণ কবিতারা... জীবনানন্দ, শক্তি, সুনীল, ভাস্কর, জয়, আবুল হাসান, হেলাল হাফিজ, নির্মলেন্দু, রূপা দাশগুপ্ত.. .আরো আরো আরো কত ইউনিকর্ন আর সোনালি ডানার চিল!

আমার মাথার মধ্যে শব্দ গিজগিজ করে, রাস্তা খুঁজে মরে বেরিয়ে আসার, কিন্তু স্নায়ুতে স্নায়ুতে ঘটে না সেই ভানুমতীযোগ, আঙুলে ঝরে না সেই তিলস্মি প্রপাত!

বৃষ্টির সন্ধ্যা, অফিস থেকে ফিরছি, অনেক সাধনার পর একটা শেয়ার্ড ক্যাব পাওয়া গেছে। পরের প্যাসেঞ্জার ক্যাবে ওঠার জন্য অহেতুক সময় নিচ্ছে। বিরক্ত হয়ে উঁকি মেরে দেখি, একটি বছর বাইশের মেয়ে এবং ঐ বয়সীই একটি ছেলে। কিছু একটা নিয়ে নরম তর্ক চলছে, মেয়েটির কথা নুয়ে আসছে, অপরটি যেন বা একটু উচাটন। বিবাহিতা মেয়েটির প্রবাসী স্বামী তাকে এবার দুবাই নিয়ে যেতে চায়, মেয়েটির গলা বুজে আসে, সে পারবে না, মরে যাবে এই কৈশোরের প্রেমিককে দেখতে না পেলে। তাই ছোট্ট একটা ব্যাগ গুছিয়ে সবার অজান্তে বাড়ি ছেড়ে এসেছে চিরতরে। ছেলেটি নারাজ, মেয়ে এখন ফিরে যাক, পরে ভেবেচিন্তে দেখা যাবে। অসহিষ্ণু ক্যাব ড্রাইভারের দেরি দেখে চিৎকার, “কেয়া হুয়া মিঞা, তুমহারে কো জানা হ্যায় কি নহি?”

ছেলেটি প্রায় জোর করেই ক্যাবে তুলে দেয় প্রেমিকাকে। ওড়নায় মুখ ঢেকে সে বসে থাকে স্থির, দেখি তার হাতের হাতের ফিকে হয়ে আসা মেহেন্দির কল্কা টুপ টুপ ভিজে যাচ্ছে নিশ্চুপ ধারায়।

বাড়ি ফিরে লেখার টেবিলে বসিয়ে, আমার ভেজা চুল থেকে গড়িয়ে পড়ে দু-একটা শব্দ, হাতের মুঠোয় নিয়ে চাপ দিই তাদের, ওটুকু‌ কোথায় রাখব?

টেবিলের চারপাশে ঘন হয়ে আসে একাত্তরে পায়ে হেঁটে বর্ডার পার হয়ে আসা আমার আঠেরো বছরের মা, উনিশ বছরে‌ মা হওয়া আমার এক দিদি, বিয়ে হয়ে ভারতনাট্যম শেখা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কাঁদত সে, রান্না না জানায় প্রতিদিন শ্বশুরবাড়িতে খোঁটা খাওয়া ইঞ্জিনিয়ার বান্ধবী, ...পাশে বসে বলে, “লিখবে না তুমি, এই আমার, আমাদের কথা?”

আমার আঠেরোর মা দুদিন ভারত-বাংলাদেশ বর্ডারের পাটক্ষেতে লুকিয়ে ছিলেন পাক মিলিটারির হাত থেকে রেহাই পেতে। তাঁর পুরন্ত বিনুনি থেকে আমার খাতায় নামিয়ে রাখেন দুটি কচি অথচ নিডর পাটপাতার মুকুল, দিদি‌ হাতের মুদ্রায় প্রাণ দেয় আমার কলমটিকে, বান্ধবী চামচে করে ছড়িয়ে দেয় কিছুটা টানটান ঝাঁজ। আমি অঞ্জলি পেতে গ্রহণ করি সব। আর সেই সন্ধ্যার মেয়েটি ফিকে মেহেন্দিরঙা দুটি হাত উপুড় করে আজানের ঢঙে, ভিজে যায় আমার লেখার খাতা পবিত্র নোনাজলে।

ছায়া ছায়াশরীরেরা, কোনোটি বিষাদপ্রতিমা, কোনোটি আনন্দের টুং টাং জলতরঙ্গ, ডুব দেয় আমার গহীনে। ছিটকে উঠে আসে শব্দ, সারাৎসার। মফঃস্বলের ছোট নদী আমি, নিজের দিকে তাকিয়ে দেখি, বইতে বইতে ক্রমশ কেমন অনন্ত হয়ে যাচ্ছি!




No comments:

Post a Comment

একনজরে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"ইস্কুল বলিতে আমরা যাহা বুঝি সে একটা শিক্ষা দিবার কল। মাস্টার এই কারখানার একটা অংশ। সাড়ে দশটার সময় ঘণ্টা বাজাইয়া কারখানা খোলে। ...