Friday, September 14, 2018

নদীমানুষ-- কৌশিকরঞ্জন খাঁ






রাত কত হল কে জানে? ঘোর বর্ষা। আত্রেয়ী ফুলে ফেঁপে উঠেছে। বাঁধের অবস্থা বিভিন্ন জায়গায় খারাপ। এতো জলের চাপ মেঠো ইঁদুরে ফুটো করা বাঁধের পক্ষে ধরে রাখা সহজ কথা নয়। তাই নদীর পাড়ের বাসিন্দারা সজাগ। রাতে ঘুম ভাঙলে ছাতা আর টর্চ নিয়ে একটু বেড়িয়ে দেখা চাই, কেমন আছে বাঁধ? কি খবর আত্রেয়ীর।

অবনী স্যার মানে আমাদের হাই স্কুলের প্রাইমারি সেক্সনের অবনী স্যার পাঁচ ব্যাটারির টর্চ জ্বেলে ছাতা মাথায় বেরিয়েছেন। ভোর হবো হবো করছে। স্যার   বাঁধের উপরে যখন উঠলেন, দেখলেন আত্রেয়ীর জল ফেনাময়। রাতের আঁধারেও ফেনাগুলো কেন এত স্পষ্ট কে জানে! অবনী স্যার পাঁচ ব্যাটারির টর্চটা ফোকাস করলেন আত্রেয়ীর বুকে। স্যার অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন। এতটা বছর আত্রেয়ীর পাড়ে বাস কিন্তু এ দৃশ্য কোনদিন দেখেননি। আত্রেয়ীর ফেনা তো আছেই, কিন্তু আত্রেয়ীর যে রুপোলী হয়ে উঠেছে। এই বর্ষার নিশুতি রাতে ঝাঁকে ঝাঁকে রাইখোর এর স্রোত চলে যাচ্ছে ঝিলমিলিয়ে।

সে রাতে ফিরে গিয়ে অবনী স্যার আর ঘুমোননি। পরদিন স্কুলে এসে ক্লাস থ্রির রোল কলের খাতা হাতে ক্লাসে ঢুকলেন। খুব ঠান্ডা মাথায় রোল কল করলেন। তারপর খাতা বন্ধ করেই শুরু করলেন, কাল রাতে কি দেখেছি জানিস!

ধুতি পাঞ্জাবী পরা লম্বা চেহারার সৌম্যদর্শন মিতভাষী মানুষ ছিলেন অবনী স্যার।ক্লাস থ্রির ছোট ছোট ছাত্রকেও বন্ধু ভাবার ক্ষমতা রাখতেন তিনি। সমবয়সীদের সাথে খোশ গল্প করতে কোনদিন দেখা গিয়েছে বলে শোনা যায়নি। যখন শিক্ষকের মেধার সাথে হাতে বেত নিয়ে ক্লাসরুমে ঢোকার রেওয়াজ ছিল, সে সময়েই তিনি বেত আত্রেয়ীর জলে ভাসিয়ে দিয়ে ক্লাসে আসতেন। তাঁর প্রতিটি কথাই ভীষন আন্তরিক মনে হতো। তাই অবনী স্যারের ক্লাসে ভয় ছিল না। সমীহ ছিল, ভালোবাসা ছিল।বইএর পৃষ্ঠা ছেড়ে তিনি অজানা জগতে ঢুকে পড়তেন। কত স্বপ্নময়তার জগৎ সৃষ্টি করতে জানতেন। সুস্থ কল্পনা উস্কে দিতে জানতেন।

হাইস্কুলে উঠে যাওয়ার পর যখন দেখতাম অবনী স্যার অন্য ছেলেদের নিয়ে একই ভাবে মগ্ন তখন খুবই হিংসে হতো। মনে হতো খুব প্রিয় মানুষটি কীভাবে আমাদের ছেড়ে অন্যদের নিয়ে মত্ত হয়ে আছেন! হাইস্কুলের টিফিন কখনো আগে হলে আমরা অবনী স্যারের ক্লাসের সামনে ভীড় করে দাঁড়িয়ে থেকেছি কতদিন। স্যার ক্লাস নিতেন একই ভাবে।আমাদের সমবেত উপস্থিতি ওনাকে বিরক্ত করতো না।বরং ক্লাস নিতে নিতে মোটা লাল ফ্রেমের চশমার ফাঁক দিয়ে আমাদের দিকে মাঝে মাঝে  তাকিয়ে যোগাযোগ রক্ষা করতেন।
এক মানুষের অনেক জন্ম হয়। অবনী স্যারের শিক্ষক জন্মের কারন আত্রেয়ী। কোথা থেকে এসে কবে আত্রেয়ী পাড়ে বসত গড়েছিলেন তিনি কে জানে! কিন্তু ধীরে ধীরে কোন কোন মানুষ নদীর কাছাকাছি থাকতে থাকতে নদীই হয়ে যায় বোধহয়। অবনী স্যার যে ভিতর ভিতর নদী হয়ে উঠেছিলেন তা এই জীবনে এসে বেশ বুঝতে পারি।

নদীটি বৃহৎ নয়। বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকের মতও নয়। বরফগলা জলে পুষ্ট নদীটির মতো তিনি জলজীবন লাভ করেছিলেন। জলের মতো শীতল স্বচ্ছ ভাবে বয়ে যাওয়ার মন্ত্রে তিনি দীক্ষিত হয়ে গিয়েছিলেন নিভৃতে। তাই ছোটছেলেদের নিয়ে ক্লাসে থাকতে গিয়ে কখন যেন তাঁর ক্লাসটি হয়ে উঠতো বর্ষার আত্রেয়ী নদীটির মতো। আকশের গম্ভীর কালো মেঘের ছায়ার ফ্রেমে নদীর বুকে টুপটাপ বৃষ্টি পড়ার মতো ছিল তার ক্লাস। নিত্যদিন যেন নদী হয়ে উঠবার সাধনা। তিনি নদীর মতো অবিচল, শান্ত,ধীরস্থির। উচ্চারিত শব্দগুলো নম্র বৃষ্টিদানা। ছাত্ররা সেই নদীর পাড়ে মাথা দোলাতে থাকা কাশফুল।

যে নদীর জোয়ারভাটা নেই সেই নদীর ভাঙ্গনও খুব নম্র ভাবে হয়। ভাঙ্গন তো নদীর শাসন। সেই কারনেই কি অবনী স্যারের শাসন তর্জন গর্জন করা ধাতে ছিলনা? তিনি আসলে ধারন করতেই জানতেন শুধু। স্নিগ্ধ ধারাপাতের মতো বয়ে যাওয়ার ছন্দে তিনি রূপোলী রাইখোরগুলো ধারন করতে জানতেন আত্রেয়ীর মতো। বুকের উপর দিয়ে ভেসে বেড়ানো জেলে নৌকার থেকে ভেসে আসা ম্লান আলোর মত তিনি স্থিতধী ছিলেন। তার জীবন যাপন  নীরবে ঘটে যাওয়া ঘটনার মতো। তিনি বহমান,অথচ খেয়াল না করলে বোঝা যায়না।

নদী একটা জনপদের দলিল। জনপদে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো ডকুমেন্ট রেখে যায় নদীতে। বাঁধের উপর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কত কিছু দেখেছেন উনি। বন্যার সময় নদীতে একটা গোঁ গোঁ করে ডাক থাকে জলের। ঘোলাটে জলে কোথাকার যে কচুরিপানা মিশে থাকে! জলের সাথে পাক খেয়ে সেগুলি ভেসে চলে যায় ওপাশের বাংলাদেশে। আরো কত কি ভেসে যায়।মাঝে মধ্যে অবনী স্যারের চোখে পরে। মৃত গোরুটা, বাছুরটা। একবার নববধুবেশের এক নারীর লাশ ভেসে এসেছিল। অবনী স্যার বহু ভেবেছিলেন। কিন্তু ভেবে কিনারা করতে পারেননি, সেটা হত্যা না মৃত্যু! যাইহোক সেই মৃত নারীর মুখে তিনি দেখেছিলেন বিজয়াদশমীর নির্লিপ্ততা।

মনসাপুজোর সময় শোলার ভেলাগুলি জমা হয়ে যায়।নদী দীর্ঘদিন মানুষের পুজো পার্বনের স্মৃতিচিহ্ন বহন করে। দুর্গাপূজার পর খড়ের প্রতিমা ভেসে ভেসে জমা হয়। দেবী নয়,দেবীর ভেসে আসা লাশ থেকে মাটি ধুয়ে গেলেও কিভাবে যেন রয়ে যায় শোলার সাজ।শুকনো ফুলের মালা। আর প্রিয়জনের স্মৃতিতে যারা হবিশ্যান্ন গ্রহন করেছিল, তাদের ফেলে যাওয়া ভাঙ্গা আধভাঙ্গা কালো হাড়িতে মুখ ঢুবিয়ে বসে থাকতে দেখা যায় কত কাক কে। অবনী স্যার কোনদিন মুখে বলেননি, কিন্তু এখন বুঝতে পারি নদীকে লক্ষ্য রাখলে মানুষের জীবনকথা পড়ে ফেলা কত সহজ! নদীর ভাষায় যাঁরা সাবলীল হয়ে পরে, মানুষের কথা বলা না বলা কে তোয়াক্কা করেনা তারা।

অবনী স্যার খুব ভোরবেলায় স্নান করতেন। বাড়ি থেকে দুপা হেঁটে বাঁধ। ধাপে ধাপে সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি আত্রেয়ীর জল স্পর্শ করেছে। ঘাটের একদিকে মহিলারা স্নান সারে। জলে ভেজা শরীরের টানে রাইখোরের ঝাঁক ভেসে আসে। যুবতী শরীরের টান এ মাছ অস্বীকার করতে পারেনা। জলে ভেজা নারীশরীরকে রাইখোর ঠোঁট দিয়ে স্পর্শ করে। যুবতী রাধার শরীর ঠোঁট দিয়ে আস্বাদন করে বলে সে মাছের নাম রাইখোর। অবনী স্যার স্নানের ঘাটে কয়েকটা ডুব দিয়েই সিঁড়ির কাছে উঠে গিয়ে গা মুছতেন। আত্রেয়ীর নিজস্ব জীবদের অভ্যাসে তিনি বাঁধা হয়ে দাঁড়াতেন না কখনো। প্রকৃতি নিজের খেয়ালে চিত্রনাট্য রচনা করে, তাতে তাঁর কোন পার্ট নেই, সে কথা বুঝতেন তিনি।

নদীমাতৃক জীবনযাপন করতে করতে তিনি জীবনের সমস্ত পাঠ গ্রহন করেছিলেন নদীর কাছেই। নিজস্ব ছন্দে চলা। বিনীত ভাবে চলা। সবই নদীর কাছে শেখা।নদী যেমন তাঁকে শিখিয়ে নিয়েছে। তিনিও তাঁর সমগ্র জীবন বইয়ের পাতার মতো মেলে ধরতেন ছাত্রদের কাছে। বইয়ের পাতায় ঘাড় ধরে মুখ গুঁজে শিক্ষা নয়, নিজের মতো করে দেখতে দেখতে শিখে নাও। জোর করে শিক্ষা নয়, উপস্থিতি দিয়ে জীবনকে মেলে ধরে শিক্ষাই ছিল তাঁর প্রিয় পদ্ধতি। তাঁর শিক্ষক জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষক তো তাঁর প্রিয় আত্রেয়ীই।

এখন ছাত্রজীবন আর নেই। এমনকি ছাত্রজীবনের হ্যাংওভারটুকুও নেই। সংসার হয়েছে। সংসারী মানুষ হয়ে উঠেছি। ব্যাগ হাতে নিয়ে বাজারে যেতে হয়। বাজারে যেদিন খুব রাইখোর মাছের আমদানি হয়। বাজার ভেসে যায় রূপোলী রঙে, অবনী স্যারের কথা মনে পড়ে। কখনো আত্রয়ীর পাশ দিয়ে যেতে গেলে মনে হয় – এ নদীর আসল মালিক তো সেই কবে রূপোলী স্রোতের সাথে চলে গেছেন সময়ের হিসেব নিকেশের বাইরে। মন বলে আসলে তিনি অন্য গ্রহের কোন পাঠশালায় গিয়েছেন। সেখানকারও ছোট নদীটির নাম আত্রেয়ী। সে নদীর স্রোতের মধ্যে তিনি স্রোত হয়ে বহমান থাকবেন আবহমান কাল ধরে।

No comments:

Post a Comment

একনজরে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"ইস্কুল বলিতে আমরা যাহা বুঝি সে একটা শিক্ষা দিবার কল। মাস্টার এই কারখানার একটা অংশ। সাড়ে দশটার সময় ঘণ্টা বাজাইয়া কারখানা খোলে। ...