Friday, September 14, 2018

সুদীপ বসুর কবিতা এক চিরকালীন অন্য স্বর - হিন্দোল ভট্টাচার্য






গ্রন্থ- নীল গয়নার মতো বাড়ি, সুদীপ বসু
প্রকাশক- নাটমন্দির
প্রচ্ছদ- রাতুল চন্দ রায়
৮০ টাকা




নব্বই দশকের শুরু থেকেই যে সমস্ত কবি নিজেদের ব্যক্তিত্ব এবং ভাষায় বাংলা কবিতার জগতে এনে দিয়েছিলেন নতুন ভাবনার প্রবাহ, তাঁদের মধ্যে সুদীপ বসু অন্যতম। তাঁর অনিন্দিতা বাস স্টপ, অন্ধদের বিউটিপার্লার, বিপাশা খাতুন বাংলা কবিতার কিছু উজ্জ্বল নাম। এক নৈর্বক্তিক বিষাদের আক্রমণ তাঁর কবিতায় এমন ভাবে মিশে আছে, যে মনে হয় তাঁর কবিতা পড়লেই পাঠকের মনের মধ্যে উঁকি মারে এক অস্বস্তিবোধ। অস্বস্তিবোধ- এই শব্দটিই একমাত্র বলা যেতে পারে সুদীপ বসুর কবিতাগুলির পাঠ-প্রতিক্রিয়াকালে এক উল্লেখযোগ্য অনুভূতি। প্রথমে আপনি রিজেক্টেড অনুভব করবেন, মনে হবে জীবন সম্পর্কে কবি নিজে ভীষণ বিবিক্ত হয়ে আছেন। তার পর বোঝা যাবে, সম্পূর্ণভাবে নাগরিক এই কবির জীবন সম্পর্কে আসলে পরতে পরতে আছে গভীর নীরব এক ভালোবাসা। অনিন্দিতা বাসস্টপ থেকে তাঁর কবিতা ক্রমশ এই আবহকে বজায় রেখেই চলে যায় এই ভাঙাচোরা সময়ের, ভাঙাচোরা অস্তিত্বের রাজনৈতিক ও দার্শনিক কারণ অনুসন্ধানের দিকে। বলা যেতে পারে তাঁর কবিতায় এমন এক আবহ তৈরি হত, যা টেনে নিয়ে আসত লাতিন আমেরিকা আর পূর্ব ইউরোপের কাব্য-চলচ্চিত্রের কাঠামো। কখনও কখনও এমনও হয়েছে, মনে হয়েছে তিনি কবিতা না, লিখছেন আন্তোনিওনি, বা  ফেলিনি বা ককতো বা সুবিয়েলার চিত্রনাট্য।

দৃশ্য তাঁর কাছে কথা। অনেক সময় দৃশ্যের মধ্যে একধরনের সুররিয়াল আবহ তৈরি করে, দৃশ্যকে আরও ব্যঞ্জনাময় করে তুলতেন। এর সঙ্গে থাকত এক অন্তর্লীন গল্পের কাঠামো। অনিন্দিতা বাসস্টপ হোক বা মাধবী ও অন্ধকার, সুদীপ বসুর কবিতায় এই সুররিয়াল গল্পের ন্যারেটিভ ভাঙা কাঠামো কবিতাকে তার ব্যবহৃত শব্দের অর্থের মধ্য থেকে বের করে আনে। আর এই বৈশিষ্ট্য তাঁকে তাঁর দশকে তো বটেই,্তাঁর পূর্ববর্তী ও পরবর্তী দশকের কবিদের মধ্যেও আলাদা করে রাখে। ভালো বা খারাপ তো বলা যাবে না, তা সময়ের কাজ। কিন্তু এ কথা বলাই যায়, সুদীপ বসুর কবিতা বাংলা কবিতায় এক স্বতন্ত্র স্বর। নাটমন্দির থেকে প্রকাশিত নীল গয়নার মতো বাড়ি বইয়েই এই বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান।
বাংলা কবিতায় এক অদ্ভুত ট্রেন্ড দেখা যায়, আর তা হল, বয়স বাড়লেও হাফ প্যান্ট পরা কবিতার সংখ্যা কমে না। উল্টোদিকে নীল গয়নার মতো বাড়ি কবিতার বইটিতে সুদীপ বসু এমন কিছু বাস্তবতার সামনে পাঠককে দাঁড় করান, যা পাঠককে স্বস্তিতে থাকতে তো দেবেই না, বরং এমন এক বাস্তবতার মুখোমুখি এনে দেবে, যেখানে পাঠক চাইবেন এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করতে। নীল গয়নার মতো বাড়ির বালিশ কবিতাটি যেমন।

রাঙাপিসি একাই শুত
ছোট্ট বিছানা তাতে দুটো বালিশ
একটা ভয়ের
আর একটা সাহসের।
রাঙাপিসি ভয়ের বালিশে শুত।
সারারাত ভয়ের স্বপ্ন দেখতে দেখতে
গড়িয়ে নামত পাশেরটাতে।

( বালিশ)

এই বইয়ের প্রায় প্রতিটি কবিতাতেই এই অস্বস্তিতে ফেলা কাহিনির সঙ্গে পাঠকের সহবাস শূরু হয়।
যেমন- এই কবিতাটির নাম ৩৪২। এই কবিতাটি এখানে পুরোটাই তুলে দিচ্ছি।

সে আমাকে আমারই গল্প শোনাত
আমি পালিয়ে যেতাম সেই গল্প থেকে

ছিল নির্জনতা আর সিগারেট

আর আঠারো বছর ধরে আমি কাত হয়ে
ভালোবাসতাম তাকে
জোরজুলুম করতাম

কেউ জানত না
বেওয়ারিশ ব্রিজের নীচে আমাদের পিছল পিছল ভালোবাসা

একদিন গানের শিয়রে আমি ভুল করে ফেলে এলাম ছুরি

অন্ধকার ৩৪২-এ কেউ দেখতে আসত না আমাকে

একটা ফাটল ছিল অন্ধকার ৩৪২-এ
একটাই ফাটল

আমার জন্যে তুমি শুধু শুধু কষ্ট পেতে অর্জুনগাছ

এমন কত যে অধিবাস্তবিক চিত্রকল্প দিয়ে তিনি তাঁর কবিতাকে ভাষা দিয়েছেন!
রেডিওস্টেশন কবিতায় তিনি বলে ওঠেন- ' মা তুমি জানো রেডিওস্টেশন/ মা তুমিই তো রেডিওস্টেশন' । কতগুলি চিত্রকল্পের কথা এখানে বলা যেতে পারে, যেমন-

১) কাঠের টেবিলে শুয়ে থাকে স্তব্ধ রহস্যময় কাঁটা
২) ভালোবাসা কি রূপকথার সোনালি মাকড়সা/ যা পা বেয়ে বেয়ে উঠে আসে প্রতিদিন?
৩) কমলারঙের ভোর/ ফাটা গোড়ালির ফাঁকে শিশির জমেছে
৪) ভোররাতের বাস যেন আলোর খেলনা
৫) খাঁচা আজ পাখি হয়ে পালিয়েছে
৬) সারাদিন নখের ছায়ার নীচে বসে থাক/ সোনার দাঁতের নীচে বসে থাক/ আমি ডাকি-'আছ'?

এবং এরকম আরও অনেক। একটা চরম কাফকাস্ক বাস্তবতার মধ্যে দিয়ে আমরা  পাঠক হিসেবে এমন এক বিষাদের স্বরলিপির মধ্যে দিয়ে যাই, যেখানে সমস্ত কিছুই বড় অর্থহীন লাগে। বলতে পারেন, আশাবাদ পাই না। এই সময়ের মধ্যে তো আশাবাদের কিছু নেইও। নব্বই থেকে যে যন্ত্রণাদগ্ধ সময়ের মধ্যে দিয়ে আমরা চলেছি, সেখানে একটা নীল গয়নার মতো বাড়ি- আমার কাছে অন্তত অবিশ্বাস্য নয়, বরং সুখের দিনলিপি আমার কাছে অবিশ্বাস্য। আমার কাছে সার্ত্র-এর ন্যসিয়া , কামুর প্লেগ অনেক বেশি এখন বাস্তব। যেমন কাফকার একটি মানুষ নিজেকে পোকা হিসেবে পরিবর্তিত হয়ে যাওয়াকে অনুভব করেন, তেমন ভাবেই অনুভব করেন সুদীপ, যখন লেখেন-

ভাবো
আর দ্যাখো
তোমার যুদ্ধের কোনও মানে নেই
হাসি নেই
প্রতিশোধ নেই
কান্নার রাস্তাগুলো অন্ধকার
                                          (সার্কাসে)

যিনি কাঁদতে পারেন, তিনিও একধরনের রিলিফের মধ্যে দিয়ে যান, কিন্তু যাঁর কান্নার রাস্তাগুলোও অন্ধকার, তিনি কী করবেন? এই চরম অর্থহীনতার যে সময়ের মধ্যে দিয়ে আমরা যাচ্ছি, তার কাব্যিক প্রতিফলন যদি আমাদের লেখালেখির মধ্যে না থাকে, তবে তা-ই তো আমাদের কাছে অবিশ্বাস্য হওয়া উচিত।

পাতাল কবিতায় কবি লিখছেন-

তুমি শাদা মানুষের মতো ভয় দেখাও
আমি লোহার ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে
কত কত বার
নিজের ভেতরে নেমে গেছি

খুব রাতে চাঁদ আসে
তুমি ভালোবাসো
ব্রেইল পদ্ধতিতে খোঁজো শরীরের
                                          লুকোনো পাতাল-

বলতেই হবে, একটি আগুনচাকা ঘোরে নামক সিরিজটি বাংলা কবিতার এক অন্যতম সেরা সিরিজ। কারণ এই সিরিজের একটি কবিতাও সম্ভবত উদ্বৃত্ত নয়। এই সিরিজের দশ নম্বর কবিতাটিকে এখানে তুলে ধরছি রসিক পাঠকদের জন্য-

'তোমাকে ঘরে পুরে একটা দরজা আঁকি
তার ওপর ছোরা দিয়ে লিখে রাখি 'বন্ধ'

এক একটি কাব্যগ্রন্থ আছে, যা নিয়ে আলোচনা এভাবে সম্ভব নয়। কারণ তার বিভিন্ন কবিতাকে নিয়ে সম্পূর্ণ আলাদা আলাদা লেখা হতে পারে। নীল গয়নার মতো বাড়ি সেই ধরনের কাব্যগ্রন্থ, যা ক্রমশ আগামী সময়ের হাতে পঠিত হবে, আশা করা যায়।

এই বইয়ের প্রচ্ছদ খুব আকর্ষণীয়। কিন্তু  প্রচ্ছদটি আরও আক্রান্ত করলে ভালো হত।





No comments:

Post a Comment

একনজরে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"ইস্কুল বলিতে আমরা যাহা বুঝি সে একটা শিক্ষা দিবার কল। মাস্টার এই কারখানার একটা অংশ। সাড়ে দশটার সময় ঘণ্টা বাজাইয়া কারখানা খোলে। ...