ওষুধের গন্ধ
আমার কোনদিনই ভালো লাগেনা। তবু এ যেন এক আলাদা ঘোর। নতুন গান শুরু হবে। এখন আলাপ চলছে।
বেজে উঠবে সেতারের ঝংকারে তবলার যুগলবন্দী।
বন্দিস চলছে কোথাও আর সে শুয়ে শুয়ে মজা নিচ্ছে পাশেই ছোট্ট একটা দোলনায়। জানলার
ধারে ফুটেছে নতুন রজনীগন্ধা। আলোয় ছটফটে তার খুদে খুদে হাত পা। আচমকা সব মূর্ছনা থামিয়ে
গলা ফাটিয়ে স্বরলিপি সাধল কোমল নি। নার্স এসে কোলে দিয়ে গেল। তুলে নিলাম সাদা একফালি
শরতের মেঘ। জ্ঞান ফেরার পর আমার আর তার প্রথম স্পর্শ। বৃষ্টি নামল অঝোর। ভেতরে বাইরে
এলোপাথাড়ি হাওয়া। জানলার পাল্লাগুলো ঝাপটাচ্ছে
ইচ্ছেমতন। পাড় ভাঙছে স্তরে স্তরে। একটা মেয়ে ক্রমশ মা হয়ে উঠছে। নিঃশব্দ রাতের
স্তব্ধতাকে ভেঙে তারপর থেকে জাগ্রত প্রহরীর মতো রাত কেটেছে টানা পাঁচমাস। আর দিন বয়ে
গেছে জলের স্রোতে। ক্রমশ একটু একটু করে ভরে উঠেছে একটা গাছ। ভাবতে অবাক লাগে একটি শিশু
তার নির্বোধ সরলতা দিয়ে কিভাবে একটি মাতৃস্নেহের অঙ্কুরোদগম ঘটালো। সেই মাতৃত্ব যা
ফল্গুধারা মত তার মধ্যে গেঁথে ছিল বহু আগে, তারই অজান্তে। এখন তাতে যেন ভরা জোয়ার।
মা এমন একটি
মানুষ যিনি, একটি শিশুপ্রাণের প্রথম শিক্ষক। তার সারা শরীর জুড়ে এক অদ্ভুত গন্ধ যা
শিউলির চেয়েও পবিত্র। তার আঁচলের খুঁটে ভেজা মুখ মুছে ফেলা বা মুখের চিবানো পান পাতার
গন্ধ, মায়ের সবটুকু ভরে থাকে এক অদ্ভুত স্নিগ্ধতায়। বিরাট এক ভরসার মাটি এই মা। শত
বকাঝকার পরও তার গলা জড়ানো আদরটুকু খটখটে রোদের পর এক পশলা বৃষ্টি।
পাহাড়ে তখন
ভোর নেমেছে। কিভাবে জানিনা মা ঠিক জানতে পারতেন। সূর্যের সাথে তার এই বন্ধুতা আরও পাকা
হল আমি আসার পর থেকে। নিমেষের মধ্যে সবকাজ পরিপাটি সেরে তিনি হয়ে উঠতেন খেলার সাথী।
আমি আজও তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি কিভাবে সবদিকটুকু সামলে তিনি মা হয়ে ওঠেন প্রতিদিন। তার
কোন বিশ্রাম নেই। আর এই শেখারও কোন শেষ নেই। চোখ খোলার সাথে সাথে মা ও সন্তানের এই
শিক্ষার যে সংযোগ শুরু হয়, চোখ বোঝার পরও তা
শেষ হয় না যেন...
বইয়ের ভাষায়
বলতে গেলে মা হল সন্তানের প্রথম ও প্রকৃত বিদ্যালয়। হামাগুড়ি সকাল গুলো মায়ের কোলেই
বেড়ে উঠেছে ঠিক যেমন কুমোরের হাতে গড়ে ওঠে এঁটেল মাটির একদলা তাল। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের
অপু ও সর্বজয়ার কথা বাংলা সাহিত্যে কে না জানে! ভরদুপুরে মায়ের কাছে মহারথী কর্ণের
গল্প অপুর কচিমনে যেভাবে ছাপ ফেলেছিল আমার বাস্তবটাও কেটেছে খানিক সেরকম ঘোরে। বিবেকানন্দের
জীবনে তাঁর মা ভুবনেশ্বরী দেবী ও ঈশ্বরচন্দ্রের মা ভগবতী দেবীর ভূমিকার কথাও শুনেছি
বহুবার। ছোট থেকে মায়ের মুখে শোনা যৌক্তিক অযৌক্তিক নানান গল্প, মহাপুরুষদের জীবনী,
দৈনন্দিন কাজগুলো করার মতো নানান শিক্ষনীয় বিষয় সহজপাঠের মতই লেখা হয়ে গেছে চিরটাকালের
জন্য। যা পরবর্তীতে নিজেকে মা করে তুলতে সাহায্য করেছে প্রচুর।
শিক্ষা কার
কাছ থেকে না পাওয়া যায়, শুধু শেখার ইচ্ছা থাকা চাই। বইয়ে পড়ার আগেই মায়ের মুখেই শুনেছিলাম
সুনির্মল বসুর বিখ্যাত সেই ছড়া, “ আকাশ আমায় শিক্ষা দিল উদার হতে ভাই রে/ কর্মী হওয়ার
মন্ত্র আমি হাওয়ার কাছে পাই রে”। সত্যিই তো। কি বিচিত্র এই প্রকৃতি। সুনিয়ন্ত্রিত ও
নিয়মানুবর্তিতায় ভরপুর। বহমান নদী হোক বা পাহাড়ি ঝরণা, রঙীন প্রজাপতি হোক বা অস্ট্রেলিয়ান
পেলিকান সবাই চলছে তাদের নিয়মের ধারায়। পাহাড়ে সোনালী ভোর। মেঘের বারান্দায় ঝকঝকে রোদ।
আচমকা ঝড় এলেও তাকে ধারণ করার সহ্য ক্ষমতা রাখে আকাশ। কি না নেই তার বুকে? লক্ষলক্ষ
তারা, গ্রহ উপগ্রহ, শূন্য ছাড়িয়ে মহাশূন্য। এতএত অস্তিত্বের মাথায় দাঁড়িয়ে আছে এই প্রকান্ড
শূন্য ছাত। দুহাত দিয়ে আগলে রেখেছে পাহাড় নদী উপত্যকায় মোড়া সবুজ সমতল।
পাহাড়ের
কথা বলতে গিয়ে মনে পড়ল, ছোট্ট একটি প্রসঙ্গ। পাহাড়ে জলের কষ্টের কথা অজানা নয়। সেবার
রিশপে গিয়ে দেখেছিলাম বৃষ্টির জলকে তারা কিভাবে চ্যানেলের মাধ্যমে পরিশুদ্ধ করে একটি
পাত্রে জমা করে রেখে নিজেদের প্রয়োজনে কাজে লাগায়। সে দৃশ্য দেখার পরই আমার চোখে ভাসতে
থাকে আমাদের কলকাতার ছবি। হাওড়া ব্রীজ ছাড়িয়ে বাস এগোচ্ছে শহরের দিকে আর অসংখ্য খোলা
কল থেকে ঝরণার মত জল গড়িয়েই চলেছে বিনা বাধায়। কি অদ্ভুত, তাই না? এই পাহাড়ি মানুষগুলোর
দৈনন্দিন জীবনযাত্রার লড়াইটুকু কি শিক্ষকের ভূমিকা নিতে পারেনা?
তখন আমরা
ভাড়াবাড়িতে থাকি। রোজ বিকেলে একটা লোক এক প্যাকেট বিস্কুট এনে পাড়ার চারপাঁচটা কুকুরকে
খাওয়াতো। ঝুলকালিমাখা লোকটাকে সবাই পাগল বললেও অবাক লাগত এই ভেবে সুস্থ মস্তিষ্কের
মানুষরা যেটা করতে হাজার বার ভাবি সেটাই সে কি অনায়াসে করে ফেলছে কোন চিন্তা না করেই।
ঈশ্বর সেবা কি এভাবেই শুরু হয়? জানা নেই। তবে যে বিবেকানন্দ বলে গেছেন “ জীবে প্রেম
করে যেই জন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর”। পশু পাখি পোকামাকড় গাছপালা থেকে মানুষ, সকল জীবের
প্রতিই নূন্যতম কোমল মনোভাবটুকুই কি ঈশ্বর সেবার প্রথম ধাপ নয়?
দয়া দান
কোমলতা বিনয় দায়িত্ব আমাদের চরিত্রকে মজবুত করে, আত্মমর্যাদাকে উন্নত করে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে হয় শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃতের
কথা। শ্রী ম ( ঠাকুরের পরম ভক্ত মাষ্টার মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত) লিখেছেন
ঠাকুর পরমহংস
দেবের সাথে বীরসিংহের সিংহশিশুর প্রথম সাক্ষাত। কলকাতার বাদুড়বাগানের বাড়িতে সাগরদর্শনে
চলেছেন রামকৃষ্ণ। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে দর্শন পেলেন সিংহশিশুর। সৌজন্য বিনিময়ের পর ঠাকুর
ভাবাবিষ্ট হয়ে বেঞ্চে বসেছেন। আর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর শরীরে জ্বালা ধরতে শুরু করেছে। কারণ
একটি সতেরো-আঠেরো বছরের ছেলে। সেও ওই একই বেঞ্চিতে বসেছিল। বিদ্যাসাগরের কাছে পড়াশোনার সাহায্য প্রার্থনা করতে
এসেছিল ছেলেটি | ঠাকুর তাঁর অন্তর্দৃষ্টিতে বুঝেছেন ছেলেটির অন্তরের ভাব। তিনি বুঝেছিলেন
ছেলেটি সংসার, লোভ ছাড়া কিছু বোঝে না। তাঁর মতে ছেলেটি ছিল অবিদ্যার ছেলে। যে ব্যক্তি
ব্রহ্মবিদ্যার জন্য ব্যাকুল নয়‚ শুধু চায় অর্থকরী বিদ্যা‚ ঠাকুর তাকেই বলছেন অবিদ্যার
সংসারে অবিদ্যার ছেলে। তাই তাঁর শরীরে জ্বালা। ঠাকুর ছেলেটির কাছ থেকে দূরে সরে গেলেন
| সেই প্রথম ধাক্কা খেল বিদ্যাসাগরের প্রত্যয়। তিনি নিজেও তো ব্রহ্মবিদ্যার কথা ভাবেন
না কখনও ! ঠাকুর একেবারেই লেখাপড়া জানেন না | নিজের নামটিও সই করতে পারেন না | তবু
ঠাকুর বলছেন আর শুনছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মন্ত্রমুগ্ধের মতো ! বিদ্যাসাগরের মনে
হচ্ছে যেন বেদান্ত উচ্চারিত হচ্ছে ঠাকুরের কণ্ঠে ! অথচ কী সহজ সরল শ্রীরামকৃষ্ণের মুখের
ভাষা ! শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্যই হল চরিত্রগঠন। যে শিক্ষা মানুষকে স্বার্থপর অহংকারী
রূঢ় করে তোলে সে শিক্ষা প্রকৃত শিক্ষা কখনই হতে পারে না। শ্রীশ্রীস্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের ‘অখন্ডসংহিতা’
র মূলমন্ত্রও এই চরিত্রগঠন। নেতাজীর মতেও চরিত্রগঠনের জন্য “ রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ সাহিত্য
“ হল সবচেয়ে উৎকৃষ্ট সাহিত্য। এইবইগুলি আমাদের
সত্ত্বগুণকে জাগ্রত করতে সাহায্য করে। শিক্ষালাভের পথে এগুলিও এক মহান শিক্ষকের গুরুদায়িত্ব
বহন করে।
স্কুল কলেজে
বহু শিক্ষক শিক্ষিকার সান্নিধ্য পেয়েছি যারা স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছেন। তাদের জ্ঞান,
ভালোবাসা, চারিত্রিক দৃঢ়তা সেসময়কার কাঁচামনকে পোক্ত করত। প্রেরণা দিত।
এজীবন বড়ই
বিচিত্র। অভিজ্ঞতার রামধনুতে ভরা ক্যানভাসে এমন শিক্ষকও এসেছেন যাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা
বা জ্ঞানের মাধুর্যে একদিকে যেমন পূর্ণ হয়েছি, আবার অবাক হয়েছি তাদের চারিত্রিক ত্রুটির
ভয়াবহ দিকটি দেখেও। নারী শরীর দেখলেই যেভাবে তাদের হাত ও চোখ লালসায় নিসপিস করত তাতে
বিদ্ধ হতাম বারবার। বিভিন্ন কারণবশত ছাত্রীদের মৌনতার সুযোগে তারা নিজেদের লালসাপূর্তি
ঘটাতেন অনায়াসে। ভারি অবাক হতাম নিজের কাছেই। যে শিক্ষক প্রতিবাদের ভাষা শেখান, যিনি
পথপ্রদর্শক হয়ে স্বপ্ন দেখান তার এই ঘৃণ্য কদর্য আচরণে হতবাক হয়ে যেতাম। বুঝতে পারতাম না তাকে শ্রদ্ধা করব নাকি সকলের সামনে
অপমান। শিক্ষাক্ষেত্রে এই দোটানায় আমার মতো হাজারো নারী হয়ত পড়েছেন বহুবার। ভবিষ্যৎও
পড়বেন। তবে এখন বুঝি, যেটা সেসময় পারিনি, এমন অবস্থার সৃষ্টি হলে অবশ্যই দ্বিতীয় পদক্ষেপটিই
নেওয়া উচিত। কারণ শিক্ষাগত যোগ্যতা দিয়ে আর যাই হোক প্রকৃত শিক্ষা বিচার হয় না।
শিক্ষা মানুষকে
বিনয়ী, আত্মবিশ্বাসী করে। আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত করে। বাবা কোনদিনই পড়াশোনায় মুখ্য ভূমিকা পালন না করলেও
তার দায়িত্ববোধ উপকারী মনোভাব আমায় সে পথ অনুসরণ করতে শিখিয়েছে। বাবার বুকের মধ্যে
একটা সবুজ মাঠ ছিল। অফিস থেকে ফেরার পরও ক্লান্ত অবসন্ন মনটা নিয়েও নেমে পড়তেন মাঠে।
সে সময়টুকু শুধু আমাদের ডাংগুলি বেলা।
এ শিক্ষার
জগত বড়ই বৃহৎ। শিক্ষক সংখ্যাও নেহাত কম নয়। যেটুকু যার ভালো সেটুকুই শেখার মতো। মনটুকু
প্রশস্ত করে তুললে আর নতুন বিষয় শেখার আগ্রহ থাকলে শিক্ষক খুঁজতেও সময় লাগে না। কোন
মানুষ যেমন শিক্ষক হতে পারেন তেমন কোন ঘটনাও এ ভূমিকা নিতে পারে অনায়াসে। অভিজ্ঞতায়
ভরা এ জীবনে প্রেম ভালোবাসা বিরহ বিচ্ছেদ অতি স্বাভাবিক সত্য। সম্পর্কের ঢিবিতে মাটি
চাপাতে চাপাতে যখন শত চেষ্টাতে খসে যায় পলেস্তারা, দুজন মানুষ সমান্তরালে চলতে চলতে
হঠাৎ যদি থেমে যায় একজন, তখন? সে ভার কি চরম শিক্ষা নয়? সে ভাঙা সম্পর্ক কি এক পোড়
খাওয়া শিক্ষক নয়? ভাবতে আবাক লাগে, বিচ্ছেদ
জীবনের কি ভীষণ এক সত্যি। শত চেষ্টাতেও আটকানো যায় না ছেড়ে যাওয়া প্রিয়মানুষটাকে। সবকিছু
উজার করে দিয়েও দুটো শূন্য হাত খামচে ধরছে নদীর জল। জাপটে ধরছে বাতাস। অথচ একদিন এই
নদী এই বাতাস তাদের হাত ধরে সন্ধে থেকে রাত, রাত থেকে ভোর শুধু বয়ে গেছে নিরবে নিভৃতে।
আচমকা এ
বিচ্ছেদ সামলাতে সময় লাগে ঠিকই, তবু সামলাতে হয়। শেষ সময় থেকে আবার নিজেকে ফিরিয়ে আনতে
হয়।
জীবনের স্বার্থে
আবার হাসতে শিখতে হয়।যখন মানুষ মেনে নিতে শিখে যায় চরম সত্যকে তখনই অভিজ্ঞতা হয়ে দাঁড়ায়
জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষক। ঠোক্কর খেতে খেতে পরশপাথরের সন্ধান মেলে পলিজমা নদীগর্ভে।
সবচেয়ে বড় সত্য হয়ে দাঁড়ায় এই জীবন। গাছে ফোটা একটা ফুল দেখে যে হেসে ওঠে অবলীলায়,
কচুপাতায় দুবিন্দু জলে যার চোখে হীরের ঝলক ফুটে ওঠে, রোদ উঠলে যার চৌকাঠ নিসপিস করে
সারা উঠোন দৌড়ে বেড়ানোর জন্য, ছাতে মেলা তারে যার চোখ শুকিয়ে আসে ঘুড়ির প্যাঁচ দেখতে
দেখতে সে পারে নিঃসঙ্গতার ওপারের ঝলমলে ঝরণাটাকে ছুঁতে। সূর্য ডোবার সময় সাগরের ফসফরাস
ঢেউগুলোয় জেলিফিস কুড়োতে কুড়োতে সে আওড়ে চলে একলা চলার গান।
সে গান তার
অন্তরে গেঁথে নিয়ে পথ চলা শুরু হয় নতুন করে। মনে পড়ে, মায়ের মুখে শোনা “ তুমি অধম তাবলে আমি উত্তম হইব না কেন” বঙ্কিমচন্দ্রের
সেই বিখ্যাত লেখা। বড় সত্যি কথা। এ শিক্ষা কোন একদিনের শেখা না। জীবনের ভুলগুলো থেকে
যে শেখা তার চেয়ে গভীর আনন্দ আর কিছুতে নেই হয়ত। কারণ এক্ষেত্রে শিক্ষক আমারই জীবন
আর শিক্ষার্থীও আমি নিজে।
আগেই বলেছি,
মায়ের চেয়ে বড় শিক্ষক আর কেউ নেই। মায়ের দেওয়া সবকিছুই কখন যেন গাঁথা হয়ে যায় অজান্তেই।
জীবনে মাতৃত্ব আসার পর থেকে টের পাই একটি শিশু কিভাবে
টেনে হিঁচড়ে আমার ভেতর থেকে নিংড়ে আনছে আমারই মাকে। আমার মুখ দিয়ে যেন অনর্গল বলে চলেন
মা। কচি কচি হাতপা গুলো নেড়ে চেড়ে সে শিক্ষক আমায় চোখরাঙায় ভয় দেখায় ঠোঁট ফোলায়। আর
আমি দিনে দিনে ফুটে উঠি মায়ের মতো।
মানুষে মানুষে
যার বড় হিংসা। মারামারি কাটাকাটি স্বার্থপরতা। লোভ লালসার এই নীলগ্রহে মহামারির মতো
দেখা দিচ্ছে দাঙ্গা। যে ইতিহাস আমাদের এ ভয়াবহতার শিক্ষক হতে পারে তাকে আজ ভুলতে বসেছে
মানুষ। একসময় মাদিদিমার মুখে মুখে শিখেছিলাম,
‘’ কুকুরের
কাজ কুকুর করেছে
কামড় দিয়েছে পায়,
তা বলে কুকুরে কামড়ানো কিরে
কামড় দিয়েছে পায়,
তা বলে কুকুরে কামড়ানো কিরে
মানুষের শোভা পায়?”
সে শিক্ষা
আজ বিফল। কদর্য মানুষ আজ গর্ভবতী কুকুর ছাগলকেও ধর্ষণ করে। বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ি শতাব্দী
কি সত্যিই প্রগতির পথে? উন্নতির পথে? কজন শিশুকে আজ শেখানো হয় শিক্ষক দিবস কেন পালিত
হয়? যে দেশে রোজদিন অনাহার হিংসা দলাদলি, ঘৃণ্য রাজনীতির পীড়ণ সে দেশ সে সমাজ আর যাই
হোক প্রকৃত শিক্ষা পেতে পারে না, যে শিক্ষার কথা বলে গেছেন রামকৃষ্ণ, যে শিক্ষার কথা
বলে গেছেন বিবেকানন্দ, সেই শিক্ষারই আজ বড় প্রয়োজন।
মায়ের কোলে
যে ভোর ফুটে ওঠে , আড়মোড়া ভাঙে হাই তুলতে তুলতে , তাকে জড়িয়ে নেয় বাতাস ,জড়িয়ে নেয়
আলো। প্রদীপের শিখায় ভরে ওঠে তুলসীতলা। তারপর উঠোন ছাড়িয়ে রাঙাপথ শহর বন্দর, আকাশ,বাতাস
ভরে দীপশিখায়। আঁধার রাতের বিষণ্নতায় পিন ফুটিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে জোনাকির দল। থমথমে বাতিঘর
আলোয় আলো। মন ভরে উঠছে ক্রমশ মানুষের। প্রশস্ত হচ্ছে পথ। মিশে যাবে নদী নোনাজল সবধূলো
জমা আঁশটে বাতাস। শত যন্ত্রণার মাঝেও পরকে আপন করে নেওয়ার দিব্যচক্ষু খুলে দুহাত বাড়িয়ে
দেবে বিশ্বাসে। দুঃখকে সত্য ভেবেই সে শিক্ষা এগিয়ে দেবে পায়েসের বাটি। বরপ্রাপ্ত ঈশ্বরপুত্রের
দল চুমুক দেবে শিশুবালকের মতো। সকল ত্রুটি থেকেই জীবন যেন হয়ে উঠুক সবচেয়ে বড় শিক্ষক
এ উপলব্ধি আসুক মানুষের মনে, এমন আশা রাখি...
No comments:
Post a Comment