Friday, September 14, 2018

'বিরহ বাহানামাত্র' - হিন্দোল ভট্টাচার্য







গ্রন্থঃ বিরহ নামের মনকেমনগুলি/ চৈতালী চট্টোপাধ্যায়
প্রকাশক- সিগনেট
প্রচ্ছদ- তারকনাথ মুখোপাধ্যায়
দাম- ১০০টাকা


" যাও! ঈশ্বরকণায় মিশে যাও।
ছেড়ে, থাকতে পারবে না তো--
তবে কি আবার ফিরে আমার গর্ভেই জন্ম নেবে'

এই তিন লাইনের কবিতাটি পড়ার পর কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকি। কিছু বলতে ইচ্ছে করে না। ভাবি, সমস্ত মহৎ কবিতাই কি এমন যন্ত্রণার গর্ভজাত? এমন মৃত্যুর সঙ্গে সম্পর্কিত? যে বইটি থেকে কবিতাটি তুলে দিলাম তার নাম বিরহ নামের মনকেমনগুলি। লিখেছেন কবি চৈতালী চট্টোপাধ্যায়। মনে হচ্ছে, এই ছোট্ট কবিতাটি নিয়ে লিখে গেলেই কেমন হয়! জন্ম-মৃত্যু- বিরহ-প্রেমের এমন এক চক্রের মধ্যে কবি নিজের ভাবনাকে এখানে নিয়ে এসেছেন যার দুইদিকে অনন্তকাল হেঁটে গেছে। আমরা যেন একটি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকি সবসময়। যার একদিকে একটি রাস্তা অনন্তকালের দিকে চলে গেছে। আবার সেই রাস্তাই ঘুরে ফিরে হাজির হয়েছে এই দরজার সামনে। আমিই হাঁটছি অনন্তকাল ধরে। আমিই হেঁটে চলেছি অনন্তকালের দিকে। উপরের কবিতাটিকে যদি এ মুহূর্তে আমার পড়া শ্রেষ্ঠ প্রেমের কবিতা বলি, তাতে নিশ্চয় অনেকে আপত্তি করে উঠবেন। কিন্তু আমার কিছু করার নেই। কারণ এমন প্রেমের কবিতা আমি পড়িনি অনেকদিন। মৃত্যু, প্রেম, সৌন্দর্য সমস্ত চেতনাই মিলেমিশে গিয়ে রচনা করছে এক সময়চেতনা, যার সঙ্গে প্রকৃত সময়ের কোনও সম্পর্ক নেই, কিন্তু সম্পর্ক আছে অনন্তকাল ধরে প্রবহমান সময়ের।

যে বই নিয়ে আমার এই কথামুখ, বইটির ছত্রে ছত্রে প্রেম ও মৃত্যু হাত ধরে আছে। আর কে না জানে, বিরহের চেয়ে বড় প্রেম নেই। মিলন বরঞ্চ ক্ষণস্থায়ী। বিরহ নয়। কারণ বিরহের মধ্যে আছে সেই শাশ্বত অপেক্ষা, যা প্রেমের ভিতর দিয়ে হেঁটে যাওয়া এক রাস্তা তৈরি করে। কোন সে রাস্তা? কোথায় যায়? সেও কি এই ঈশ্বরকণায় মিশে যেতে যেতে তার পর জন্ম নেয় প্রিয়ার গর্ভে? সেই কি তার মা, আবার সেই কি প্রেম? সে কি নিয়ত জন্ম নিচ্ছে এই বিরহ ও অভিসারের মিথষ্ক্রিয়ার মধ্যে? তার এই সঙ্গম কি অনন্তকালের? এই সব প্রশ্নের উত্তর হয়ত কখনও পাওয়া যায় না, কিন্তু এটুকু বোঝা যায়, এই সব প্রশ্নযাপন করতে করতেই আমাদের জীবন মৃত্যুর দিকে, আবার মৃত্যু হয়ত জীবনের দিকে প্রবহমান হয়।

কবি চৈতালী চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে আর নতুন কিছু বলার প্রয়োজন হয়ত আমাদের নেই। শুধু এটুকু বলার, তিনি হচ্ছেন সেই বিরল কবিদের অন্যতম, যাঁরা সারাজীবন এক কাব্যব্যক্তিত্বের সাধনা করে গেলেন। পেলেনও। কারণ বিশিষ্ট কবিদের বিশিষ্ট ভাষা অর্জন করলেই কেউ কাব্যব্যক্তিত্ব অর্জন করে না। কাব্যব্যক্তিত্ব তাঁর ভাবনা, ভাষা, ভাষার সঙ্গে ভাবনার সম্পর্কের সঙ্গে যোগ করে তাঁর আভ্যন্তরীণ যাপনকেও। শুধু দেখার কথা যা, তা হল, সেই কবি কীরকম ভাবে নিজেকে বারবার ভাঙছেন। কীভাবে তিনি নিজেকেই বারবার জন্ম দিচ্ছেন, কীভাবে সেই নতুন জন্মগুলিকেও সেলিব্রেট করছেন এবং ধ্বংস করছেন। হ্যাঁ, ধ্বংস করছেন এবং তা পরম মমতায়।

তিনি লিখছেন- 'চেতনা আনন্দঘন। মুহূর্ত, মধুর বুটজুতো'।
তিনি সরে যাচ্ছেন না আটপৌরে অভিজ্ঞতাগুলি থেকে। সরে যাচ্ছেন না কঠোর বাস্তবের সামাজিক সত্যগুলির থেকে। কিন্তু তাঁর কবিতা চিৎকারের কবিতা হচ্ছে না। বরং সেই সব কবিতাগুলির মধ্যেও ফুটে উঠছে তাঁর আভ্যন্তরীণ দার্শনিক জীবন।

যাদুবাস্তব সিরিজের কবিতাগুলি যেমন মেয়েজন্ম, মাতৃতন্ত্র, প্রেম তো বটেই, সেগুলিকে ছাপিয়েও উচ্চারণ করছে এক নিভৃততম সত্যকে- " তবে কি আদিম? আবার মাতৃতন্ত্র?/ সেও তো টোটেম, অধিকরণের নামান্তর'
পাশের বাড়ির কবিতা, সহজ পাঠ সিরিজের কবিতা এই সত্যগুলি তুলে ধরে বিভিন্ন অপ্রত্যাশিত রূপকের মাধ্যমে। যেমন ডিপ্রেশন কবিতায় আমরা পাই-' একটি চমকানো জাহাজ ভেসে ভেসে সহসা সব আলো নিভিয়ে দেয়।"

যেমন একটি পুরো কবিতাই তুলে দিতে ইচ্ছে করে-

তোমার তরঙ্গে আমি ডুবতে পারি না।
তুমি বল, রাত এক আশ্চর্য সময়!
আমি লিখি, ভয়।
তোমার তরঙ্গে আমি ভাসতে পারি না।
তুমি বল, পথ এক পরিত্রাণের বর্ণ্না।
আমি, শেয়াল-কুকুরের ডাক শুনি।
তোমার তরঙ্গ?
সে তো আমারই নৌকা ছিল কোনওদিন!
আমার তরঙ্গ লেগে,
নক্ষত্র অবধি উঠেছিল।
তুমি, বাঘনখে, বসন্তগন্ধ পাও।
আমি, দ্রুত শীত কুড়োনোর শব্দ স্থানীয় থানায় পৌঁছে দি।
ঢেউ, ভিন্ন হয়
                                                  ( বিচ্ছেদ)
এই গ্রন্থের মধ্যেই আছে দেবব্রত বিশ্বাসের বসন্তসঙ্গীত-এর মতো কবিতাগুলিও, আবার ৪৯৮এ ধারার অপপ্রয়োগ প্রসঙ্গ উঠল যখন, বা নির্ভয়া শীর্ষনামধারী কবিতাগুলিও। আবার যেমন প্রতীকের ক্ষেত্রে কবি রণজিৎ দাশের প্ররোচনা নামের কবিতাটি বাংলা কবিতায় একটি মাইলস্টোন, তেমন এই গ্রন্থেও আছে এমন একটি কবিতা। কবিতাটির নাম যৌনতা। পুরো কবিতাই তুলে না দিলে পাঠক, যাঁরা পড়েননি, তাঁরা নতুন প্রতীকের মধ্যে দিয়ে কীভাবে যৌনতার ভাষ্য ফুটিয়ে তোলা যায়, তার হদিস পাবেন না।

তোলা উনুনের মতো এই প্রেম। রান্নাঘর।
ঘুঁটে, কয়লা ও গুল সাজিয়ে রেখেছি।
ভোরবেলা, আর, একদম পড়ন্ত বিকেলে আঁচ দিতে হয়।
জ্বালানি মহার্ঘ।
মন, কতদিন আগুন তোলে না।
ঝুল। উনুনের শিকে ওই বাসা বেঁধে আছে তেলাপোকা।
চোখ হাহাকার করে।
কতদিন,ধোঁয়া থেকে জল পড়ে না!
মিষ্টান্ন বানাইনি, কিংবা টক,
শুকনো নালায় দু'-একটা কাঁচা ভাতও ভেসে নেই--
সন্ধের ভাঁড়ার নামিয়ে,
এস অঙ্গ, রন্ধন চড়াও!
নইলে তো, সমস্ত প্রতীকী হয়ে যাবে

একটি শব্দ উচ্চকিত নয়। বরং বিষাদের একটি আন্ডারটোন বেজে যাচ্ছে। সম্পূর্ণ কাব্যগ্রন্থে বিরহ নামের মনকেমনগুলি সিরিজের কবিতাগুলি এমন এক ক্যাথারসিসের কাজ করে, যে মনে হয়, বিষাদ সেখানে কবির সঙ্গে মিশে গিয়ে একলা বেড়াতে বেরিয়েছে। সঙ্গে হয়ত একজন বন্ধু কোনও। কিন্তু সে কিছু শুনছে না। কবি বলে যাচ্ছেন আলতো মৃদু স্বরে। ব্যক্তিগত শোক-দুঃখ-যন্ত্রণা মিশে যাচ্ছে চারিপাশের বাস্তবতার সঙ্গে। এক একটি কবিতার মধ্যে ফুটে উঠছে অসংখ্য পাঠ। যে যেমন করে পাঠ করে, তেমন করে পাঠ-ই সত্য সেখানে।
কবিতার মধ্যে এই বহুস্তরীয় পাঠের সম্ভাবনা তৈরি করা খুব কঠিন কাজ। আর এই কাজটি এই বইয়ের প্রতিটি কবিতায় এমন ভাবে রয়েছে, যে মাঝে মাঝে মনে হয় এই বইটির মধ্যে হয়ত বা তিন থেকে চারটি কবিতার বইয়ের কবিতা রয়েছে।
'বিরহ নামের মনকেমনগুলির শেষটি' কবিতাটি নিয়ে যেমন লিখে যেতে পারলে বেশ হত।

' বস্তুত বিরহ বলে কিছু নেই।
ফাঁকা হাতে বিজ্ঞান সাত তাড়াতাড়ি হাত রাখে।
আমিও চালাকি করি।
গানের জন্য কিছু অশ্রুত ঘোর লাগে, লাগবেই--
হরমোন খুলি।
ভালবাসা, পুচ্ছে যৌনতা, বেঁধে ধেয়ে আসছে,
তাই, আমিও মুখশ্রী লাল করে বসে থাকি।
যেন, সহসা ডালপালাগুলি বেজে উঠল!
রাগ, মোচন হল!
সব জেনে গেলে, মন,
সে তখন সাদা ডেডবডি!
আমি করি কী, হৃদয় জ্যান্ত রাখতে,
মাছের হাঁড়িতে ঢেলে দি,
তারপর কাঁদি।
ভ্রমরকে শ্রীকৃষ্ণসকাশে পাঠাই'

নামকরণ ,  উৎসর্গ থেকে শুরু করে, সমগ্র বইটিতেই শব্দের বাচ্যার্থ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার নতুন ভাষা খুঁজে পাই। আর বিশ্বাস করি, এই বই আগামী দিনে আবিষ্কৃত হবে নতুন করে। যদি, বাংলা ভাষা বেঁচে থাকে ততদিন।

প্রচ্ছদ তারকনাথ মুখোপাধ্যায়ের। যথাযথ।




2 comments:

  1. ভালো লাগলো এই আলোচনা

    ReplyDelete
  2. বা! মন ভরে গেল। বই তো এখানে পাবোনা। ব্রাত্যজনের রুদ্ধসঙ্গীত!

    ReplyDelete

একনজরে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"ইস্কুল বলিতে আমরা যাহা বুঝি সে একটা শিক্ষা দিবার কল। মাস্টার এই কারখানার একটা অংশ। সাড়ে দশটার সময় ঘণ্টা বাজাইয়া কারখানা খোলে। ...