Friday, September 14, 2018

অশিক্ষা, কুশিক্ষা ও সুশিক্ষার খিচুড়ি -- কৌশিক গুড়িয়া







এ বাসে আমি রোজ যাই। বাস ছাড়ার বড়জোর টিন মিনিট আগে পোঁছাতে পারি। কিন্তু সুসম্পর্ক বজায় রেখেছি কন্ডাক্টারের সাথে। ফলে তিন নম্বর রো, বাঁ দিকের জানালা আমার জন্যেই ফিক্সড। যেন বাপের সম্পত্তি ! অথছ রুগী নিয়ে, বাচ্চা নিয়ে যে মফসসলে এসেছিলো, কোনও ক্রমে গ্রামে ফিরবে, সে থেকে গেল ব্রাত্য। সে বা তাঁরা ঘেমো বাসের টালমাটাল ভিড়ে সংখ্যালঘুর অভিনয় করলে আমার কী ? আমি বরং জানলার ফুরফুরে বাতাসে উড়িয়ে দেব দু’চারটে স্মাইলি। বাস ছুটে চলবে চাষজমি ভেদ করে গড়ে ওঠা গ্রামীণ সড়ক যোজনায় ...
এটা আমাদের বাস্তুতন্ত্রের প্রে-প্রিডেটার সম্পর্কের মতো। কারণ, যে আমি গ্রামীণ বাসে খাদক হয়ে বসে ছিলাম, সেই আমি আবার ভাগীরথী এক্সপ্রেসে কৃষ্ণনগর পোঁছে ডেলি প্যাসেঞ্জারদের সিট ছেড়ে দিতে বাধ্য। হয়ে উঠলাম খাদ্য।  কিংবা আমিই হাওড়া থেকে ব্ল্যাক ডায়মন্ড এক্সপ্রেসে সামান্য একটু জায়গা পেতে বর্ধমানের সীতাভোগের গন্ধ পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করব।

সেদিন পাসের সিটে বসা এক ভদ্রলোক বললেন – এভাবে অ্যাডজাস্ট করেই তো যাতায়াত করতে হয় আমাদের। কী আর করা যায় বলুন ? তাঁর ওই অ্যাডজাস্ট শব্দটি আমার কানের মধ্যে যেন ঝিঝি পোকার মতো অস্বস্তি তৈরি করছে। সেই রেশ কি আমার ছাত্র-দশার গ্রোথ রিটাডেসানে অ্যাকটিভেটরের কাজ করে ? শব্দটা মাথায় চিমটি কাটে, গায়ে চুলকে দেয়, এমনকি পায়ে সুড়সুড়ি দিতেও ছাড়ে না ! সত্যি তো মানিয়ে চলার কি সীমা-পরিসীমা আছে আমাদের ? দুর্বল শৈশবে খেলার মাঠে বন্ধুদের সঙ্গে, কলেজ কেটে বান্ধবীর সঙ্গে, সংসারে বউয়ের সঙ্গে আর বার্ধক্যে ছেলে-মেয়ের ফ্ল্যাট বাড়িতেও অ্যাডজাস্ট শব্দটির ডেফিনেশন সম্পূর্ণ করা যায় কি ?
একটু একটু বুঝতে পারছি, ডারউইন বা ল্যামার্ক সাহেবরা খুব ছোটোখাঁট কবি ছিলেন না। বেশ কয়েক মাইল সময় তাঁরা দেখতে পেতেন। তাঁরাও দেখেছিলেন অ্যাডজাস্ট, অভিযোজন, বিবর্তন ...  

ইদানিং মনে এক দ্বন্দ্বের ডিম এসে হাজির হয়েছে। তাকে না পারছি গিলতে, না পারছি ফেলতে !
মনের দ্বন্দ্ব প্রশ্ন করছে, শিক্ষার কি দাম আছে কিছু ? নাকি ট্যাঁক আমাদের চালক ? এথিক্স কি বর্ষার জলে ভিজে ন্যাতা হয়ে গেছে, সেও কি পয়সার কাছে তাপ ভিক্ষে করে ! আজ মনে হয় সেটাই জাগ্রত রূপ পেয়ে গেছে। ক্ষমতাই হয়ে উঠেছে স্টিয়ারিং, সে চালায় আমাদের
যে শিক্ষা বাড়ি থেকে কুড়িয়ে পায় কোনও শিশু তা কোন কাজে লাগে ! কড়ি তাকে পিষে দেয়, শক্তি তাকে দমন করে। তাই সে ধির ও ধারাবাহিক ভাবে, গোপনে ও লুকিয়ে টাকার মোহ জিনে পুরে নেয় ! সে দেখে পাড়ার দাদাকে, সে দেখে রঙ্গিন নেতাকে, সে দেখে ছায়াছবির সেলেবদের এবং অন্ধ মন-মীড় নিয়ে টুকে রাখে মাথায়। ফলে মনের প্রাকৃত শিক্ষা চাপা পড়ে থাকে মৃত প্রজাপতির মতো, পাপোশের তলায়। যে প্রজাপতি তাঁর শুঁয়োপোকা থেকে ডানা অর্জন করেছিল সে আর মধু খুঁজে পায় না ফুলের। মিলন ঘটে না পরাগরেণুর। সুপক্ক ফল, সুমিষ্ট ফল তো তারও পরের ঘটনা ! মনের দ্বন্দ্ব প্রশ্ন করে, তবে কে হেরে যাচ্ছে --- শিক্ষা না সমাজ ? কে জিতে যাচ্ছে শিক্ষা না কড়ি ? কে হেয় হয়ে উঠল সৎ না অসৎ ? এ প্রশ্নের উত্তর বড় জটিল। সাপ লুডোর জগতে কাকে জড়িয়ে ধরব আমরা মই না সরীসৃপ, কাকে আদর্শ মনে করবে ছাত্ররা আমার ?

এ প্রশ্নের ডিম ফুটে যে বাচ্চা বেরয় সেও কি তাঁর আসল মাকে পায়, নাকি সারোগেট সমাজ তাকে সিউডো পুতুলের আদর কিনে দেয় ?  জানি না। জানি না, এবং জানি না ...
#
প্রায় দু’দশক হল পড়াচ্ছি বহু প্যারামিটারের ছাত্র-ছাত্রিদের, কোনটা যে অশিক্ষা, কুশিক্ষা ও সুশিক্ষা  তা আজ বেশ গোলমেলে মনে হচ্ছে। তাই থাক ওসব, সময় তাকে দরকারি আদলে গড়ে নিক। ওই উপাদান দিয়ে আজ বরং খিচুড়ি বানাই। প্যাচপ্যাচে বাজারে ইলিশের দামও তো নাগালের মধ্যেই। কী বলেন ?
তাবলে এটা ভাববেন না যে আপনি কি মনে করলেন তাতে কিছুই যায় আসে না আমার, আলবাত আসে। কারণ আমরাই সেই গুরু সংখ্যক নাগরিক যাদের কাজ ও ভাবনার গায়ে দায় ও দায়িত্ব লেগে থাকে। আমরাই সেই গুরুসংখ্যক নাগরিক যাদের অর্ধেক জীবনের মায়াপথ সংখ্যা-গুণগত ভাবে পরিমাপ জরুরী, এবং আমরাই সেই মিডল এজেড শিক্ষক ও শিক্ষার্থী। সুতরাং মনে আমরা যাই ভাবি না কেন রনে-বনে-জঙ্গলে কুশিক্ষার ধুলো ঝাট দিতে হবে আমাদেরকেই। হোক না বেয়াড়া সময়, হোক না কাদা মাখা মন !     

No comments:

Post a Comment

একনজরে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"ইস্কুল বলিতে আমরা যাহা বুঝি সে একটা শিক্ষা দিবার কল। মাস্টার এই কারখানার একটা অংশ। সাড়ে দশটার সময় ঘণ্টা বাজাইয়া কারখানা খোলে। ...