Friday, September 14, 2018

গল্প- পার্থ রায়







বাঁজা

নিজের ঘরের জানালার কাছে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে বাইরের বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে ছিল নিশি জলের ঝাপটা এসে মুখে লাগছে, তবুও জানালা বন্ধ করতে মন চাইল না। ওর এখন মন ভালো থাকে না। মনের ভেতরে চাপা কান্নার বৃষ্টি নিয়ে বাইরের এই অনর্গল ঝরে পড়া বর্ষণ দেখতে ভালো লাগে। নিশির বিয়ে হয়েছিল বর্ষাকালের শেষের দিকে। বিয়ের পরের দিন রতনের সাথে প্রথম শ্বশুর বাড়ী আসার দিন কি বৃষ্টি, কি বৃষ্টি। তারপরে মাস দুয়েক পরেই শরত এলো। নিশির বরাবরই দুর্গা পুজার সময়টা বেশ ভালো লাগত মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর থেকে বেশ দূরে জলঙ্গির গা ঘেঁষে মুসলিম অধ্যুসিত এই গ্রামটাতে নিম্নবিত্ত জেলে, রাজমিস্ত্রিদের বসবাসই বেশি হলেও, বেশ কয়েক ঘর হিন্দু আছে। দুর্গাপূজার সময় মুসলমানরাও সমান আনন্দ নিয়ে শুধু চাঁদাই দেয় না ,রীতিমত সক্রিয় ভুমিকা নেয় আবার ঈদের সময়ও পরোটা মাংস হিন্দুদের বাড়ী যায়, তারাও পরিতৃপ্ত হয়ে তার আস্বাদ গ্রহণ করে। নিশির শ্বশুর বাড়ীর এক ঘর পরেই আয়েশাদের বাড়ী। অলস দুপুরে মাঝে মাঝেই আয়েশার আঁচলের আড়ালে নিয়ে আসা আমের না হলে চালতার আচারের স্বাদ জিবে নিয়ে দুই সখী মিলে নিচু স্বরে গল্প করে আর হাসতে হাসতে একে অন্যের গায়ে ঢলে পড়ে        
রতনের সাথে বিয়ে হয়ে আসার কয়েক মাস পরেই সেবার পুজার সময় খুব আনন্দ হয়েছিল। ২১ বছরের উথলে পড়া যৌবনে রতনের আদরের রেশ ওর শরীরে মনে ছড়িয়ে আছে। সেবার রতন শহরের বাজার থেকে নূতন শাড়ি, ম্যাচিং কাঁচের চুড়ি আরও কতো কি কিনে নিয়ে এলো বউয়ের জন্য।     
মজা হয়েছিল ব্লাউজ নিয়ে। বাবু বউয়ের জন্য নিজেই সাইজ আন্দাজ করে দুটো ব্লাউজ নিয়ে এলো। হুকুম হল, এক্ষুনি পড়ে দেখাতে হবে। নিশি কিন্তু দেখেই আন্দাজ করেছিল, দুটো ব্লাউজই ছোট হবে। বললও সে কথা।
-   পড়লে দোকানে আর ফেরত নেবে না গো। তুমি এমন করো না তো।    
 কে শোনে কার কথা। “না, ছোট হবে না, তুমি পড়ো তো আগে”।
পড়েছিল নিশি। এ যেন সুনামির ঢেউ আটকাতে বালির বাঁধ দেওয়ার চেষ্টা। ভরাট বুক আরও উথলে উঠল, ব্লাউজের উপরের দিকে দুটো হুক আটকানোই গেল না। অবাধ্য সুডৌল স্তন যুগল রতনের চোখে কামের স্ফুলিঙ্গ জ্বলে ওঠা দেখে একে অন্যের গায়ে ঢলে পড়েছিলএকটানে কামার্ত রতন নুতন ব্লাউজের হুক ছিঁড়ল, উন্মোচিত মুখিয়ে থাকা স্তনবৃন্তে ঠোঁট রাখতেই নিশি নিজেও ভাসল, রতনকেও ভাসাল।            
    তারপরে যত দিন যেতে লাগল, সেই সব সোনা ঝরা দিনগুলির গায়ে ক্রমশ ধূলার আস্তরণ পড়তে শুরু করল।শরত, গ্রীষ্ম, বসন্ত সবই যেন শুষ্ক রুক্ষ পাতাঝরা শীতের মতো হয়ে গেছে দুজনের সম্পর্কের মধ্যে এখন শীতের ঠাণ্ডা কুয়াশা স্থায়ী আস্তানা গেড়ে বসে আছেজাল নিয়ে মাছ ধরতে গেলে দুই তিন দিন বাড়ীতে ফেরে না রতন
(১)

যখন ফেরে ইয়ার দোস্তদের নিয়ে মদ আর জুয়ার আড্ডায় মেতে থাকে। শুধু কখনো সখনো নিজের কাম ক্ষুধা জাগলে নেশার ঘোরে হামলা করে। তারপরে সাপ যেমন বিষ ঢেলে নিস্তেজ হয়ে পড়ে, রতনও তেমনি নিজেকে বিযুক্ত করে অঘোরে ঘুমিয়ে পড়ে। নিশির সাধ,আহ্লাদ,ইচ্ছে অনিচ্ছে শীতল বিছানায় গুমরে গুমরে কাঁদে। নির্ঘুম রাতে দীর্ঘশ্বাস আর লুকানো চোখের জলের সঙ্গমে ভোর আসে। ও বোঝে একটা বাচ্চা থাকলে হয়তো রতন এমন জীবন বেছে নিত না। ও নিজেও তো মা হবার স্বপ্ন দেখে এসেছে সেই পুতুল খেলার দিনগুলো থেকে।     
 চার বছরের বেশী হয়ে পাঁচ পূর্ণ হতে চলল, নিশির বাচ্চা হয়নি উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত শিক্ষিত দম্পতিদের মতো ওরা হিসেব করে অথবা গর্ভ-নিরোধকের কড়া প্রহরা নিয়ে সঙ্গমে রত হয় না। তবুও নিশি মা হতে পারল না। গোঁড়া পুরুষ শাসিত সমাজে এর সব দায় মেয়েদের উপরেই চাপিয়ে দেওয়া হয়, নিশির ক্ষেত্রেও এর ব্যাতিক্রম হল না। বাচ্চা না হলে সেটা মেয়েদের শারীরিক ত্রুটিই একমাত্র কার, অন্য কিছু না এই সতঃসিদ্ধ কিন্তু অনেকাংশে ভ্রান্ত ধারনা এখনও দেশের অনেক অংশে বিরাজ করছে। বিত্তবান শিক্ষিত সমাজে ডাক্তার বদ্যি করেজানতে পারে কি কারণে এই বন্ধ্যাত্ব, সময় মত চিকিৎসা হলে সুফলও পাওয়া যায়। অনেক ক্ষেত্রে ছেলেদেরও স্পার্ম কাউন্ট কম থাকার কারণে গর্ভে সন্তান আসে না। তারপরেও বাচ্চা নাহলে এখন উন্নত বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় বাচ্চা আনা যায় নতুবা অ্যাডপ্ট করেও সন্তান সুখ পাওয়া যায় কিন্তু অভাগা পোড়ার দেশে এখনো দরিদ্র, অশিক্ষিত গ্রামাঞ্চলে এই সব ভাবনা এবং তার বাস্তবায়ন রূপকথার গল্পের মতো। ঠিক যেমন রতন আর রতনের মায়েরও বদ্ধ মুল ধারণা, নিশি বাঁজা, তার বাচ্চা হবার নয়। এলাকায় শিশির ডাক্তার এমবিবিএস। তাছাড়া জঙ্গিপুরে সাব-ডিভিসনাল হাসপাতাল আছে। সেখানে সপ্তাহে তিনদিন গাইনোকোলজিস্ট আসে। ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে রতনের বুকের মধ্যে থাকা নিশি আকারে ইঙ্গিতে শিশির ডাক্তার নতুবা হাসপাতালে গিয়ে দেখানোর কথা বলেছে। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে রতন উদাসিন থেকেছে। ##               
বিষিয়ে গেছে নিশির প্রাত্যাহিক জীবন। আরও বিষিয়ে দিয়েছে রতনের মা সারাক্ষণ গঞ্জনা, উঠতে বসতে কথার মধ্যে কেউটে সাপের বিষ ঢালে।   
“মাগীর পেট ধরার খেমতা নাই, ঘোমটা টেনে চলে”। 
“আমি ঘোমটা খুললে তোর ছেলের কি দশা হবে রে শয়তান আধা কানি বুড়ি? তোর ছেলের বন্ধুরাই তো সারাক্ষণ ছুতো খোঁজে কাছে আসার। সামলাতে পারবি তখন?”- নাহ, নিশি মুখে বলে না, মনে মনে বলে।
কথাটা মিথ্যে ভাবে নি নিশি। রতনের দুই একজন বন্ধু আছে, ঘনিষ্ঠ হবার ছুতো খোঁজে রতন যতো বেশী মদ, জুয়ায় আসক্ত হয়েছে, এদের ছুঁক ছুঁকানি আরও বেড়েছে। তাদের মধ্যে রতনের চেলা সুবলও আছে।সারাক্ষণ ওর দুই চোখের দৃষ্টি নিশির সামনে পিছনে ঘুরে বেড়ায়।তবে অন্যদের চোখে যে লোভীর দৃষ্টি থাকে, সুবলের দৃষ্টিতে সেটা বেশী দেখে না, থাকে এক ধরনের মুগ্ধতা, কিছুটা সহানুভুতিও।

(২)
কারণ নিশির শাশুড়ি এখন অনেক সময় ছেলের বন্ধুদের সামনেই নিশিকে অপমান করতে ছাড়েনা। সুযোগ পেলেই সুবল একা আসে, রতনদার খোঁজে। নিশি জানে, সুবল জেনেই এসেছে তার রতনদা এখন বাড়ীতে নেই। আর এলেই হাতে করে কিছু নিয়ে আসে, কখনও মাছ দিয়ে যায়। কখনও গরম চপ অথবা মুড়ি নিয়ে এসে বলে, “একটু চা পেলে হত। তোমার হাতের চায়ের স্বাদই আলাদা”- বলেই একগাল হাসে নির্লজ্জের মতো। সুবল মাঝে মাঝে জুয়া খেলে বটে তবে মদ খায় না। রতনের কাছেই নিশি শুনেছে, ওর হাতে মাছ ভাল ধরা পড়ে, জাল ছোড়ার হাত খুব ভাল।   
এক এক সময় নিশিও প্রগলভ হয়ে বলে, “এইবার একটা টুকটুকে লাল পানা দেখে বউ নিয়ে আসলেই তো হয়। তার হাতের চা অনেক বেশী মিষ্টি হবে”।
আস্কারা পেয়ে সুবলও তরল কণ্ঠে বলে, “তোমার হাতের চা খেয়ে, আর কারুর হাতের চা ভাল লাগবে না যে”।
- বাঁজা মেয়েছেলের হাতে কিছু খেতে নেই     
আচম্বিতে নিশির মুখে এমন শুনে, এক অব্যাক্ত ব্যাথায় নীল হয়ে যায় সুবল। কালো মুখে ফিরে যাবার উদ্যোগ নিলে, নিশির সম্বিৎ ফেরে, মায়া হয়। অস্ফুটে বলে, “বসো, চা খেয়ে যাও। তবে ঘরে দুধ নেই, লাল চা খেতে হবে”- বলেই আঁচল টেনে যৌবন ঢাকে নিশি কারণ ও জানে দাওয়ায় বসে সুবলের মুগ্ধ দৃষ্টি মলিন ব্লাউজে ঢাকা ওর চড়াই উৎরাইতে ঘুরে বেড়াবে। প্রথম দিকে নিশির অস্বস্তি হোত, এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। মনের অন্দরে কিছু লালিমাও কি অনুভব করে নিশি? একটা শিরশিরে ভাল লাগার চোরা স্রোত বয়ে যায়, একটা চাপা ঢিপঢিপ হয় বুকের মধ্যে। এক অজানা নিষিদ্ধ শিহরণ। কিন্তু আজন্ম লালিত সংস্কার এবং স্বভাবগত সংযম সেই ভালো লাগাকে অচিরেই পরাস্ত করে। কিছু চাপা দীর্ঘশ্বাস বাতাসে মিশে যায়।       
##
ওঝা ডেকে ঝাড় ফুঁক করিয়েছিল রতন ওই শয়তানী বুড়িটার পরামর্শে। সেও আর এক বিড়ম্বনা। আশপাশের মেয়ে ঝিরা ভিড় করে তামাসা দেখেছিল, মেয়েদের অপমান মেয়েরাই উপভোগ করে বেশী। দুই একজন বয়স্কা ঘোড়েল মহিলারা সহানুভূতির নামে কথার ফুলঝুরি ছুটিয়ে ছিল। আর নিশির যৌবন ওঝার দুই চোখে্র লালসার লেলিহান আঁচে পুড়ে ছাই হয়েছিল।  
এতো কিছুর পরেও যখন কিছু হোল না, শাশুড়ির মুখের আগুন আরও তীব্র আকার ধারন করেছিল।  
“স্বয়ং শিবেরও অসাধ্যি এই বাঁজা মাগীর পেটে সন্তান আনবে। আমার ছেলেটার জীবন ঝালাপালা করে দিল গো এই বাঁজা মাগী”।
প্রথম দিকে রতনের মা ছেলের আড়ালে খোঁচা দিত।এখন তো র সামনেই গলা চড়িয়ে যা মুখে আসে, তাই বলে। ছেলের নীরবতায় মায়ের হিংস্রতা যেন আরও বেড়েছে। প্রথম দিকে নিশি শাশুড়ির এই ঠেস দেওয়া কথা শুনে রতনের মুখের দিকে চাইত, একটা অসম্মতির আভাষ দেখা যেত রতনের বিব্রত দৃষ্টিতে নতুবা বিরক্ত হয়ে মাকে থামার জন্য ধমক দিত, যার ফলে বুড়ি একটা মাত্রা রাখত, থেমে যেত আর চাপা স্বরে গজগজ করত। কিন্তু ওঝার ঝাড় ফুঁকের পরে বুড়ীর অত্যাচার সীমাহীন হয়ে উঠল।
(৩)
তোর আর বাপ হওয়া কপালে লেখা নেই রে রতন। বংশের মুখে বাতি দেবার আর কেউ রইল না রে, বেটা। এই বাঁজাটাকে বাপের বাড়ী দিয়ে আয়। তোর আমি আবার বে দেব। আমারও নাতি পুতির শখ আর মিটল না হায় রে সব আমার পোড়া কপাল”।
নিশি অবাক হয়ে রতনের পরিবর্তন লক্ষ্য করে। চাউনিতে যেন মায়ের বলা খেউর গুলির প্রতি নীরব সমর্থন নিজের মানুষটার এই নিষ্ঠুর নির্লিপ্ত ব্যাবহারে এক অব্যাক্ত ব্যথায় নীল হয়ে যায় নিশি। অন্তত আগের মতো মাকে থামতে তো বলতে পারে। কারণ নিশির অবচেতন মনে একটা দৃঢ় ধারনা বদ্ধমূল হয়ে আছে ওর বাচ্চা না হবার পেছনে ওর কোন খুঁত নেই, রতনের কোন সমস্যা আছে যদিও নিশির মতো প্রায় অশিক্ষিত একজন গ্রাম্য বধূর পক্ষে নিজের মনে গাঁথা এই ধারণার পক্ষে কোন জোরালো যুক্তিও নেই। কারণ সেই অর্থে রতনের পুরুষত্বে কোন খামতি নেই, তাহলে সঙ্গমে রত হতে পারত না।
নিশিরও সহ্যের বাঁধ ভাঙছে। আগে মুখ বুজে সব হজম করত শাশুড়ির লাঞ্ছনা গঞ্জনা। এখন মুখে মুখে তর্ক করে। বুড়ী এতে আরও ক্ষেপে যায়। তেড়ে মারতে আসে।
-      লাথি মেরে তোকে তাড়িয়ে দেব, বাঁজা মেয়েছেলে। বাপটাও একটা পোড়ারমুখো শয়তান।একটা অজন্মাকে আমার ছেলের ঘাড়ে গচিয়ে দিয়েছে।
-   খবরদার বাপ তুলবে না তুমি। আমার বাপকে গালি দেবে না। ##
রতন এবার বেশ কয়েকদিন পরে গেল মাছ ধরতে, পরের দিন কিম্বা তার পরের দিন ফিরবে। ঘরের ভাঁড়ারেও টান পড়েছে।জুয়ার নেশাটা বেড়ে গেছে, বেড়ে গেছে মদ খাওয়াও। সকাল থেকেই ঝিরঝিরে বৃষ্টি পড়ছে। বর্ষার জল ভরা মেঘগুলো যেন এক পশলা জোর বর্ষণের জন্য মুখিয়ে আছে। মাঝে মাঝেই বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আকাশের বুক চিরে।নিশির মনেও আজ ঘনঘোর আঁধার। রতনের মা আজ নিশির গায়ে হাত তুলেছে।সকাল থেকেই বুড়ী গজগজ করছিল। এক চোখ কানা কিন্তু ছেলের ব্যাপারে পুরোপুরি অন্ধ। ছেলের যে এখন রোজগারপাতিতে মন নেই সেই নিয়েও যেন নিশিই দায়ী, ছেলেকে একটি কথাও বলবে না।
-   ঘরে বসে বসে গতর না বাঁচিয়ে, জলার ধার থেকে দুটো কলমি কুড়িয়ে আনলে কি মাগীর গতরে টান পড়বে?
-   এক চোখ কানা হয়েছে না পুরো দুই চোখই গেছে? দেখছ না আকাশের কি অবস্থা?
-   ওহ! ছেনালটার আবার চোপা আছে। কোন লাট সাহেবের বেটি এলো রে। বর্ষার সময় বর্ষা হবে না তো কি সোনা ফলবে? হারামির বেটি হারামজাদী।
-   শয়তান বুড়ী, আবার আমার বাপকে গালি দিচ্ছ? পারব না আমি। আমি যদি পান্তা ভাত খেয়ে থাকতে পারি, তুমিও তাই খাবে।
-   কি বললি রে হারামির বেটি বাঁজা?
-   আমি বাঁজা না, তোমার ছেলে ধজা। আর ছেনাল কাকে বললে? আমি ছেনাল পনা শুরু করলে, তুমি আর তোমার ছেলে সামলাতে পারবে?
(৪)
 শেষের এই কথাটা বলে এক লহমার জন্য হলেও নিশির নিজেরই খারাপ লাগল মনে হোল, এইটা কি বলে ফেললাম? লোকটা ঘরে নেই, নদীতে গেছে। পেছনে গালি দিলে, যদি কোন বিপদ হয়? আর যাই হোক তার স্বামী তো সরাসরি তাকে এই নিয়ে গাল মন্দ করেনি, খোঁটাও দেয় না। মনে মনে বাবা মহাদেবের কাছে ক্ষমা চাইল, “ও বাবা মহাদেব, এইবারের মতো ক্ষমা ঘেন্না করে দাও। ঘরের মানুষটা ভালয় ভালয় ফিরে আসুক...”। আরও কিছু বলতে চাইছিল, হঠাৎ ঘাড়ের নীচে পিঠের দিকে একটা তীব্র জ্বালায় “মা গো!” বলে শিউরে উঠল।       
রতনের মা ছেলের বউয়ের এই মারমুখি ব্যবহারে সেই মুহূর্তে থমকে গেলেও, কখন যে জ্বলন্ত উনুন থেকে একটা সরু আধ পোড়া ডাল তুলে নিয়েছে, ক্ষণিকের জন্য অন্যমনস্ক হওয়া নিশি খেয়াল করে নি।
আচমকা আঘাতে ফণা তোলা সর্পিণীর মতো অসহনীয় ক্রোধে পাল্টা আঘাত করতে গিয়েও থেমে গেল নিশি। বাপের বাড়ীতে শেখানো সহবৎ এবং ছোট বেলা থেকে মায়ের পাখী পড়ার মতো মানিয়ে নেওয়ার বুলি প্রত্যাঘাতের অন্তরায় হয়ে দাঁড়াল। তারপরেই তড়িৎ গতিতে ঘর থেকে বেরিয়ে উদভ্রান্তের মতো হাঁটতে লাগলো। ##
একটা ঘোরের মধ্যে হেঁটে যাচ্ছিল নিশি। অবচেতন মনে রেল লাইনের ধারে এসে এক মুহূর্ত থমকাল। বৃষ্টির ছাঁট আরও বেড়েছে। বেশ খানিকটা হাঁটার ফলেই বোধ হয় দুচোখের অঙ্গার কিছুটা নিভে এসেছিল। বৃষ্টির ঠাণ্ডা জল পড়ে পিঠের দিকে আঘাতের জ্বালাটাও একটু কম মনে হোল কি? কিন্তু ভেতরের জ্বালা যে নিভছে না কিছুতেই।
রেল লাইনের ওপাড়ে একটা ঢাল নেমে গেছে। সেটা দিয়ে নেমে গেলেই খালের ধারে অনেকটা ফাঁকা জমি। গরু, ছাগল গুলো চড়ে বেড়ায়-কচি ঘাস খাবার তাগিদে।
মাঠের ধারে খালটার কাছে একটা ভাঙ্গা কুঁড়ে ঘর আছে। কে বানিয়েছে, কবে বানিয়েছে নিশির জানা নেই। হয়তো যারা গরু ছাগল চড়াতে আসে, তারাই বানিয়েছে। চালার খড় সরে গেলে তারাই হয়তো আবার খড়ের ছাউনি দিয়ে দেয় ।
আগে প্রায়ই আসত নিশি এখানে কলমি,ঢেঁকি আর লতি কুঁড়োতে। কিন্তু সেবার লতি কুড়িয়ে ঠা ঠা রোদ্দুরের হাত থেকে একটু জিড়োতে ওই কুঁড়েঘরে ঢুকতে গিয়েই স্থির হয়ে গেছিল নিশি। দুই পায়ে যেন লোহার বেড়ি পড়িয়ে দিয়েছিল কেউ। ঠিক ঘরের মধ্যিখানে দুটো ইয়া বড় সাপের শঙ্খ লেগে আছে। কি পরম আবেশে একটা আর একটাকে পেঁচিয়ে ধরে হেলে দুলে সঙ্গম রত হয়ে আছে। নিশির মনে হোল, ওদের দুই জোড়া চোখ ওর উপরে পড়েছে। নিশিও গ্রামের মেয়ে, একটা দাঁড়াস হলেও আর একটা যে বিষাক্ত গোখরো সেটা বুঝতে এতটুকু অসুবিধা হয়নি ওর। ভয়ে সম্মোহিতের মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষন পড়ে সম্বিৎ ফিরে আসতে ওদের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে গুটি গুটি পায়ে পিছিয়ে এসে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় লাগিয়েছিল নিশি। তারপরে অনেক দিন আর ওই মুখো হয়নি ও। খালের ধারে এসে কোন মতে তাড়াতাড়ি শাক পাতা কুড়িয়েই ত্রস্ত পায়ে চলে যেত। কিন্তু ওই ঘটনার আগে মাঝে মাঝেই ওই কুঁড়েঘরে এসে বসত, বিশেষ করে মন খারাপ হলে। কখনও নিরালায় চোখের জল ফেলত, কখনও নিজের মতো একান্তে কিছু সময় কাটাত। তারপরে একটু ধাতস্থ হয়ে বাড়ীর পথ ধরত।
(৫)
আজ মনের এক অস্থির টালমাটাল অবস্থায় সেই ভীতি অনুভব করল না। তাছাড়া বৃষ্টির তীব্রতা বাড়াতে আর সেইসাথে মাঝে মাঝেই আকাশ চিরে বিদ্যুতের ঝলকানিতে বাধ্য হল ওই ঘরে আশ্রয় নিতে। শরীর ভিজে গিয়ে পরনের শাড়ীটাও এমন লেপটে গেছে, যে একটা অস্বস্তি হচ্ছিল, যদিও এই দুর্যোগে চরাচর জনমানবশূন্য হয়ে আছে।
ভেজা শরীরে একটু হাল্কা ঠাণ্ডার শিরশিরানি অনুভব করল ব্লাউজটাও আজ ছেঁড়া অনেকটাই। আঘাতের জ্বালাটা আবার চিড়বিড় করে উঠল।আঁচলটা বুকের কাছে নামিয়ে আলগোছে আঘাতের জায়গাটায় হাত রাখল। যতটা না জ্বালা,তার চেয়ে বেশী লাঞ্ছনা আর অপমানের জ্বালায় দুই চোখ ফেটে জল এলো। ক্লান্তি, শ্রান্তিতে নিশি হাঁটু মুড়ে স্নায়ুবৎ বসে রইল ওই অবস্থায়।    
-   তুমি এখানে কি করছ? একি? তোমার পিঠে ওটা কিসের দাগ?
ধড়ফড় করে চমকে পিছনে তাকাল নিশি, কুঁড়েঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে সুবল। ত্রস্ত, অভস্ত্য হাতে আঁচল কুড়িয়ে খানিক উন্মুক্ত ভেজা বুক ঢেকে উঠে দাঁড়াল। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ে এক ঝলকের মতো সন্দেহ উঁকি দিল, সুবল কি ওকে অনুসরণ করে এখানে এসেছে? কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে সুবল নিজেই বলল, “আমি তোমাদের বাড়ীর দিকেই যাচ্ছিলাম, বাড়ীর কাছে আসতেই দেখলাম, তুমি কেমন পাগলের মতো দৌড়ে বেড়িয়ে গেলে”।
-   তারপরে আমার পিছু পিছু এখানে এসেছ?
-   হ্যা, তোমারে মিথ্যা কথা বলব না। বলেই একটা ফিচেল হাসি হেসে নিশির কাছে এলো
-   বললে না তো, পিঠে কি হয়েছে? কাকী মেরেছে?
নিশি কোন উত্তর না দিয়ে সুবলের দিকে তাকাল। ওর দুচোখে নিজের সর্বনাশের ছায়া দেখল? সুবলের চোখের দৃষ্টি আজ যেন অন্য রকম সেই মুগ্ধতা নেই, আছে দাউদাউ করে জ্বলে ওঠা গনগনে আগু্নের লেলিহান শিখা। নিশি্র শরীরে, মনেও কি সেই নিষিদ্ধ অনুভূতির হাতছানি? বুকের মধ্যে উত্তাল সাগরের উথাল পাথাল ঢেউ যেন সুবলের চোখে জ্বলা অঙ্গারকে পাল্টা দমকা এক প্লাবনে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চায় নিশির নিজের মধ্যে এক প্রবল টানাপোড়েন চলছে। প্রবল বন্যায় যেমন জলঙ্গির পাড় ভাঙ্গে, নিশিও ভাঙছে। দরজায় আছড়ে পড়া ঝড়ের তাণ্ডব আর সেই দরজা অক্ষত রাখার তুমুল এক অদৃশ্য লড়াই।       
-   দেখি, কি হয়েছে, ঘুরে দাঁড়াও তো।
-   কিছু হয় নি।
-   আহ! মিথ্যা বোল না আমাকে

সুবল আরও কাছে এসে সবল দুই হাত রাখল নিশির দুই কাঁধে। এত কাছে যে সুবলের বিড়ি খাওয়া ঘন শ্বাস নিশির মুখে, নাকে ঝাপটা দিল। ওকে খানিকটা জোর করে ঘুরিয়ে দিয়ে, পিঠের থেকে আঁচল সরিয়ে দিল। নিশির ফর্সা পিঠের দিকে খানিকটা জুড়ে আড়াআড়ি একটা বাদামী দাগ।
-   ইস! এতো পুড়ে গেছে
(৭)
 পরম মমতায় সুবল নরম করে হাত রাখল আঘাতের জায়গায় কিন্তু সেই ছোঁয়া আসলে ঠাণ্ডা বরফের মতো ছুঁয়ে দিল নিশির মনের অন্দরে। বাইরের বৃষ্টির মতো,ওর চোখ ভাসিয়ে আবার বৃষ্টি নামল। সব আগল ভেঙ্গে চৌচির। চকিতে ঘুরে গিয়ে সুবলের পুরুষালি বুকে আছড়ে পড়ল নিশি সুবলের দুহাত আঁকড়ে ধরল নিশির থরথর করে কাঁপতে থাকা ভেজা শরীর পিঠে অনুভব করল নিশির আকুল হয়ে ধরা দুটো হাত। শান্ত হতে দিল কিছু সময়, তারপরে একহাতে বুকের মধ্যে চেপে ধরে আর এক হাত দিয়ে ওর থুঁতনি তুলে ধরে মুখ নামিয়ে আনল। দু চোখ বন্ধ, ঈষৎ খোলা ঠোঁটের আহ্বানে নিজের ঠোঁট চেপে ধরে সাড়া দিল সুবল। লতি কুড়ানো নিশি নিজেই নরম লতির মতো নিজের দেহ মিশিয়ে দিল সুবলের ঘামের গন্ধ মাখা পুরুষালী দেহের সাথে। সুবলের রুক্ষ হাত অস্থির হয়ে ওর নরম পেলব স্তন পেষণ করতেই দুটো দেহে জোয়ার এলো। নিশিকে উন্মোচিত করতে করতে সুবল খুব যত্ন করে ওকে মেঝেতে শুইয়ে দিল। অস্থির রুক্ষ হাত আর আগ্রাসী চুমু নিশির নগ্ন দেহের সর্বত্র অবাধে ঘুরে বেড়াতে লাগল। এক ঘোর দুর্যোগপূর্ণ, বর্ষণ মুখর দিনে ওই কুঁড়েঘর আবার শঙ্খ লাগা দেখল তফাত শুধু, এবার কোন সাপের নয়, সমস্ত আবরণ মুক্ত দুটো উন্মত্ত মানব দেহের। সুবলের নগ্ন দেহের নীচে নিষ্পেষিত হতে হতে বিদ্যুৎ ঝলকানোর মতো এক লহমায় রতনের মুখটা মনে পড়ল নিশির কিন্তু নিমেষে তা মিলিয়ে গেলো।
ভেতর থেকে কেউ যেন বলল,“ নে, সুবল আজ প্রাণভরে এই বন্ধ্যা জমিতে তুই চাষ কর। আজ তুই জেলে না, আজ তুই চাষি। একদিনের জন্যে আমার এই বাঁজা শরীর তোকে দিলাম, তুই ইচ্ছে মতো বীজ পোত, লাঙ্গল চালা, যতো খুশি চষে নে। এই জমিতে ফসল ফলা।  
শুধু অনেক দিনের অভুক্ত শরীর, মনের খিদে নয়, আজ যেন নিজেকে যাচাই করার একটা দায় নিশির। আবেগে, আশ্লেষে ভেসে যাওয়া নিশি শীৎকার করতে করতে সুবলের পিঠ থেকে কোমর হয়ে নিতম্ব খামচে ধরে নিজের বানভাসি জঙ্ঘায় চেপে ধরল।
সব ঝড়ই থেমে যায় একসময়। দুটো উন্মত্ত শরীরের হঠাৎ আসা ঝড়ও থেমে গেলো। তড়িৎ হাতে পাশে পড়ে থাকা কাপড় পড়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল নিশি।
-   আর কখনও আমার সাথে দেখা করবে না। এটা হঠাৎ হয়ে গেছে।
অযাচিত ভাবে পাওয়া কাঙ্খিত নারীর আত্মসমর্পণের এবং পরম পাওনার পর মুহূর্তেই এই রুঢ়, বিপরীত আচরণে সুবল বিমূঢ় হতচকিত হয়ে গেল ফ্যালফেলে দৃষ্টি মেলে বলল,“ কেন?এরকম বলছ কেন? আমি তোমাকে ভালবাসি”।    
-   আমি তোমাকে ভালবাসি না, আমার স্বামীকে ভালবাসি। বললাম তো, এটা হয়ে গেছে। এটা ভালো হল না। আর হবে না। এটা মনে রেখ।     
এই বলে আর এক মুহূর্ত দাঁড়াল না, দ্রুত পায়ে বেড়িয়ে গেলো হতবম্ব সুবলকে একা ফেলে। সুবলের সাথে ওই ঘটনার পরের দিন রতন ফিরে এসেছিল খুব খুশি মনে কারণ এবার প্রচুর মাছ ধরা পড়েছিল, ভালো টাকা পেয়েছিল মহাজনের কাছে থেকে। নিশিও আগে যা কোনদিন করেনি, সেদিন রাতে বিছানায় নিজে থেকেই ছলাকলায় রতনকে আবিষ্ট করে উপগত হতে বাধ্য করেছিল।
(৮)
সঙ্গম শেষে রতন একটু হেসে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘কি ব্যাপার, আজ আমার বউটাকে দেখছি অন্যরকম লাগছে”। নিজের নগ্ন দেহটাকে রতিক্লান্ত রতনের বুকের ওপর রেখে বলল, “আজ যে শুভ দিন। কেন তোমার ভালো লাগেনি?”
-   হুম, ভালো লেগেছে কিন্তু কিসের শুভ দিন?
-   এই যে অনেক ভালো মাছ পেলে, অনেক টাকা রোজগার করলে। তোমার মনটাও খুশি মদ খাও নি আজ, জুয়া খেলতে যাও নি।
-   ওহ! এই জন্য বুঝি পেরাইজ দিলে আমারে?
-   হ্যা তো।  ##
শরত চলে গিয়ে বাতাসে হেমন্তের গন্ধ তবুও এখনও যেন প্রকৃতিতে শরতের সেই ছোঁয়া রয়ে গেছে নীল আকাশের উঠোনে সাদা পেঁজা তুলোর মতো মেঘেদের স্ফূর্তি। চারদিকে এখনও একটা উৎসব উৎসব আমেজ। আসলে নিশির মনে সেই ভালো লাগাটা আবার ফিরে এসেছে। সেই রাতে ঘনিষ্ঠতার শেষে নিশির পিঠে আঘাতের দাগ দেখে রতন জিজ্ঞাসা করেছিল, নিশি এড়িয়ে গেছিল। কিন্তু রতন কিছু একটা আন্দাজ করেছিল এবং নিশির অজ্ঞাতে মাকেও নিশ্চয় খুব শাসিয়েছে কারণ রতনের মা তারপর থেকে নিশ্চুপ হয়ে গেছে, কেমন যেন একটা হতবাক চাউনি মেলে নিশিকে দেখে। রতনের মা জানে না যে পরিস্থিতির থেকে বড় শিক্ষক কেউ নেই। সময়, পরিস্থিতি মানুষকে শক্তিশালী করে, অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ করে শিক্ষিত করে তোলে। কোন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী না থাকলেও, সবার অজ্ঞাতে নিশি পরিস্থিতিকে নিজের মত করে সাজিয়ে গুছিয়ে শিক্ষিতা হয়েছে।   
নিশির সারা শরীরে এখন একটা ঝিমঝিমে ভাব থাকে সব সময়। কাজে কম্মে মন লাগে না, শিথিল ভাব। উবু হয়ে দাওয়ায় বসতে যেতেই, নিজের শরীরের ভিতরে আর একটা ছোট্ট প্রাণ নড়েচড়ে উঠল। পরম মমতায় নিজের তলপেটে হাত রাখল নিশি গোধূলির সূর্যটা পশ্চিম আকাশে ডুবে যাবার আগে একটা নরম মিঠে আলো ওর মুখে ছড়িয়ে দিয়ে গেলো

No comments:

Post a Comment

একনজরে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"ইস্কুল বলিতে আমরা যাহা বুঝি সে একটা শিক্ষা দিবার কল। মাস্টার এই কারখানার একটা অংশ। সাড়ে দশটার সময় ঘণ্টা বাজাইয়া কারখানা খোলে। ...