রবিবার। অন্যদিনের তুলনায় সকাল একটু দেরিতেই শুরু হয়েছে। সারাদিন জুড়ে থাকে ব্যস্ততার মধ্যেও আলস্যের ঘ্যানঘ্যানানি। এক কাপ চা আর খবরের কাগজ নিয়ে বসেছি। নজরে এল শিক্ষক দিবস বিষয়ে একটি লেখা। নিজে শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত থাকায় স্কুলেও ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ফিসফিসানি উচ্ছ্বাসের আভাস পাচ্ছি গত কয়েকদিন ধরে।
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে জানালার বাইরে তাকালাম। বাইরে মেঘ-বৃষ্টির খুনসুটি। শরৎকালে যা হয় আর কি। তবে আমি কিন্তু অতীতের অলিগলি জুড়ে বিচরণ করতে আরম্ভ করেছি। ষোল আনা জীবনের এক আনা কেটেছে ওপার বাংলায়। খুব ছোটবেলাতেই বাবার হাত ধরে সীমান্ত পেরিয়ে এসেছি। আমার পঠন-পাঠন পাকাপাকিভাবে শুরু হয় এপার বাংলায়। আমার জীবনের প্রথম শিক্ষিকা ছিলেনকল্পনা চ্যাটার্জী। বয়স তখন কতই বা হবে? বেশি হলে বছর দুই-আড়াই। আমি অস্ফুট কথার ফুলঝরি। মা শখ করে দিদিমনি রেখেছেন, প্রাথমিক শিক্ষা লাভ হয় যাতে।
আজ মধ্যগগনে এসে আমার প্রথম গৃহ শিক্ষিকার চেহারা মাথা খুঁটেও স্মৃতিতে এলো না। অথচ একটা ঝাপসা শীর্ণকায়া অবয়ব চোখের সামনে পর্দার মতো দুলতে থাকে। ভাড়াবাড়ির ছোট বারান্দায় বিকেলে দিদিমনি এলে মা মাদুর পেতে দিতেন। প্রথম কয়েকদিন ভালই পড়েছি। তারপরই বাঁধল গন্ডগোল। উস্কোখুস্কো উদাসীন চেহারার জন্য তাঁকে সবাই ‘পাগলি দিদিমনি’ বলতেন। আশেপাশের আমার সমবয়সী ও একটু বড় ছেলেমেয়েরা যখন ব্যঙ্গার্থক হাসির সঙ্গে বলতে লাগল, "এমা, তুই ওই পাগলিদিদিমনির কাছে পড়িস?" ব্যস্, কাজ হতে ওটুকু দাওয়াই-ই ছিল যথেষ্ট।
এবারে বিকেল হলেই আমি পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসতাম। "পাগলিদিদিমনির কাছে পড়বো না।" কোনও ভাবেই মা আমার জেদকে কব্জা করতে পারতেন না। দিনের পর দিন এই ঘটনা তো চলতে পারে না। কিছুদিন পরে দিদিমনি বিকেল হলে আর পড়াতে আসতেন না।
কেটে গিয়েছে দীর্ঘ বছর। এদেশে ঠাকুরমা হাত ধরেই বর্ণপরিচয়,ধারাপাতের গন্ডী পেরিয়ে এসেছি। ঠাকুরমার মুখেই মেয়েদের ব্রতকথা,রামায়ণ, মহাভারত শুনতে শুনতে বড় হয়ে উঠেছি। ঠাকুরমা হাত ধরে শ্লেটে লেখাও শিখিয়েছেন। টুকটাক খবরের কাগজের হেড লাইন পড়তে শিখিয়েছেন। আমাদের একান্নবর্তী পরিবারে আচার শৃঙ্খলাও ছিল যথেষ্ট কড়া। পড়াশোনার বিষয় যথেষ্ট নজরদাড়ি। তখন একটাই ধারনা ছিল শিক্ষা নিজের পায়ে দাঁড় করায়, ভাল করে পড়াশোনা করতে হবে। একটা সময়ের পর আমাকে আর পড়তে হবে না। এত দীর্ঘ সময়ে অনেক গৃহ শিক্ষকের হাত ধরে সাঁকো পার হয়েছি।
পরে মায়ের কাছে আমার প্রথম গৃহশিক্ষক কল্পনা চ্যাটার্জীর কথা শুনেছি। মা জানিয়েছিলেন যে তিনি উচ্চশিক্ষিত ছিলেন এবং পরিষ্কার ভাষায় কথা বলতেন। দিদিমনির এই কথা বলার ধরনটাই মায়ের প্রথম পছন্দের বিষয় ছিল। একটি স্কুলেপড়াতেন তিনি। তবে কারও কারও ক্ষেত্রে ভগবান অনেক সময় সুখের ভাগটা কমই লেখেন বা ভুলেও যান। অল্প বয়সে দিদিমনির স্বামীর মৃত্যু হয়। শুধু তাই-ই নয়, কিছুদিন পরে একমাত্র সন্তানকেও তিনি হারিছিলেন। তাই তাঁর চেহারায় অমন উদাসীনতার বসবাস ছিল।
মোচড় দিয়ে ওঠে ভেতরটা। তোলপাড় করতে থাকে বিবেক।মানুষটার একাকীত্ব, নিঃসঙ্গতা আমাকে ধাক্কা দেয়। অথচ আমি নিঃশ্চুপ। ভিজে মুড়ির মতো চুপসে যেতে থাকি। তাকে ফিরে পাওয়াও সম্ভব নয়। এভাবেই অজান্তে হারিয়ে যায় অনেক দামি কিছু। বেঁচে থাকে স্মৃতি। আমার প্রথম দিদিমনিকে পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করি।
চায়ের ধোঁয়ার মতো অস্বচ্ছ অবয়বে মিশে থাকে আমার জীবনশিক্ষা, আমার বোধ।
No comments:
Post a Comment