কত আর হবে, বড় জোর নয় বা দশ। পুুরী যাচ্ছি। প্রথমবার সমুদ্র। স্বর্গদ্বারের কাছাকাছি আসতেই বাতাসে অন্যরকম গন্ধ। একটু পরেই তেরছা করে বেরিয়ে এলো একরাশ ফটফটে ঢেউ। রিক্সার সিট থেকে লাফিয়ে উঠলাম। তখন বেশ ভোর। নরম আলো। ফাঁকা বিচ। খুব বেশি কিছু বোঝার মতো বুদ্ধি তো তখন হয়নি। তবু আমার নিজস্ব জগতে, যেখানে মশগুল থাকতাম দিনরাত - একটা ওলটপালট ঘটে গেল।
আমি দেখেছি, আকাশে পাখি ওড়ে। দাদাভাই রঙবেরঙের ঘুড়ি ওড়ায়, আমি লাটাই ধরে থাকি। ক্লাসরুমের জানলা দিয়ে ঠেলাঠেলি করে মুখ বাড়িয়ে উড়োজাহাজের শব্দ খুঁজি। গরমের দিনে রাতে খাওয়া দাওয়ার পর ছাদে মাদুর বিছিয়ে কিছুটা সময় চিত হয়ে রূপকথার দোশে ঘুরতে যাই। আমার মনে হতো, ঝুমকিদের বাড়ির টগর গাছটাই কালো আকাশে ফুটে আছে। একটা লম্বা মই পেলে টুপটুপ করে সাজিতে ভরে ফেলবো। এই তো ছিল আমার আকাশ আর মেঘেদের ঘরবাড়ি। এখন দেখছি আকাশটা ধীরে ধীরে নেমে এসেছে সমুদ্রের গায়ে আর সমুদ্র উঠে গেছে আকাশের উপর। আমার বিস্ময় যেন কাটতেই চায় না। এত, এত বড় যে একটা কিছু আছে, বিশ্বাসই হচ্ছিল না। আমাদের মফস্বলে রানীপার্কের রাজাতলা, দুপাশ দিয়ে পনেরো ষোলোটা বাড়ি, চেনা আম জাম গাছ, কাকু জেঠু কাকিমারা- চারপাশের এই উষ্ণ বলয়টা থেকে হঠাতই যেন ছিটকে বেরিয়ে এলাম। আমার নিজস্ব আকাশের ভিতর তৈরি হল আরও একটা পৃথিবী। বাড়ি ফিরেই ঢেউ ফেনা বালি ঝাউগাছ জেলেডিঙি নিয়ে লিখে ফেললাম কয়েক লাইন। সেই প্রথম সতেরোর ঘরের নামতা মুখস্ত করার বিরক্তিটা কেটে গেল।
তারপর দেশের নানা বিচে বেড়াতে গেছি। ভালো লেগেছে নিশ্চয়ই। কিন্তু আজও যখন পুরী বেরাতে যাই প্রথম দিনের কথাই মনে পড়ে। সেদিন বুঝতে না পারলেও পরে বুঝেছিলাম- বৃহতের মধ্যে মিশে যাওয়া, একাত্ম হয়ে ওঠার চূড়ান্ত আনন্দ পেয়েছিলাম ওই মুহূর্তে। আমার ক্ষুদ্র অস্তিত্বকে অতিক্রম করে সাঁতার কেটেছিলাম ওই বিশাল জলরাশির গভীরে। সেই ছিল আমার প্রকৃতির কাছে প্রথম পাঠ।
কিছুটা বড় হয়ে উঠছি। তখন ক্লাস এইট। পাহাড় দেখবো। উত্তেজনায় জেগে আছি গোটা রাত। নিউজলপাইগুড়ি থেকে পাকদণ্ডী বেয়ে গাড়ি উঠছে। জমাট কালো কৌতুহলের ভিতর থেকে ভোরের আলোর মতো একটু একটু করে ফুটে উঠছে বিস্ময়। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছি, ছিটকে যাচ্ছি টুকরো টুকরো আমি। না, বুদ্ধি তখনও যে খুব পরিনত হয়েছে তা নয়। তবে যে দৃশ্য আমাকে মুগ্ধ করে, সেই অনুভূতিকে নিজের মধ্যে ধারণ করতে শিখছি। বেলা পড়ে এসেছে। গাড়ি থেকে ম্যালের কাছে নামতেই একরাশ কুয়াশা পথ আটকে দাঁড়াল। কেমন যেন স্যাঁতস্যাঁতে একটা ঠাণ্ডা চেপে ধরল অথচ জুন মাস। আবার আমার আকাশ নেমে এল ঘরবাড়ি ছাদ ল্যাম্পপোস্ট ছুঁয়ে রাস্তায়, মাটিতে পাথরে একেবারে আমার গায়ে। রূপকথা আর আমি তখন একাকার, ভালোবাসায় মাখামাখি।
কোন তাড়া নেই, সকাল থেকে হাঁটছি। একএকটা বাঁকের পর খুলে যাচ্ছে পাহাড়ের রূপ রহস্য আনন্দ। অস্থির হয়ে উঠছি, আরও কি দেখবো নতুন! খাদের দিকে তাকালে নিজেকে রানী বলে মনে হচ্ছে। নীচের ঘর বাড়ি মানুষজন পাইনের সারি যেন আমার নিজের সাম্রাজ্য। হাতে নিয়েছি একটা শুকনো সরু ডাল। মনের সুখে ঘোরাতে ঘোরাতে হাঁটছি। তখন ওটাই আমার রাজদণ্ড। পাহাড়ের গায়ে নির্বিকার ফুটে আছে বুনো গোলাপ, হরেক অজানা ফুল। খানিক দূরে দূরেই রঙবেরঙের প্রজাপতির ঝাঁক নয়ত ফড়িংয়ের ওড়াউড়ি। প্রকৃতি তখন পেখম মেলেছে। আমাকে ডাকছে, ' এসো এসো, আমাদের সঙ্গে তুমিও ময়ূর হও। মনে মনে তো হতে পারো।' সেই প্রথম জানলাম, হয়ত অজান্তেই জানলাম- মনের কোন সীমানা হয় না। প্রকৃতির সঙ্গে মনের কোন আড়াল রইল না আমার।
একটা করে দিন যাচ্ছে, আমিও বড় হচ্ছি। প্রতিমুহূর্তে শিখছি, আমার আধার ভরে উঠছে। স্নাতকোত্তর পড়তে রক্ষণশীল বাড়ি থেকে চললাম একটু দূরে। জীবনে প্রথম একান্ত আপনজনদের ছেড়ে একা থাকা। হস্টেল। স্বাদ পেলাম এক অচেনা জীবনের। খুব যে পড়াশোনা ভালোবাসি, মনোযোগী ছাত্রী, তা কিন্তু নয়। তবে সন্ধান পেলাম, পড়াশোনা ডিগ্রী এসবের বাইরেও অনেক কিছু আছে। ডালে ডালে পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে মুক্তির খোঁজ। গাছগাছালি, বড় বড় ঝিল, মাঠের পর মাঠ দিয়ে ঘেরা ছিল ক্যাম্পাস। একটা ছোট্ট সাঁকো পেরিয়ে ঢুকতে হতো ইউনিভারসিটি চত্বরে। যেন পেরিয়ে যাচ্ছি উঁচু একটা ধাপ। হাতছানি দিচ্ছে জীবনে কিছু একটা করার স্বপ্ন।
এই প্রথম কো- এডে পড়তে আসা। ছেলেদের সঙ্গে পরিচয় হচ্ছে। ভাবনা চিন্তায় বদল ঘটে যাচ্ছে। একই ঘটনার নানা দৃষ্টিকোণ সামনে আসছে। সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করল নাটক। চারপাশে যে সমাজ, তার মানুষজন আমিও তার অংশ। কোন বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নই। ধীরে ধীরে ইতিহাস সমাজ অর্থনীতির সঙ্গে বাস্তব জীবনের সংযোগ খুঁজে পেতে লাগলাম। পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে পড়তে আসা একটি মেয়ে কেন আমাদের সঙ্গে ক্যান্টিনে যেতে চায় না- ধীরে ধীরে বুঝতে শিখলাম। অর্থনীতির পাতা থেকে জীবন্ত হয়ে উঠল অসমবন্টন।
জীবনের এই পর্বে পুরো সময়টা জুড়ে থাকে চক ডাস্টার ব্ল্যাকবোর্ড শিক্ষকের জলদগম্ভীর স্বর বই খাতা পরীক্ষা আর ভীষণ ভারি নিশ্চিদ্র একটা সিলেবাস। কোনদিনই ভালোবাসতে পারিনি এই ব্যবস্থাকে। তাই কখনও সমুদ্র কখনও পাহাড় কখনও বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের চারদিক খোলা নাটকই হয়ে উঠেছে আমার শিক্ষক। আমার ভালোলাগা।
শিক্ষক শব্দটা আমার কাছে অনেক বড় পরিসরে ধরা দেয়। পৃথিবীর এই অগাধ জ্ঞানসমুদ্র থেকে আমরা প্রতিমুহূর্তে শিখছি, আবার কিছু না কিছু শেখাচ্ছিও বটে।
বিশ্বাস করি- আমরা সবাই শিক্ষক, আমরা সবাই ছাত্র।
No comments:
Post a Comment