Friday, September 14, 2018

ধারাবাহিক গদ্য- দেবর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায়







ভালোবাসাগুলো সেলিব্রিটি হয়ে...যায়নি


স্মার্টফোনের জমানায় গল্প বলার ধারণা বদলেছে। স্টোরি টেলিং এর সাম্প্রতিক সংযোজন মেম। গোত্রে গ্রাফিক নভেল বা কমিক্সের খুব কাছে হলেও, মেম স্বতন্ত্র। পপুলার এপ্রোচে বানানো মেমগুলি চটুল মজায় বলে দেয় জীবনের রাজনীতি। যেহেতু কালচারের বোঝা এখানে নেই, তাই সরাসরি ধাক্কা লাগে।
 তিনটি শটে গল্প বলা হয় এখানে। কখনো এক লাইনেও বলে দেওয়া হয়। নেপথ্যের পিক্টোরিয়ালে থাকে সহযোগী ছবি। এ মুহুর্তে মোটিভেশনাল ভিডিও-র থেকে মেম কিন্তু আলাদা। ও ধরনের ভিডিওতে জীবন সম্পর্কে ধারণা দেওয়াই প্রধান উদ্দেশ্য থাকে। মেম যে বানানোই হয়, স্মার্টফোনে স্ক্রল করা পাব্লিক চটজলদি জেনে নেবে উথলে ওঠা জীবন সত্য।   
"সে এখন অনলাইন, কিন্তু তোমার জন্য নয়।" সদ্য ৩৭৭ পাশ হয়েছে। তা নিয়ে একটা মেম বানানো হয়েছে। গুপি গাইনের সেই মুহুর্ত যেখানে রাজকন্যা কম পড়ায় দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে গুপি-বাঘার সাথে রাজার। বাঘারো রাজকন্যা চাই। এদিকে পাত্রী গুপির জন্য। এদিকে রাজা বলছেন, আমার তো একজনই পাত্রী। তাতে মেম এ বাঘা বলে ওঠে, "চাপ নেই। এখন তো সমকামিতা অপরাধ নয়। রাজকন্যা লাগবে না। তা হলে, আমি আর গুপি মিলেই.." 
আপনার মনে হতে পারে এসব অশ্লীল। নোংরা। কিন্তু মেমের রাজনীতিই তাই। তবে মাত্রাছাড়ানো চটুলতার দোষো আছে। সেগুলোকে আমি বাদ রাখছি। একটি মেম যেমন দেখাচ্ছে, বাসের দু ধারে দু"জন বসে। বাসটি চলেছে পাহাড় দিয়ে।একজনের মুখে হাসি, একজনের মুখ গোমরা। নীচে লেখা, জীবন যে যেভাবে দেখে। এমন বিস্ময় উসকে দেওয়াই মেমের উদ্দেশ্য।
বিস্ময় কি? আনন্দামানে বেড়াতে গেছিলাম ছেলেবেলায়। সমুদ্রের ধারে বসেছিলাম। অনেকটা সময়। চোখ লেগে আসছিল। অদূরে একটা ডিঙি-নৌকা ভাসছে মনে হল হঠাৎ। কালো, শ্যাওলামাখা।
কাছে গেলাম জলের। দেখলাম, প্রমাণ সাইজের কচ্ছপের পিঠ ওটা। কচ্ছপটি সানন্দে দুনিয়ার একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে চলেছেন সমুদ্রে। কোনো বাধা নেই তার। তাড়া নেই কোনো। যেমন, চতুরংগের শেষে শচীশ "অসীম অসীম" চিৎকারে ছুটে চলে সমুদ্রধারে। রবি ঠাকুরের "দূরে কোথাও দূরে দূরে" বেজেছিল কানে।
আমি অসীমের ধারণা পেয়েছিলাম। কোহেন সুজান গাইছিলেনো হয়তো অদূরে, মেঘে ঢাকা তারায়।
এই স্মৃতি বলতে গিয়েই সাম্প্রতিক মেম থেকে চলে গেলাম আবহমান ক্লাসিকের ধারণায়।  
আমরা কেন ক্লাসিকের কাছে ফিরে যাই? 
বন্ধুত্বই যে আবহমানতার শেষ কথা তা জানতেই হয়তো। 
"বাজলো আলোর বেণু" ক"দিন পরেই বাজবে। কি হবে বাঙালির বুকে? কি হয়, পথের পাচালির আবহ বাজতে থাকে যখন? রবিশংকর যখন বাজাতে বাজাতে ভগবান হয়ে যান!
রবিঠাকুর বলবেন,  "ক্লাসিকিয়ানার মোহ"। ঘটক দেখাবেন, তিতাসের শেষ শটে নদীর পেটে ঘাস জন্মাচ্ছে। সভ্যতা মরে না। মূল উপন্যাসে যদিও ছিল, সভ্যতা মরে। নদী শুকিয়ে যায়। কমলকুমার বলবেন, লেখা মানে তাহাকে ডাকা।
ইতালো কালভিনো তার " Why read classics" এ এই নিয়ে বেশ কিছু জরুরি কথা বলেছেন।
সুমন কিছুদিন আগে বললেন, " সংগীত একটা নিখিল অভিজ্ঞতা।" 
তিন ভুবনের পারে, বসন্ত বিলাপ, দেয়া-নেওয়া ছবিগুলোতে এই বন্ধুত্ব রাখা আছে। হালের ম্যাডলি বাঙালি, ভূতের ভবিষ্যতেও রয়েছে এই প্লুরালিটি, বহুত্ব। আমায় প্রায়রোজ দেখতে হয় ছবিগুলো। এগুলো তো ক্লাসিক না। তবে?
সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন, তুলসী চক্রবর্তী, পাহাড়ি সান্যালরা আজ বাংলা ছবিতে ব্রাত্য। গাস্টিন প্লেসের ভূত। সহ অভিনেতা বলে কিছু নেই আর। যেমন নেই গ্রাম। আছে শুধু অন্ধকার, হিন্দুস্তান রোডের ফ্ল্যাটের লিভ-ইন দম্পতি, সুইগি, ফেসবুক আর বাকুড়ার ঘোড়া!
 মা চলে এলেন যেন-বা।
আমরা যারা নারীর সন্ধানে শহর আর শহর সন্ধানে নারীকে চেয়েছি, আসলে চেয়েছি মা-কে, তারা তো আসলে যোনিপথ চেয়েছে। যে রাস্তায় গুরু গাছ হয়ে যান আর গাছ Philosopher.
 সুমন কোনো অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ইতালো কালভিনোর "ইনভিজিবেল সিটিজের" কথা। এ উপন্যাসে শহর, নারী, প্রেম, কামনা, স্মৃতি সব এক হয়ে যায়। এ উপন্যাস পড়ার পর আমি আর ঠিক আগের মানুষটা নেই।
আমরা তো মা-কে চেয়েছি আসলে। ঘটককে যেমন মজা করে বন্ধুরা বলতেন, তোকে মা-এ খেয়েছে। নবারুণের মধ্যেও ছিল এই অসম্ভব ক্রেভিং ফর লাভ। সেপ্টেম্বরের সন্ধ্যা বড় মায়াময়। রবি ঠাকুর লিখে ফেলেন, তোমায় দেখেছি শারদপ্রাতে। যেন শিকারের আগে হরিণের চোখ।প্রাক্তন প্রেমিকার সাথে দেখা।  ডাইরিতে লেখেন, যত বার শেষ বয়সে ছবি আঁকেন, প্রথম প্রেমিকার চোখ একে ফেলেন। তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা। জাত কমিউনিস্ট মানিক ডাইরির শেষে মা-মা করতে থাকেন। বিজনের দেবীগরজনে কালী মঞ্চে উঠে আসে। কমিউনিস্টরা গাল পাড়েন। নবারুণ বলেন, মাদার কাল্ট আবার কি। দেশটাই তো মা। এরা গ্রামার বানাচ্চে বাঞ্চোৎ। এদের গ্রামারটা শেখ। 
   জানিনা মানুষ জীবনভর কি খোজে। কিচ্ছু জানিনা। শুধু জানি, এ শহরটা আমার মা। এর প্রতিটি শিরা-উপশিরায় আমি পাই নারী, প্রেম, কামনা, স্মৃতি। 
মা। দুনিয়ায় সবচেয়ে আশ্চর্য এ শব্দের সাউন্ড।
মা। আসছেন। 
গুরু-মা-বাবা। আলি আকবর খানের বাড়িতে সন্ধ্যার ক্লাস সবে শেষ হয়েছে। কিছু ছাত্র বেরিয়ে পড়েছেন। ক"জন গুরুর সাথে আরেকটু কথা বলে বেরতে চান। এদিকে গুরু ক্রমশ ছটফট করছেন। ছাত্ররা কারণ বুঝতে পারছেন না। সবে ৯টা বেজেছে। গুরু বলছেন, "যাও যাও"। 
এক ছাত্র আর না পেরে বলেই ফেললেন, আপনার কি কোনো কাজ আছে? এত ব্যস্ত হচ্ছেন। কিছুটা রাগ আর উদাসীনতা মিলিয়ে আলি আকবর বলে উঠলেন, আরেকটু পর বাবা নেমে আসবেন না! আমায় সুর সেবা করতে হবে তো! 
বলা বাহুল্য বাবা আলাউদ্দিন প্রয়াত হন আগেই।

No comments:

Post a Comment

একনজরে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"ইস্কুল বলিতে আমরা যাহা বুঝি সে একটা শিক্ষা দিবার কল। মাস্টার এই কারখানার একটা অংশ। সাড়ে দশটার সময় ঘণ্টা বাজাইয়া কারখানা খোলে। ...