Friday, September 14, 2018

আমার মুখোমুখি জীবন, নিয়তি ও শিক্ষক’- শুভদীপ নায়ক









চারিদিকে বরফের স্তূপ , রাত্রিকালীন শীতল বাতাস যেন চেপে ধরেছে রক্তকণিকাদের । শিরার ভিতরে জমে আসছে রক্তস্রোত । বরফের স্তূপ খুঁড়ে সামান্য গর্ত করে নিয়ে কাঠ ও কেরোসিন দিয়ে দেশলাই ঠুকে জ্বালানো হল আগুন । সেই আগুনের আলোয় পাশে রাখা একটা লোহার বেঞ্চে পিঠ ঠেকিয়ে বই খুলে বসলাম, অদূরে তাঁবু । রাতের সর্বগ্রাসী অন্ধকার সিয়াচেনের শীতলতাকে প্রায় মৃত্যুরই সমান করে তুলেছে । মানুষের চাই উষ্ণতা , বাঁচার জন্য এবং বাঁচিয়ে রাখার জন্য । ‘আই ক্যান ওয়াক থ্রু সাইলেন্স’ । আজ যখন লিখতে বসি সেইসব স্মৃতি, যা আমাকে ঘিরে আছে বহুকাল, যা হয়ে উঠবে বেদনার অব্যক্ত ভাষা,— যে ভাষা আজও আমাকে জানায়,— হ্যাঁ , আমি হাঁটতে পারি নিস্তব্ধতার মধ্যে দিয়ে , হাঁটতে পারি রক্তপাতের অঞ্চলে , বেড়াতে পারি চোখের অমোঘ আমন্ত্রণে , ইশারার অদ্ভুত প্রয়াসে । 


শৈশবে আমাকে বইপত্র তেমন টানত না । আমি যা খুঁজে বেড়াতাম , বইয়ের মধ্যে তা পাওয়া যেত না । ধীরে ধীরে বইগুলো বদলে ফেলল নিজেদের , হয়ে উঠল কথন ।  মানুষেরা লুকিয়ে  কথা বলতে লাগল কাগজের পৃষ্ঠার ভিতরে । আমার যাবতীয় গন্তব্য ফিরে এল লাইব্রেরির ঠিকানায় । রেক্সিনে বাঁধানো ক্লাসিক বইগুলো হয়ে উঠল আমার মুখ্য আলোচনার সঙ্গী । যেহেতু আমার কথা বলবার কেউ ছিল না , আমি আলাপ করলাম সেইসব মৃতদের সঙ্গে যাঁরা আজও আমার গোপনে জীবিত । তাঁরা আমাকে ফিরিয়ে আনলো লেখার টেবিলে , যে আমি ভুল স্রোতে ভেসে গিয়েছিলাম, হঠাতই নিজেকে আবিষ্কার করলাম এক অচেনা দ্বীপে । একজন মানুষের নিথর দেহ পড়ে আছে , অথচ প্রচুর মানুষের যাতায়াত তার পাশ দিয়ে । কেউ তাঁকে তুলে নিচ্ছে না । কেউ জানতে চাইছে না মানুষটার শরীরে কোনও স্পন্দন আছে কি না  ! লোকে তাঁকে ধরে নিয়েছে মৃত বলে । পথ থেকে মানুষকে তুলে নিলে তাঁকে দিতে হয় শুশ্রুষা, রাখতে হয় নিজের কাছে , কিংবা পৌঁছে দিতে হয় সেখানে , যে স্থানে মানুষটি যেতে চাইছে । আমার স্বপ্ন যত গভীরেই থাকুক না কেন, তাতে যে হারাতে বসব নিজেকে, এ বিপদ আমার ছিল না । ঠিক করলাম, নিজেকে বাঁচাবো বইয়ের আশ্রয়ে , কাগজের পৃষ্ঠায় অক্ষরে অক্ষরে ফুটিয়ে তুলব সেইসব লেখা, যা পড়ে নিতে মানুষ কখনই প্রস্তুত ছিল না । আমি কলম ধরলাম অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য, নিজের আত্মার দলিল নিয়ে আমাকে হাজির হতেই হবে জগতের সম্মুখে । আমি লক্ষ্য করলাম , সেইসব মুহূর্তগুলো আমাকে মুগ্ধ করে, যখন বইয়ের কল্পনা মিলে যায় মানুষের সত্যের সঙ্গে । আমি শিক্ষকের ভূমিকায় চেয়েছিলাম স্রষ্টাকে, কিন্তু যাঁদেরকে জীবন আমার কাছে পাঠিয়েছে তাঁরা প্রায় সকলেই হয়ে উঠেছিল আমার কর্তা । তাঁরা প্রভুত্বের আওতায় বেঁধে ফেলত আমার শৈশবকে । আমি পালিয়ে বেড়াতাম । প্রকৃতির মধ্যে আমি খুঁজে নিতাম আশ্চর্য এক নির্ভরতা , যা আমাকে ধৈর্যে অবিচল থাকতে শেখাত । বই আমাকে শেষপর্যন্ত যন্ত্রণার সম্মুখীন হতে সাহায্য করেছে ।  সেই যন্ত্রণা , যার মধ্যে দিয়ে আমার কথাগুলো বেঁচে থাকবে অনন্তকাল । আমি ভিড়ের মধ্যে আবারও খুঁজে পাবো নিজেকে, যে আমি ফেরৎ আসতে চাইতাম না নিজস্ব জীবনে , সেই আমি ফিরে আসব শতগুণে বর্ধিত হয়ে । 


আমার আর একটা সত্য ছিল ।  যেহেতু নিজেকে রক্ষা করার কোনও অজুহাত আমার ছিল না, আমি ঢুকে পড়তাম অন্য মানুষের সত্যের ভিতরে । যেসব মানুষ সম্পর্কের ভিতরে আজও বন্দী, আমি তাঁদের বাইরে নিয়ে আসতাম মুক্তির সন্ধানে ,শুনতে পেতাম তাদের নিয়তির স্বর । অনুভব করতাম, আমার সত্য তাদের জীবনে চিরকাল কাজ করে যাবে একটা সেতু রূপে । আমার ভিতরে পা না ফেলে তারা কখনওই আমাকে পেরোতে পারবে না । এই ছিল আমার সত্য, যার মাধ্যমে আমি অনেক মানুষকে পৌঁছে দিয়েছি তার ভয়াবহ নিয়তির সম্মুখে যা তাদের প্রাপ্য ছিল । কিন্তু কোনও মানুষকেই আমি ধরে রাখতে পারিনি , কেননা আমি নিজেকে রাখিনি কারোর হাতে । শৈশবস্থায় আমি জানতাম, আমি বড় হব অনেক মানুষের অভিজ্ঞতার সঙ্গে, যাঁদের আমি পড়তে শিখেছি । 


সুতরাং , সময় এসে গেল জগতের কাছে নিজেকে অপরিহার্য বলে দাবি করার । পৃথিবী,— যে কিনা শিক্ষক রূপে বারবার ফিরে এসেছে আমার কাছে, আজ সময় এসেছে তার কাছে নিজের পরীক্ষাটুকু দেওয়ার ! আমাকে ধৈর্যের সঙ্গে বুঝে নিতে হবে আমার সৃষ্টির গুরুত্বখানি এবং বিনয়ের সঙ্গে পার যেতে হবে একের পর এক অবস্থানকে । আমি নিজেকে সরিয়ে আনলাম কোলাহল থেকে, শুধু প্রত্যয়গুলো রেখে দিলাম মানুষের মধ্যে । যেভাবে কোনও বইয়ের সত্যিকারের লেখক জানতে পারে না পাঠক তাকে কখন কীভাবে পড়ে ফেলছে , সেইরকম আমিও হয়ে উঠলাম ভয়ঙ্কর এক প্রতারক । আজও আছি সেই প্রতারকের ভূমিকায় । ক্ষমতার প্রলোভনকে আমি চিনে ফেলতাম সহজেই, তাই মানুষের দেওয়া কোনও অপমানের জবাব আমি দিতাম না । অন্যকে অপমানিত করে বসার চেয়ে বেশি জরুরি নিজেকে সংশোধন করে চলা । আমি তা পারতাম, কারণ—জীবনের সঙ্গে আমার সরাসরি কথা হত । মানুষকে বুকে টানতে আমাকে নিতে হয়নি কোনও অজুহাতের আশ্রয় , রাখতে হয়নি কোনও অবাধ্য আড়াল যা আমায় ভুল সিদ্ধান্তের তাড়নায় শেষ পর্যন্ত মেরে ফেলতে পারে । 


আমার শিক্ষক জানতো, আমার কোনও বুদ্ধি ছিল না । সেইজন্য আমার বিবেককে সে এতই ভয়ঙ্কর করে তোলে যার ফলে আমি সহজেই ভেঙে দিতে পারি মানুষের অন্তহীন স্থূলতা, আন্তরিক বৈচিত্র, দৃষ্টিভঙ্গির গতিবিধি ও যেকোনও রকম যুক্তির দেওয়াল । মনে পড়ে , লাইব্রেরিতে বসে একবার একটা বই খুলেছিলাম, যার ভিতরে একটা পোকা ছিল । ওটা ছিল আমার নিয়তি । পোকাটা তখনও জীবিত ছিল । পৃষ্ঠাগুলো তাকে খাদ্যসংকট থেকে রক্ষা করে চলেছিল । পোকাটা স্থির করেছিল যতদিন সে বাঁচবে , খুঁজে বেড়াবে তার অমোঘ অস্তিত্ব । বইয়ের ভিতর দিয়ে তার যাত্রা হবে অতীতের দিকে , সেই অতীত যা একদিন তাঁকে বড় ভবিষ্যতের অধিকারী করে রাখবে । তার জন্য তাঁকে হারাতে হবে অসংখ্য ঐশ্বর্য । ধুয়ে নিতে হবে তাঁর সমস্ত উপার্জনকে । সমাজের স্রোত তাঁকে কখনও স্পর্শ করবে না , কিন্তু সে ফিরে যাবে তাঁর বিদগ্ধ যাপনের কাছে একটা বৃত্তকে সম্পূর্ণতা দিতে । তাঁকে সন্ধান চালাতেই হবে কেন সে এই জীবনের অপরিহার্য অধিকারী হয়ে উঠল  ! মানুষ তার নিষিদ্ধ অনুভূতিকে চাপা দেয় আত্মসম্মান ডুবে যাওয়ার ভয়ে ।  আমি চেয়েছিলাম, পোকাটা হয়ে উঠুক তার নিজস্ব বিবেকের কাহিনি । কেননা, সমস্ত জাগতিক যন্ত্রণা থেকে মানুষ মুক্তি পায় একদিন, কিন্তু কখনওই সে আরোগ্য লাভ করতে পারে না নিজের সত্তা থেকে । আর সেইটাই একমাত্র শিক্ষা যা এতগুলো বছর ধরে আমাকে প্রতিমুহূর্তে নাড়া দেয় । 

No comments:

Post a Comment

একনজরে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"ইস্কুল বলিতে আমরা যাহা বুঝি সে একটা শিক্ষা দিবার কল। মাস্টার এই কারখানার একটা অংশ। সাড়ে দশটার সময় ঘণ্টা বাজাইয়া কারখানা খোলে। ...