আমার স্পষ্ট মনে
আছে, যখন সবে কথা বলা শিখেছি। খুব স্পষ্টভাবে কথা বলা শিখেছি। মানে যখন কথাদের
মানে বুঝতে শিখেছি। আর আমার মধ্যে একের পর এক কথাদের বীজ বপন করার প্রক্রিয়া শুরু
হয়ে গিয়েছে। এবার হয়তো স্কুলে পাঠানোর ভাবনা বাবা-মা-ঠাকুরদা-ঠাকুমার মাথায় ঘুরপাক
খেতে শুরু করেছে। কিন্তু তার আগে কিছু পঠন-পাঠন প্রক্রিয়া রপ্ত করা উচিত। আমার
স্পষ্ট মনে আছে, ঠাকুরদা-ঠাকুমা আমার জীবনের প্রথম যে পাঠ দিয়েছিলেন। প্রত্যেকদিন
সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখ-হাত ধুয়ে প্রথম একটি মন্ত্র উচ্চারণ করতে শিখিয়েছিলেন।
তাদের কাছ থেকে শুনে শুনে মুখে-মুখে আওড়াতে হত তখন। এছাড়া তো উপায়ও ছিল না আমার
ওইসময়। তাদের শেখানো আমার জীবনের প্রথম উচ্চারিত মন্ত্রটি ছিল : ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি / সারাদিন আমি
যেন ভাল হয়ে চলি / আদেশ করেন যাহা মোর গুরুজনে / আমি যেন সেই কাজ করি ভাল মনে’। প্রতিদিন
সকালে এই মন্ত্র আগে উচারণ করতে হত। তবেই খেতে পেতাম।
আমার স্পষ্ট মনে আছে ভোর কেটে যাওয়া আর
সূর্য ওঠার বেশ কিছু আগের মুহূর্তের সেই সকালের মায়াবী আলো। যে আলোর সঙ্গে একাকার
হয়ে থাকত আমার সেই মন্ত্রোচ্চারণ। সেই আলোর সঙ্গে মিলেমিশে থাকা সুমিষ্ট বাতাস এসে
আমার নরম গালে আদর করে যাওয়ার মুহূর্ত। সেই বাতাসের সঙ্গে ভেসে আসা ‘বিদায়ী-ভোরের’
গন্ধ। যা আজও মাঝে-মাঝে নাকে এসে লাগে। আর আজও সেই মন-ভালো-করা সকাল আমাকে দিয়ে
মাঝে মাঝে বলিয়ে নেয়, ‘সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি’। আমাকে এই মন্ত্রই জীবনের
প্রথম থেকে ভাল হয়ে চলতে শিখিয়েছে। আর প্রতিটি কাজ ভালমনে করতে শিখিয়েছে। আর ওই
মন্ত্রই আমার প্রথম শিক্ষক হয়ে উঠেছে কখন যেন, তা এই বয়সেও এসে অনুভব না করে উপায়
থাকে না।
স্কুলে পড়া
যখন শুরু হল, বাবার কাছে যখন পড়তাম, আমার মনে আছে, বাবা ভীষণ খুঁতখূঁতে মানুষ।
বাবার বক্তব্য ছিল, ‘পড়তে হলে ভাল করে পড়তে হবে’। মনে আছে, বাবা বলত, পড়া বা কিছু বলার সময় ‘প্রতিটি উচ্চারণ স্পষ্ট হওয়া চাই’।
মাথার মধ্যে সেই থেকে ঘুরপাক খেতে শুরু করে আজও। বেরোতে
পারি না এই ভাবনা থেকে। বেরোতে ইচ্ছেই করে না। ‘স্পষ্ট উচ্চারণ’ একটা আলাদা জোরের
জায়গা। যা আমাকে সবসময় সোজা টান-টান হয়ে থাকতে সাহায্য করে। তাই যখন যা-কিছু বলি
‘উচ্চারণ স্পষ্ট’ না হলে যেন মনই ভরতে চায় না। ‘স্পষ্ট উচ্চারণ’ শব্দবন্ধটিও কখন
যেন আমার নিজেরই অজান্তে শিক্ষক হয়ে ওঠে বুঝতে পারিনি।
যদিও আমি
ছোট থেকেই বেশ মুখচোরা স্বভাবের ছিলাম। কেউ কিছু বললে মুখে কিছু বলতে পারতাম না।
চুপচাপ শুনে যেতাম। কিন্তু মনে মনে যে রাগ হত না তা নয়। ইচ্ছে হত স্পষ্ট মুখের ওপর
বলে দিই। কিন্তু মা বলত ‘যে সয় যে রয়’। খুব সহজ সরলভাবে বলত মা, ‘বড়দের
মুখে-মুখে কথা বলতে নেই’। তাই কিছু বলতে সাহস পেতাম না। কিন্তু ‘উচ্চারণ স্পষ্ট হওয়া
চাই’ এটাও তো মাথায় থাকত। তবু কিছু বলতে পারতাম না। ফলে একটা কষ্ট থাকত মনের
মধ্যে। আর এই কষ্ট থেকে বেরোবার পথ হিসেবে আমাকে আমার জীবন জানিয়ে দিল যে, এর থেকে
বেরোনোর একটাই উপায়, সেটা হল লেখা। যদিও সে অনেক বছর পরে। স্কুলের গণ্ডীর শেষ
সীমায় এসে। স্পষ্ট উচ্চারণের জায়গা হিসেবে লেখাকেই বেছে নিলাম।
বাবার কাছে স্পষ্ট উচ্চারণের তালিম নিয়ে
চলতে থাকল স্কুল-জীবন। যেখানে পড়তে পড়তে আমার একটা অন্য অনুভূতি হয়েছিল। প্রাইমারি
স্কুল থেকে হাইস্কুলের দিকে একের পর এক ক্লাসের সিঁড়ি বেয়ে এগিয়ে চলেছি নিজস্ব
নিয়মে। প্রতি বছর নতুন ক্লাস শুরু। মাস ছয়েক পরে হাফ ইয়ারলি পরীক্ষা। তার ছ’মাস
পরে অ্যানুয়াল পরীক্ষা। এই পরীক্ষা চলাকালীন প্রত্যেকের মতো আমি লক্ষ করেছি,
পরীক্ষা হলে পরীক্ষা শুরু হতেই মাস্টারমশাই একটা প্রশ্নপত্র হাতে দিতেন আর একটা
আনসার-শিট। আর বলে দিতেন আগে প্রশ্নপত্র মন দিয়ে পড়ো, তারপর লিখতে শুরু করো। আমরা
প্রশ্নপত্র পড়তাম। প্রথমে কিছু ছোট প্রশ্ন। তারপর মাঝারি মাপের। তারপর থাকত বারো-চোদ্দ নাম্বারের
প্রশ্ন। মাস্টারমশাই বলতেন, ‘যে যত তাড়াতাড়ি আর যে যত ভালো লিখতে পারবে সে তত বেশি
নাম্বার পাবে’। কারণ হাতে বেশি সময় নেই। মাত্র তিনঘন্টার ভেতরেই যা করার করে ফেলতে
হবে।
প্রশ্নপত্র হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করলাম।
মাথার মধ্যে গাঁথা থাকত, ‘যে যত তাড়াতাড়ি যত ভাল লিখবে সে তত ভাল নাম্বার পাবে’।
আর ঠিক তখনই এই ‘প্রশ্নপত্র’ আমার সামনে এক বিরাট বিস্ময়সূচক চিহ্ন হিসেবে ধরা
দিতে শুরু করল। প্রতি বছর স্কুলে হাফ ইয়ারলি আর অ্যানুয়াল পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র
হাতে আসার মতোই, এই জীবন জানিয়ে দিল, এই প্রশ্নপত্র সারাজীবন আসতে থাকবে। শুধু
স্কুলের পরীক্ষায় নয়। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের পরীক্ষায় এই প্রশ্নপত্রের ভূমিকা
অনস্বীকার্য। এ হল সেই প্রশ্নপত্র, যা জীবনের প্রতিমুহূর্তের বিভিন্ন রকম সমস্যা।
জীবনে যেকোনও সময় এই প্রশ্নপত্র বা সমস্যা হাজির হতে পারে। যে যত সুন্দরভাবে তার
সমাধান করে উঠতে পারবে সে তত সুন্দর জীবন উপভোগ করতে পারবে। শুধু সমাধানের পথ
জানতে হবে। খুঁজতে হবে। মানে পাঠ নিতে হবে। অন্যের জীবন থেকে। ঠিক যেভাবে একজন
প্রণেতা তাঁর অভিজ্ঞতাটি বইয়ে লিখে রাখেন। আর সেই অভিজ্ঞতাকে মুখস্থ করে খাতায়
লিখতে হয়। সেরকম অন্যের জীবন বা নিজের জীবন থেকেও সঠিক পাঠ নিয়ে সঠিক সময়ে সঠিক
সমাধান করে উঠতে হবে। জীবনেরও সময় ওই তিনঘন্টার মতোই বেঁধে দেওয়া আছে। কখন যে সময়
ফুরিয়ে যাবে আমরা কেউ জানি না। সবই অনিশ্চিত।
এই পরিপ্রেক্ষিতে আমার জীবনের আরেকটি খুব
গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা মনে পড়ে গেল। যেটা না বললে অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। সময়টা ২০০১
সাল। দীর্ঘদিন ধরে আমার শরীরে হাড়ের মধ্যে একটি দুরারোগ্য এবং ভয়ানক ব্যাধি,
অ্যাঙ্কাইলোসিং স্পন্ডিলাইটিস, বাসা বাঁধার ফলে আমার বাঁ-পায়ের হিপ-জয়েন্ট ক্ষয়ে
গেছিল। স্টিফ হয়ে গেল হিপ-জয়েন্ট। হাঁটতে পারা যাচ্ছিল না। লাঠি নিয়ে হাঁটতে
হচ্ছিল। সারা বাংলায় চিকিৎসা করিয়ে ক্লান্ত হয়ে শেষে দক্ষিণভারতে, ভেলোর, দৌড়তে
বাধ্য হয়েছিলাম। সেখানে ডাক্তার জানিয়ে দিলেন হিপ রিপ্লেস করা ছাড়া কোনও উপায় নেই
আর। আর্টিফিসিয়াল হিপ প্রস্থেসিস লাগাতে হবে। অপারেশনের পর স্বাভাবিক হাঁটা-চলা
করতে পারব। শুধু নীচে বাবু হয়ে পদ্মাসনাকারে বসতে পারা যাবে না। নব্বই ডিগ্রির
বেশি হিপ ভাঁজ করা যাবে না। ইউরোপিয়ান কমোড ব্যবহার করতে হবে। আর শোয়ার সময়
দু’পায়ের মাঝে বালিশ নিয়ে শুতে হবে সারাজীবন।
কথাগুলো শুনে আমার মন ভারাক্রান্ত হয়ে
গেল। এতদিন হাড়ের জয়েন্টে ঘষা লাগার ফলে যে অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করছিলাম তার থেকেও
যেন কয়েক হাজার গুণ বেশি এক অব্যক্ত যন্ত্রণা আমাকে কুরে কুরে খেতে শুরু করল। আমি
যা কাউকে বোঝাতে পারছিলাম না। আমি চুপচাপ লজের বিছানায় বালিশে হেলান দিয়ে আধশোয়া
হয়ে আছি, আর মাথার মধ্যে একটা অন্ধকার ঘূর্ণিঝড়ের ঘুরপাক টের পাচ্ছিলাম। অতদূরে
সেদিন আমার বাড়ির কেউ ছিল না পাশে যার সঙ্গে শেয়ার করতে পারি। সঙ্গে ছিল আমার থেকে
অনেক ছোট আমার মামাতো ভাই, আর আমার এলাকার এক দাদা। দুলালদা। সেসময় অপারেশনের যা
খরচ বলেছিল তাতেও আমার বাবার মাথা ঘুরে গেছিল। সর্বসাকুল্যে এক লক্ষ কুড়ি-পঁচিশ
হাজার। যা সেসময় একসঙ্গে জোগাড় করা বাবার পক্ষে খুব মুশকিল হয়ে পড়েছিল। এস্টিমেট
নিয়ে এসে টাকা যোগাড় করতে প্রায় মাস ছয়েক লেগেছিল। তারপর টাকা যোগাড় করে যখন অপারেশন করাতে যাই, তখনও আবার সেই মন
ভারাক্রান্ত। একটা চাপা টেনশন। একটা ভয়। বেঁচে ফিরব তো ?
অপারেশনের
জন্য যেদিন ভর্তি হবো তার আগেরদিন অমনি চুপচাপ বসে আছি, আর ভাবছি, আচ্ছা ঈশ্বরকে
কি মানুষ এইসময়ই ডাকে ? আমি তো সম্পূর্ণ ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখতে পারি না। তবু সেদিন
মনে হচ্ছিল, আচ্ছা, সবাই তো কর্মফলের কথা বলেন। যে যেমন কর্ম করবে সে তেমন ফললাভ
করবে। তাহলে আমি এ কীসের ফললাভ করতে চলেছি ? কী এমন অন্যায় করেছি যে এত বড়ো শাস্তি
পেতে হচ্ছে আমাকে ? আমার জ্ঞানত আমি জানি যে আমার বাবা-মা সম্পূর্ণ সৎ মানুষ। কারও
ক্ষতি তো দূরের কথা, বরং অন্যকে হেল্প করার জন্যই বেশি তৎপরতা
দেখেছি জন্মমুহূর্ত থেকে। যে যখন যেভাবে চেয়েছে আমার বাবা দেবার চেষ্টা করেছে
সাধ্যমতো। মাকে দেখেছি কেউ ভরদুপুরে খিদে পেটে দরজায় এসে দাঁড়ালে নিজের ভাতের থালা
তার মুখে তুলে দিতে। তাহলে ? কার কর্মের ফল ভুগতে হচ্ছে ? আমার ঠাকুরদা-ঠাকুমাও তো
একইরকমভাবে সৎ। দেখেছি। হ্যাঁ, আমার ঠাকুরদা পুজো-আর্চায় বিশ্বাস করতেন না কখনও।
ঠাকুমা কোনও পুজোয় বেশি আড়ম্বর করতে চাইলে ঠাকুরদা তার বিরোধিতা করতেন। আর কাউকে
কিছু না বলে পুজোর দিন দুজন লোককে বাড়িতে ডেকে দুপুরে নিজে বসে থেকে পেট পুরে
খাওয়াতেন। আর বলতেন, আমার পুজো হয়ে গেছে। এটা কি তারই কর্মফল ? আমার তো সারাজীবনের
জন্য একটা প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়ে গেল। অর্ধেক অক্ষম আর সম্পূর্ণ অক্ষমের মধ্যে তো
কোনও পার্থক্য নেই। কী হবে কী হতে চলেছে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল এ
জীবন নিয়ে কী হবে আমার !
এইসব নানান প্রশ্ন যখন মাথার মধ্যে
ঘুরপাক খাচ্ছিল, ঠিক তখনই দুলালদা বললেন, হসপিটালে একটা কাজ আছে, সেখানে যাবার
জন্য। দুলালদা সেবারের মতো আমার অপারেশনের সময়েও গেছিলেন। ওর নিজের চিকিৎসার কাজও
ছিল। নিজের চিকিৎসাও হবে, আর আমার সঙ্গেও থাকা হবে এই ভাবনা নিয়ে আমার সঙ্গে
দুলালদা ছিলেন আর আমার মামাতো ভাই তো ছিলই। তো দুলালদা আমাকে নিয়ে গেলেন ভেলোর
হসপিটালের বেসমেন্টে একটা হলঘরের মতো ঘরে। যেখানে ‘মেডিকেটেড শু’ তৈরি করা হয়। এক-একজনের পায়ের
এক-এক সমস্যা। সেইমতো ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী নানান রকম জুতো-চটি তৈরি হয়
সেখানে। রীতিমতো একটা জুতোর কারখানা ওটা। আমি দেখে তো অবাক। এর আগে এমন চোখে পড়েনি
কোথাও। কিন্তু তার চেয়েও আরও অবাক হয়েছি সেই কারখানায় অন্য একটি দৃশ্য দেখে।
সেখানে
একটা লম্বা লাইন। রোগীদের। মানে যাদের জুতো তৈরি করা হবে সেইসব রোগীদের। সবাই লাইন
দিয়ে দাঁড়িয়ে। একে একে জুতোর মাপ দিচ্ছেন। আর সেখানে যে ভদ্রলোক বসে বসে
প্রত্যেকের জুতোর মাপ নিচ্ছেন, অবাক হলাম তাকে দেখে। গলা ছেড়ে গান গাইছেন আর জুতোর
মাপ নিচ্ছেন। গানের ভাষা আমার জানা নেই। তামিল বা তেলেগু কিছু একটা হবে। যা আমি
জানি না বলে গানের ভাষা বুঝে উঠতে পারছি না। কিন্তু সুরটা শুনে বোঝা যাচ্ছে, ফোক
টাইপের কিছু একটা গাইছেন। এবং সেই গানের সুরে আনন্দ ছাড়া দুঃখের লেশমাত্র নেই। হাসতে
হাসতে মনের আনন্দে গেয়ে চলেছে্ন। আর সেই সুর গোটা হলে ছড়িয়ে
পড়ছে। দেখে অবাক হলাম। ভেবে অবাক হলাম এত আনন্দ আসে কোথা থেকে ? সারাদিন তো কাজ
করে চলেছেন। একমুহূর্ত বিশ্রাম নেই। কিন্তু তার চেয়েও অবাক হলাম দেখে,
শুধু অবাকই না, রীতিমতো স্তব্ধ হয়ে গেলাম দেখে যে, যে-মানুষটা মনের আনন্দে গান
গেয়ে চলেছেন, আর অন্যের পায়ে জুতো পরাবার জন্য একের পর এক পায়ের মাপ নিয়ে চলেছেন আনন্দসহকারে, সে-মানুষটার নিজেরই দুটো পা হাঁটু
থেকে নেই। ট্রেনে কাটা পড়েছিল। সেই থেকে তার ঠিকানা এই বেসমেন্টের জুতোকারখানায়।
যার মনে কোথাও কোনও দুঃখ নেই, আক্ষেপ নেই, কী পেলাম আর কী পেলাম না তার
হিসেব-নিকেশ নেই। শুধু কাজ আছে। অন্যের পায়ে জুতো পরানোর আন্তরিক সদিচ্ছা আছে আর
আছে শুধু আনন্দমিশ্রিত গানের ঝরণাধারা। যা আমাকে সেই মুহূর্তে স্তব্ধ করে দিয়েছিল।
আমার পঁচিশ বছরের মন ওর গানের মধ্যে কীভাবে যেন মিশে যেতে চাইছে। গানের ভাষা বুঝতে
পারছি না, কিন্তু সুরের ভাষা আমাকে শোষণ করে নিচ্ছে সেই মুহূর্তে। আমি সেই
মুহূর্তের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাচ্ছি। আমার মনে নেই আমি কে বা কী। মনে নেই আমার
অসুখ, আমার স্পন্ডিলাইটিস, আমার হিপ-জয়েন্ট, আমার হাতে ধরা লাঠি। মনে নেই আমার
ব্যথা-বেদনা-কষ্ট। কী পেলাম আর কী হারালাম। যেমন ওই মানুষটার সেই মুহূর্তে মনে নেই
তিনি কোথায়, মনে নেই ওর পা-দুটো হাঁটুর নীচ থেকে নেই, ট্রেনে কাটা পড়েছে কিনা মনে
নেই, সে-সময় কত কষ্ট পেয়েছিলেন, কতটা ছিল পা হারানোর যন্ত্রণা, তার কিচ্ছু মনে নেই। শুধু এই মুহূর্তে ওর গান আছে, গানের ঈশ্বর আছেন ওর প্রাণের মধ্যে। মানুষের
পায়ের মাপ নিয়ে জুতো পরানোর আনন্দ আছে। সেইদিন সেই মুহূর্তের কাছে দুঃখ আর আনন্দ,
সুখ আর অসুখ, পাওয়া আর হারানো সব একাকার হয়ে আছে। আসলে এই গানের মুহূর্তই জানিয়ে
দিয়ে যায় যে সবই আপেক্ষিক। আমি যাকে দুঃখ ভাবি তা আমি ভাবি বলেই দুঃখ, আমি আনন্দকে
আনন্দ ভাবি বলেই সে সচ্চিদানন্দ। রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছেন, ‘আমারই চেতনার রঙে
পান্না হল সবুজ, চুনি উঠল রাঙা হয়ে’। ঠিক সেইরকমই। আমার মনে ঈশ্বরে বিশ্বাস না থাকলেও সেই মুহূর্তকে, সেই গানকে, সেই আনন্দকে,
আমার ঈশ্বর মনে হয়েছিল। মনে হয়েছিল আমি তো এই কিছুক্ষণ আগেই আমার জীবনকে দোষারোপ
করছিলাম। ঈশ্বরকে দোষারোপ করছিলাম। অথচ এই মুহূর্তটা আমাকে বলছে, ‘কী ঠকেছ তুমি ?’
ওই মানুষটা দুটো পা না থাকার পরেও যদি আনন্দগান গেয়ে অন্যের পায়ে জুতো পরাতে পারে,
তাহলে তোর কী এমন ক্ষতি হয়েছে ? তুই তো দিব্বি জীবন কাটাবি। কয়েক ঘন্টা আগেই কর্ম
আর কর্মফলের কথা ভাবছিলাম। কিন্তু এই মানুষটার তো শুধু কর্মই রয়েছে। ফল তো আমার
চোখের সামনেই। অন্যের আরোগ্য কামনা আর আনন্দগান। এর চেয়ে বড় কর্মফল জীবনে আর
কীই-বা থাকতে পারে। মনে পড়ে গেল রবার্ট
ফ্রস্ট বলেছিলেন, “There are two kinds of teachers: the kind that fill you with so much quail
shot that you can't move, and the kind that just gives you a little proud
behind and you jump to the skies.”
পরদিন এই মানুষটার কথা ভেবেই অপারেশনের
জন্য ভর্তি হলাম। শুধু ওই মানুষটার কথা ভাবতে ভাবতেই হসপিটালে নানান কাজ করছি।
বেরোতে পারছি না সেই মুহূর্তটা থেকে। ভর্তি করে আমারই শরীর থেকে আমার রক্ত একবোতল
নিয়ে রাখা হল। অপারেশনের পরে আমাকেই দেওয়া হবে বলে। সেটা নাকি আমার পক্ষে সেফ। আর
যেহেতু আমার হিমোগ্লবিন ভাল অবস্থায় ছিল, তাই নেওয়া গেছিল। এই প্রথম আমার রক্ত নেওয়া
হল এবং এই প্রথম আমার গ্রুপ-টেস্ট হল। যেহেতু এর আগে প্রয়োজন পড়েনি তাই গ্রুপ-টেস্টও
করানো হয়নি। এবং অপারেশন টেবিলে যাওয়ার আগে আমি জানতে পারলাম আমার ব্লাড-গ্রুপ ‘বি
পজিটিভ’। এবং কী আশ্চর্য সে-মুহূর্তে আমার ব্লাড-গ্রুপও আমাকে জানিয়ে দিচ্ছে, ‘ বি
পজিটিভ, বিকাশ, বি পজিটিভ !’ আমার ব্লাড-গ্রুপও আমাকে বাঁচতে শিখিয়েছে। পজিটিভলি।
আনন্দগান নিয়ে।
No comments:
Post a Comment