খুব একটা অজ-পাড়াগাঁয় আমার জন্ম
হয়েছিল। বাবা-মায়ের ভালবাসা আর প্রকৃতির খোলা হাওয়ার বদান্যতাটুকু ছাড়া আর কোনও
সুযোগসুবিধা কপালে জোটেনি। পড়াশোনা থেকে শুরু করে জীবনধারণের প্রতিটি ধাপের জন্য
অনবরত কোনও না কোনও বিরুদ্ধ শক্তির সঙ্গে
মোকাবিলা করে এগোতে হয়েছে। বাবা-মা যে
প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন, সেখানেই আমি পড়তাম। বাড়ি থেকে তার দূরত্ব ছিল এক
থেকে দেড় কিলোমিটার। পুরোটাই হাঁটা পথ। তখনও রাস্তাগুলোতে মোরাম বিছানো হয়নি।
এঁটেল মাটির কাঁচা রাস্তা বর্ষাকালে যে কী রূপ নেয় তা ভুক্তভোগী ছাড়া কাউকে বলে
বোঝানো যাবে না। তার ওপর, কেন জানি না, তখন সৌন্দর্যায়নের জন্য বাবলা গাছ লাগানো
হত আর তার যাবতীয় কাঁটা পথেই পড়ত। ফলে বর্ষার দিনে সেই পথ আক্ষরিক অর্থেই হয়ে থাকত
কাঁটা-বিছানো। অথচ সেই পথেই রোজ আমার বাবার হাত ধরে পায়ে হেঁটে স্কুলে যাওয়া।
অনেক বড় বয়স পর্যন্ত এরকম এক
গ্রামেই থেকেছি। শহর জীবনের সংস্পর্শে প্রথম আসি কলেজে পড়তে এসে। শিক্ষিত আদব-কায়দা কিছুই শেখা
হয়নি ছোট থেকে। কত যে গ্রাম্য অভ্যাস আর গোঁড়ামি ভেতরে গেড়ে বসেছে, তা শহরে আসার
আগে টেরই পাইনি। ফলস্বরূপ সহপাঠীদের কাছে একটা মজার খোরাক হয়েই থেকে গেছি চিরদিন।
এমন কাউকে পাইনি, যে আমার ভেতরে গেঁথে থাকা সেই সব সভ্য-সমাজে-অচল কাঁটাগুলিকে
কোনও চিমটে দিয়ে তুলে দেবে। অথচ জীবন এমনই, সেই যে কলেজে পড়তে চলে এলাম গ্রাম
থেকে, পরবর্তীকালের লেখাপড়া থেকে জীবিকা সবই হয়ে গেল শহর-নির্ভর। গ্রাম জীবনে আর
ফেরাই হল না। আর ভেতরের সেই কাঁটাগুলো নিয়ে কি কলেজ-জীবন, কি কর্মস্থল, সর্বত্রই
থেকে গেলাম অপাংক্তেয়, দলছুট। কোথাও কোনও বন্ধু জুটল না সেইভাবে।
অবস্থাটা পাল্টাতে শুরু করেছে
সম্প্রতি, এই পরিণত বয়সে এসে, ছেলে-মেয়ে একটু বড় হওয়ার পরে। তারা তো আর গ্রামে
মানুষ হয়নি। জেলা শহরের নামী স্কুলে পড়ে। উন্নত পরিষেবা, উন্নত পরিবারের সন্তানদের
সঙ্গে তাদের সখ্য। ফলে আমার ভেতরে থাকা সেইসব অজ্ঞানতা আর গোঁড়ামিগুলিকে পরম মমতায়
একটু একটু করে তুলে ফেলতে শুরু করেছে তারা এখন। ধীরে ধীরে তাদের কাছেই আমি শিখছি
গ্রামে বড় হওয়ার ফলে আমার ভেতরে না গড়ে ওঠা শিক্ষিত আদব-কায়দাগুলি। আর তাদেরই
সূত্রে এখন আমি তাদের শিক্ষক-শিক্ষিকা, বন্ধুবান্ধবদের বাবা-মা, সভ্য জনদের সঙ্গে
মিশতে শিখছি।
আমাদের ছোটবেলায় জন্মদিন পালনের
কোনও রেওয়াজ ছিল না। যে বাংলা মাসটিতে আমার জন্ম হয়েছিল, সেই মাসের যে কোনও একটা দিনে মা পায়েস বানিয়ে
বাড়ি বাড়ি পাঠিয়ে দিত। ব্যস, সেটাই ছিল আমাদের জন্মদিন পালন। গ্রাম থেকে চলে আসার
পর তো সেটুকুও আর হয় না। ফলে, নিজের জন্মদিনটি কবে যে নীরবে আসে আর চলে যায়,
নিজেরই খেয়াল থাকে না।
কিন্তু ছেলে-মেয়ের জন্যই এখন আর
তা হচ্ছে না। গত জন্মদিনটার কথাই বলি। অন্যান্য সব দিনের মতো অফিসের একটা তুমুল
ব্যস্ত দিন পেরিয়ে সন্ধে নাগাদ বিধ্বস্ত অবস্থায় ঘরে ঢুকে দেখি চারদিকে বেলুন
টাঙানো। একটা উৎসব উৎসব পরিবেশ। সেদিনটাই যে আমার জন্মদিন, যথারীতি আমার মনেই ছিল
না। আমি যখন অবাক হয়ে ভাবছি, কী ব্যাপার, আমাকে চমকে দিয়ে আমার ছেলে-মেয়ে তাদের ছোট-ছোট হাতে বানানো বার্থডে কার্ড, কেক আর কিছু
সামান্য উপহার আমার হাতে তুলে দিয়ে আমাকে
জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাল।
ছেলে-মেয়ের জন্মের পর শহরের
রীতি অনুযায়ী ঘটা করে প্রতি বছর সঠিক ইংরেজি তারিখটাতে তাদের জন্মদিন আমরা পালন
করে থাকি। কিন্তু উল্টোটা, মানে বাবা-মায়ের জন্মদিনও যে সন্তানদের পালনীয়, তা আমি
আগে কখনও ভাবিনি। আমি আমার সন্তানদের কাছেই শিখলাম। সামনের বৈশাখে আমার বাবা
পঁচাশি বছর পূর্ণ করবেন। আমরা তিন ভাইবোন যে যার কর্মস্থলে দূর শহরে থাকলেও বাবা-মা
তাঁদের গ্রাম আগলেই পড়ে আছেন। ভাবছি ভাইবোনকে ডেকে নিয়ে বাবার সামনের জন্মদিনটা
সবাই মিলে ঘটা করে পালন করলে কেমন হয়। আমি আমার ছেলে-মেয়ের কাছে শিখেছি। তারাই
আমার শিক্ষক।
No comments:
Post a Comment