Friday, September 14, 2018

আমার প্রিয় শিক্ষক-- মণিমেখলা মাইতি







ঠিক মাঝখানে লাল গুটিটা। তার চারিদিকে জ্যামিতিক আকারে সাদা-কালো, সাদা-কালো। একটু হাত দিয়ে ধরে ঠিকঠাক করে নিশানা ঠিক রেখে ঠকাস করে শব্দ। নিস্তরঙ্গ ঝিলে যেন কেউ ঢিল ছুঁড়ল।দীঘির মধ্যে চুপ করে থাকা জল চূর্ণবিচূর্ণ হতে হতে ঢেউ হয়ে  তির তির করে এগিয়ে যাচ্ছে অতলান্তিকের দিকে। তেমনি সব সাদা-কালো গুটিগুলো এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়ল। একটা সাদা পকেটেওপড়লনা। স্ট্রাইকার চলে গেল ডানদিকে যে তার কাছে। তারপর আরো ডানদিকে। এবার আর বিরাম নেই। একের পর এক সাদা গুটির ইহলীলা সাঙ্গ হচ্ছে। মেয়ে নির্বাক। কী নির্ভুল নিশানা।  চৌকোনোকাঠের ময়দানটা ফাঁকা হয়েই এল। দুটো লাইনের মাঝে গোল চাকতিটা রেখে হঠাৎই মুখ তুলে উল্টোদিকে বসা কন্যাকে প্রশ্ন--"আচ্ছা, lieutenant বানান টা কী?" মেয়ে এবার আমতা আমতা করছে।শেষ সাদাগুটিটা নির্দ্বিধায় পৌঁছে গেল ডানদিকের পকেটে। রণাঙ্গন ফাঁকা। উত্তর চলে এল--' মিথ্যে তুমি দশ পিঁপড়ে।' আবার গুটি সাজানো চলছে। পরবর্তী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ক্ষেত্র। এরকম করেআরো দুতিনটে বানান। মেয়ের মাথায় গীতার বাণীর মত সব গাঁথা হয়ে গেল। 



   ছোট্ট মেয়ে হাত ধরে চলেছে বাবার সঙ্গে। মাথায় তার এক ঝাঁকা চুল। বাবার হাতে নাইলনের তৈরি বাজারের ব্যাগ। কত বকবকানি। পায়ে পায়ে মেয়ে ছুটছে। রাজবাড়ির ভাঙা গেটের কাছে গড়বরাবর ওই বড় ইস্কুলটা পেরিয়ে খাল ডিঙ্গোলেই মফস্বলের বাজার। উঁচু ব্রিটিশ আমলের ব্রিজ থেকে ডানদিকে লাল স্কুল বাড়িটা থেকে দৃষ্টি আরেকটু বাড়ালে হলুদ রং করা বাবার কলেজ। বাবা পড়ায়সেখানে ইংরেজি সাহিত্য। ছাত্রদের সঙ্গে স্যারের ভারী আহ্লাদ। তারা কবি সম্মেলন করে, পত্রিকা বের করে, মেয়েরা গেয়ে ওঠে--" মোরা জলে স্হলে কত ছলে মায়াজাল গাঁথি"। ছোট ছোট চালার মতসারিসারি সব দোকান। গ্রামের বাগান থেকে চাষীদের হাতে বয়ে আনা সব তাজা তাজা সবজি। ছোট ছোট বেগুন, সবুজ সবুজ পটল, শিরা তোলা কচি ঝিঙ্গে, নরম ছনছনে পুঁইশাক, ছোট ছোটপাতাওয়ালা লালচে নটে, আলু, বেগুন, পিঁয়াজ আরো কত কী। বাবা নিজের হাতে তুলে তুলে মেয়েকে শিখিয়ে দিচ্ছে কেমন হাত দিয়ে ছুঁয়ে, বেছে সবজি কিনতে হয়। বেগুনে যেন পোকা না থাকে,ঝিঙে যেন শক্ত না হয়, ঢ্যাঁড়শ যেন বাচ্চা শিশুর মত নরম হয়, উচ্ছে যেন হয় একটু সবুজ সরু। আলু, পিঁয়াজ সব নিজের হাতে তুলে নিতে হয়, অন্যের উপর ভরসা করতে নেই। 

 সবজিওয়ালাদের বামদিকে শানবাঁধানো মেঝেতে লম্বালম্বি শুয়ে আছে সব রুই কাতলা মৃগেল। ভারী শরীরের লতিমাসি বলির কাঠের মত ইয়াবড় বঁটি নিয়ে বালতি থেকে জল ছিটিয়ে দিচ্ছে হাপরটানা মাছগুলোর ওপর। সামনে একটা চ্যাপ্টা গামলায় কলাপাতার ওপর ধনুকের মত বাঁকছে কয়েকটা কইমাছ আর পাঁকাল মাছ। মেঝের ওপর উপুড় হয়ে আছে কিছু চিংড়ি। হাত দিয়ে না টিপে,কানকোটা না তুলে একটু দেখে মাছ কেনা নয়। পৃথিবীতে শেখার কোন শেষ নেই। সেই যে অভ্যেস হল, সে অভ্যাস এখনো যায়নি। মাছ দোকান আর সবজি দোকানের মাঝখানটায় একটুকরো চটপেতে জড়োসড়ো করে বসে থাকে এক বৃদ্ধ। সামনে তার ছোট ছোট পুঁটলিতে কুমড়ো বিচি, ঢ্যাঁড়শ বিচি, চিচিঙ্গা বিচি। গোড়ায় কাদা মেখে শুয়ে থাকে কিছু বেগুন চারা। ওরাও সঙ্গে আসে। বাড়ি ফিরেজলে ভেজানো বীজ আর বেগুন চারা সব প্রোথিত হয়  বাড়ির সামনের এক চিলতে জমিতে। মেয়ে শিখে নেয় সব কিছু। মাটি কোপানোও একটা শিল্প যে। গোড়ার দূর থেকে খুরপি যাবে, শিকড়সুরক্ষিত অথচ মাটি আলগা। হাঁ করে মেয়ে খালি ভাবে।

  স্কুলে অনুষ্ঠান। মেয়ে দেবে ছোটখাটো বক্তিমে। বাবা মাটিতে বঁটি নিয়ে বসে। একে একে সরু সরু করে কাটা উচ্ছে, একটু মোটা মোটা, সমান করে কাটা কাঁচকলা, আলু, বেগুন সব জমা হচ্ছে পাশেরবাটিতে। সঙ্গে মেয়েকে ক্রমাগত নির্দেশ। কী বলতে হবে, কীভাবে বলতে হবে, কোন লাইন উদ্ধৃত করলে ভালো হয়। আনাজ কাটার পালা সাঙ্গ হলে  রান্না। খুন্তি ধরাটাও যে একটা আর্ট সেটাও বক্তিমেশেখার মধ্যে টুক করে শিখে ফেলা চাই। ফ্যান গালাবার পর হাঁড়িটা ভিজে কাপড়ে যে মুছে রাখতে হয় সে শিক্ষাও বাদ যায়না। আবার ব্যাডমিন্টন খেলার সময় রাকেটটা যাতে খুন্তির মত ধরা না হয়সেদিকেও সজাগ দৃষ্টি। 

   প্রতিবছরের মত সেবছরও ময়নাগড়ে প্রবল বন্যা। নদী দুকূল ছাপিয়ে মাঠ, পুকুর সব ডুবিয়ে বাড়ি ঘরের প্রায় দোতলা ছুঁয়ে ফেলেছে। বাবা চলেছে একটা স্কুলে ইন্টারভিউ নিতে। সঙ্গী মেয়ে। যেদিকেচোখ যায় চারিদিকে শুধু জল আর জল। নৌকো জল সরিয়ে ছলাৎ ছলাৎ চলছে।  যে স্কুল বাড়িটাই শুধু জেগে। কলার মান্দাসে ভেসে গ্রামের বউরা বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে জেগে থাকা নলকূপ থেকে জলনিয়ে যাচ্ছে। হাঁটু পর্যন্ত প্যান্ট তুলে নৌকোয় ভেসে একে একে জড়ো হয় সব দরখাস্তকারী। তারপর ক্লাস টিচিং, ইন্টারভিউ।  ছোট মেয়ের হয়ে যায় জটিল  জীবনের হাজারো শিক্ষা। সবার সঙ্গে ডাল,ভাত মেখে খেতে খেতে ভাবে বড়ো হওয়ার ঝামেলা আছে বটে।



  টেন্সের খাতায় জ্বল জ্বল করে বাবার লেখা। গো ভার্ব দিয়ে করা কনজুগেশন মিক্সারের মত ছড়িয়ে যায় মস্তিষ্কর শিরায় শিরায়। কোনদিন ভুল হয়না তার। বাবার সংগ্রহের তাক থেকে টেনে নেয় সেচার্লি চ্যাপলিনের 'এই যে আমি', ' ওথেলো'মেয়ে পড়ে চলে পড়ার বই ফেলে দিনরাত। লোকে বলে বসে --'এই বয়সে এই বই! গোপনে প্রেম করতে সুবিধে হবে '। বাবা শুধু মুচকি হাসে। রবিবারের সকালেকী যে ছাই বোঝে তবুও খুলে  বসে কালিদাস রচনাসমগ্র। আত্মীয় খপ করে তুলে নিয়ে বলে--'  বয়সে  বই পড়ার নয়'। কই বাবাতো মেয়েকে কোনদিন বলেনি সাহিত্য আবার নাবালকের কিংবাসাবালকের। মেয়ে তাই অবাক হয়। কখনো বা সাহিত্যের তত্ত্বমূলক বই পড়তে পড়তে মেয়েকে ডেকে দেখিয়ে দেয় সব লাইন--"We play with words and words play with us"। সে সব লাইন  উঠেআসে মেয়ের খাতায় অগোচরে। অংক, পদার্থ বিদ্যা, রসায়ন আর মেয়ের মন মজাতে পারেনা। জীবন চলে নিজের ছন্দে। কখন বাবা যে শিক্ষক আর শিক্ষক কখন বাবার আসনে বসে মেয়ে আজোবোঝেনি।



  খোলা ছাদে মাদুর পেতে হ্যারিকেনের আলোয় পড়িয়ে চলেছে দিদিমণি ধ্রুবতারা, কালপুরুষ, সপ্তর্ষিমণ্ডল। মুখ তুলে আকাশে চেয়ে ছোট্ট মেয়েটি দেখে সারা আকাশ জুড়ে বইয়ের পাতা খোলা। ঘনকালো অন্ধকারে দিদিমণি চিনিয়ে দেয় সাতটি তারা, শিকারী কুকুর, সন্ধ্যাতারা। সেই মুহূর্তে গগনতল নেমে আসে বইএর পাতায় পাতায়। বহুবছর পর মেয়েটি তার আত্মজকে নিয়ে সেই খোলাআকাশের নীচে তারা চেনাতে গিয়ে দেখে সন্ধ্যাতারার কাছে জ্বল জ্বল করছে এক তারা তাতে মীরা পিসিমণির সেই পরিচিত মুচকি হাসি। কৃতজ্ঞতায় চোখে জল চলে আসে মেয়েটির। মীরা পিসিমণিকেপ্রণাম জানিয়ে আত্মজকে জড়িয়ে ধরে। চিনিয়ে দেয় একে একে কালপুরুষ, সপ্তর্ষিমণ্ডল--সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে।

  সে বহু বছর আগের এক কর্মব্যস্ত বিকেল। হাওড়া থেকেই লোকাল ট্রেনে থিকথিকে ভীড়। কলেজ ফেরত ক্লান্ত পড়ুয়া, অফিস ফেরত শ্রান্ত  অফিসযাত্রী, সারাদিন মাছ, সবজি ফেরি করে সবপসারিনী, হকার সবাই আছে। উল্টোদিকে মলিন বস্ত্রে এক বুড়ি বসে। চোখ বুজে মাথাটা এলিয়ে দিয়েছে পিছন দিকে। কোলে একটা পুঁটুলি। আমার পাশে এক সুবেশা আধুনিকা। ডানহাতে ঘড়ি, উঁচুকরে বাঁধা খোঁপা, কাঁধে শান্তিনিকেতনী ব্যাগ। সুরভির গন্ধে ভুরভুর করছে চারপাশ। তাঁর পাশে আমি কোনরকমে বসে। পরনে সাধারণ চুড়িদার, এক শুভানুধ্যায়ী দেওয়া ব্যাগে ওই যাতায়াতের মান্হলি, কয়েকটা টাকা, আর বই খাতা। পেটে ছুঁচোর ডন। মন জুড়ে তখন শেক্সপিয়র,  গলসওয়ার্দি, হার্ডি। যেকোন বিলাসিতাই এক স্বপ্ন। হঠাৎই আমার সামনে বসা বুড়ি ঢলে পড়ল সামনে। অজ্ঞানরীতিমতো। আমার ব্যাগেও জল। কিন্তু   সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার মত মানসিকতা হয়নি। হঠাৎই দেখি সেই সুবেশা তরুণী নিজের ব্যাগ খুলে জল বোতল বের করে জল ছিটিয়ে দিল পরমমমতায়। শাড়ি দিয়ে মুখ মুছিয়ে বৃদ্ধাকে আরাম করে বসিয়ে দিলেন। তার পর আমাকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে নিজের ব্যাগ থেকে কড়কড়ে চারটি দশটাকার নোট বের করে পরম মমতায় বেঁধেদিলেনসেই বৃদ্ধার মলিন  অঞ্চলপ্রান্তে। বললেন--" কিছু খেয়ে নেবেন"। আমার ভিতর থেকে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এসেছিল এই কথাগুলো--"you are so  great!" সুবেশা তরুণী বলে উঠলেন --'' না নাজানোনা এদের কত কষ্ট!! এরা না খেয়ে কেমন সারাদিন কাটে"। আমি তাঁকে মুহূর্তে দেবীর আসনে বসিয়ে ছিলাম। জীবন যে কোথায় পাঠশালা খুঁজে পায় এই বিশ্বজোড়া বিদ্যাঙ্গনে সে এখনো আমারকাছে এক রহস্য। 



  যে ছেলেটি ঝড়জলের রাতে আমার কর্তাকে ষাট টাকায় রফা করে বাড়িতে এনে পৌঁছে দিয়ে টাকার পরিবর্তেউচ্চমাধ্যমিকের ইংরেজি আর বাংলা বই চেয়েছিল আমাদের কাছে জানিনা তাকে সেইরাতে খুশি করতে পেরেছিলাম কিনা তবুও সেই অল্প বয়সী ছেলেটিকে নতমস্তকে প্রণাম করেছিলাম তার অধ্যবসায় দেখে।বাংলা ইংরেজি বইএর সঙ্গে হাতের মুঠোয় ষাট টাকা গুঁজে দিতে চেয়েছিলাম।সে নেয়নি। বলেছিল--আমি বই চাই, টাকা চাইনা'।ছাত্রীপড়ানো শিক্ষিকা আমি সেই মুহূর্তে ছেলেটিকে শিক্ষকের আসনে বসিয়েছিলাম।এত অধ্যবসায়তো কোনদিন আমার ছিলনা!!



জীবন এক জটিল আবর্ত।ভাড়া বাড়ির সামনে ঘুঘু পাখির বাসা গুলো, হলুদ কলকে ফুলের বিষাক্ত ফল, কোন এক ভাস্করের তৈরি গান্ধীজীর পাথরের মাথায় বাইতে থাকা শুঁয়োপোকা, মায়ের অসম্ভবসময়জ্ঞান, কর্তব্যনিষ্ঠা, যার সঙ্গে বাড়ির ছাদ, সুখ দুঃখ সব ভাগ করে নেই তার কাছ থেকে মাথা উঁচু করে বাঁচার লড়াই শেখা, যে ছাত্রী নাবালক বয়সে বিয়ে করে বসে বাবা মার অবহেলায়( আমায়নির্দ্বিধায় বলে -'না হলে বাঁচতাম কী করে দিদি?') আমায় শিখিয়ে দেয় এজীবনে নিজের জীবন নিজেকেই গড়ে নিতে হয়
নির্বাক শ্রোতা হয় বুঝে নিতে হয় পৃথিবীর হৃৎস্পন্দন। জীবনে ভাঙা গড়াআসে। আমরা শিখেই চলি।




  রাত বারোটার সময় আমার পৃথিবী নিঝুম হলে আমার আত্মজ যখন গলা জড়িয়ে বলে চলে --" জাপানের পতাকার লাল গোলটা আগে কোথায় ছিল, কেন কত ইঞ্চি সরে গেছে;  দোর্দণ্ডপ্রতাপ ফুটবলদলের কতরকমের জার্সি আছে, কোন দেশে কোন উড়ান প্রথম উড়ল" আমি বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে জানি  জানা আর ফুরোলো না আমি তাই  মধ্যরাতে ঘড়ির কাঁটা শূন্য শূন্য হয়ে ক্যালেন্ডারেসেপ্টেম্বরের পাঁচ তারিখ হলে আমার  আত্মজকেই বলি--" হ্যাপি টিচার্স ডে"।


No comments:

Post a Comment

একনজরে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"ইস্কুল বলিতে আমরা যাহা বুঝি সে একটা শিক্ষা দিবার কল। মাস্টার এই কারখানার একটা অংশ। সাড়ে দশটার সময় ঘণ্টা বাজাইয়া কারখানা খোলে। ...