Friday, September 14, 2018

ধারা ৩৭৭, সুপ্রিম কোর্ট এবং একটি সবুজ সাপ - দেবব্রত শ্যাম রায়












সমকামকে দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা থেকে বিযুক্ত করে দেওয়ার রায়ে নবীন প্রজন্মের মধ্যে যে আন্তরিক উচ্ছাস ও সংবেদন চোখে পড়ল, তা অভূতপূর্ব। বিগত এক দশক ধরে নানা সময়ে সমকাম জনপরিসরের নানা চর্চায় উঠে এসেছে, কিন্তু এর আগে কখনও ভারতের নাগরিক সমাজকে বিষয়টির জন্য এতটা প্রস্তুত বলে মনে হয়নি। পাশাপাশি, বেশ কিছু প্রতিস্বরও শোনা গেল, যা মূলত বিরক্তি ও হতাশার প্রকাশ। বোঝা যায়, এর বেশিরভাগটাই অজ্ঞতাপ্রসূত, আজন্মলালিত বিশ্বাস ভেঙে যাওয়ার জাড্য, আর বাকিটা মৌলবাদী অন্ধত্ব। শাসক দল বিজেপি এই নিয়ে কোনও মন্তব্য না করলেও আর এস এস সরাসরি এই রায়ের নিন্দা করে বিবৃতি দিয়েছে। সমকাম নাকি একধরনের 'জেনেটিক অ্যাবারেশন', সন্তান উৎপাদনের উপযোগীতাহীন, তাছাড়া সমকামে নাকি বেশি করে এইডস হয়, অতএব ঘৃণার্হ। কেউ কেউ সমকামীদের সুস্থ করার জন্য হরমোনজনিত চিকিৎসার নিদান দিচ্ছেন, জোর করে তৈরি করা হচ্ছে সংখ্যাগুরুর যাপনের বিপরীতে এক সংখ্যালঘু 'অপর'-এর সংজ্ঞা।  ঠিক যেভাবে মধ্যযুগের অন্ধকার ইউরোপ 'অপর'কে নির্মাণ করেছিল, যাদের ডাইনি অপবাদে দলবদ্ধভাবে পুড়িয়ে মারা হত।

এই রায়ের সূত্র ধরে আগামী দিনে একটি দু'টি ঘটনা আমরা দেখতে পাব। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই হয়তো টিভিতে নতুন বিজ্ঞাপন দেখা যাবে, কন্ডোম, শ্যাম্পু বা শেভিং ক্রিমের বিজ্ঞাপনে চলতি হেটেরো-ইরোটিক অন্তঃস্রোতের বাইরে গিয়ে উঠে আসতে পারে কিছু সূক্ষ সমকামী ইশারা। অথবা টেলিভিশনের পর্দায় নতুন সমকামী দম্পতীকে দেখতে পাব, যারা বাড়ির জন্য ফ্রিজ বা মাইক্রোওভেন কিনতে এসেছেন। বিখ্যাত প্রেসার কুকার প্রস্তুতকারক সংস্থা এবার হয়তো লিঙ্গ-নিরপেক্ষ ট্যাগলাইন নামাবেন, 'পার্টনারকে যদি সত্যিই ভালোবাসো, তবে আজই....' ইত্যাদি ইত্যাদি। এভাবেই নতুন স্বীকৃতিপ্রাপ্ত গ্রাহক সমাজকে অনুমোদন দিতে ক্লজেট থেকে বেরিয়ে আসবে বাজার।
অর্থাৎ যেটা লক্ষণীয়, এই রায় বাজারবিরোধী নয়। বরং এই রায়কে বাজার ব্যবহার করবে, সমকামীদের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ হবে, আরও কিছু রুপো ঘরে তোলবার জন্য। বাজারের কাজই তাই। তবে সমালোচনার ঝুঁকি নিয়ে একটা প্রশ্ন তুলে ফেলা যাক, কোনওভাবে সমকামীদের অপরাধী তকমা থেকে নিষ্কৃতি সংক্রান্ত রায়টি যদি বাজারবিরোধী হত, এই রায়টি কি এত সহজে দিনের আলো দেখতে পেত? অথবা একটু অন্যভাবে বলা যায়, উদার-প্রগতিশীল-গণতান্ত্রিক, এমন সব কিছুর সঙ্গেই কি বাজার অর্থনীতির সম্পর্ক সবসময় বন্ধুত্বপূর্ণ? পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় দেশের বাজার কি সেই মসিহা যে পাশে থাকলে কোনও প্রগতিমুখী পদক্ষেপকে আটকে রাখতে পারবে না কেউ, এমনকি রাষ্ট্রও পারবে না? দাঁড়ান বন্ধু, বাজার অর্থনীতির সদর্থক ভূমিকা নিয়ে খুব বেশি গদগদ হয়ে পড়ার আগে আমরা আরও একটি সংবাদের দিকে চোখ ফেরাই।

তারিখটাও এক। ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮। ঘটনাস্থলও এক। ভারতের সর্বোচ্চ আদালত। অর্থাৎ ঠিক যেদিন সুপ্রিম কোর্ট ঐতিহাসিক রায়ে সমকামকে অপরাধের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করে দিলেন, ঠিক সেদিনই আরেকটি রায়ে ভীমা-কোরেগাঁও ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে গত মাসে গ্রেফতার হওয়া পাঁচ সমাজকর্মীর গৃহবন্দিত্বের মেয়াদ ১২ই সেপ্টেম্বর অবধি বাড়িয়ে দিলেন। অথচ একথা স্পষ্ট যে ডিসেম্বর ৩১, ২০১৭ তারিখে ভীমা-কোরেগাঁও-এ ঘটে যাওয়া দলিত বিক্ষোভের ঘটনার সঙ্গে এই মামলার কোনও যোগ নেই, পুণের সেই বিক্ষোভের পর বেশ অন্য কয়েকজনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল কয়েকমাস আগেই, এবং সেই চার্জশিটে এই পাঁচ সমাজকর্মীর নামের উল্লেখমাত্র ছিল না। বস্তুতঃ, এবারই এই পাঁঁচজনকে ধরপাকড়ের সময় এঁদের বিরুদ্ধে অন্য একটি অভিযোগ শোনা যাচ্ছিল। এই পাঁচজন অর্থাৎ আটাত্তর বছর বয়সী কবি ভারভারা রাও, সুধা ভরদ্বাজ, গৌতম নওলাখা প্রমুখেরা নাকি প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার ছক কষছেন। সেই অভিযোগ হালে পানি পাবে না বুঝতে পেরে পুলিশ শেষ পর্যন্ত আদালতে তা উল্লেখ করা থেকে পিছিয়ে আসে এবং ভীমা-কোরেগাঁও বিক্ষোভের সঙ্গে যোগাযোগটিকে অভিযোগ হিসাবে হাজির করে। অর্থাৎ, বোঝাই যাচ্ছে, এক্ষেত্রে পুলিশের (পড়ুন রাষ্ট্রের) মূল উদ্দেশ্য ছিল এই পাঁচজনকে যেনতেনপ্রকারেণ নিগ্রহ করা, ভয় দেখানো৷ এবং এর মাধ্যমে এঁরা যেসব 'রাষ্ট্রবিরোধী' কাজের সঙ্গে যুক্ত, তা থেকে দূরে সরিয়ে আনা। সেটা করার জন্য যা যা দরকার, যেমন ভীমা-কোরেগাঁও-এর বদলে গরুচুরির অভিযোগ যদি বেশি কার্যকরী হত, সেটাই দায়ের করা হত। রাষ্ট্রবিরোধিতার মুখ ছলে-বলে-কৌশলে বন্ধ করাই তো রাষ্ট্রের কাজ। সুধা ভরদ্বাজ রাষ্ট্রবিরোধী কারণ তিনি একজন আইনজীবী হিসেবে বিনা পারিশ্রমিকে আদিবাসীদের অধিকারের পক্ষে লড়াই করছেন। গৌতম নওলাখা রাষ্ট্রবিরোধী কারণ তিনি রাফালে ডিল নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি বারবার নগ্ন করে দেন নিজের লেখায়। কবি ভারভারা রাও, ভারনন গঞ্জালভেস রাষ্ট্রবিরোধী কারণ তাঁরা রাস্তায় নেমে উন্নয়ন নামক এই কর্পোরেট লুটের বিরুদ্ধে সচেতন করে দেন দেশের কৃষক, শ্রমিক, অরণ্যচারী আদিবাসীদের। আর কে না জানে, পুঁজিবাদী দেশে আদিবাসীসহ দেশের প্রান্তিক মানুষজনের অধিকার সুরক্ষিত করার জন্য লড়াই করার অর্থ সরাসরি রাষ্ট্র ও কর্পোরেট আঁতাতের বিরুদ্ধে যাওয়া, যে আঁতাত দেশের পাহাড় নদী অরণ্যের সম্পদ ছলেবলেকৌশলে কেড়ে নিতে চায়, দেশের প্রাচীন কৃষিব্যবস্থাকে তামাদি করে দিয়ে বিদেশি বীজ, সার, ও দামি কীটনাশকের আগ্রাসন নামিয়ে আনে। নিয়মগিরি থেকে খাম্মাম, সরদার সরোবর বাঁধ থেকে তুতিকোরিণ, সর্বত্রই উন্নয়নের নামে পরিবেশ ও ভূমিপুত্রদের উৎখাত করার এক দানবিক রোডরোলার চলে আমাদের দেশে, রবীন্দ্রনাথের 'রক্তকরবী' বহুবছর আগেই যার কদর্য মুখ আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে। এই পাঁচ সমাজকর্মী প্রান্তিক মানুষের সরব সহযোদ্ধা অর্থাৎ গণিতের সামান্য নিয়মে রাষ্ট্রের শত্রু, মুনাফার শত্রু, বাজার অর্থনীতির শত্রু।  স্বাভাবিকভাবেই, এঁদের শাস্তি রাষ্ট্রনির্ধারিত, সম্ভব হলে সাতদিনের ফাঁসি। সেকারণে ভীমা-কোরেগাঁও বা ওই জাতীয় কোনও ঘটনাকে শিখণ্ডী খাড়া করার দরকার ছিল, কিন্তু তাড়াহুড়োয় মিথ্যা অভিযোগের কাঠামোটিও অতিশয় দুর্বল। তা সত্ত্বেও, সুপ্রিম কোর্ট এই পাঁচ সমাজকর্মীর গৃহবন্দিদশার মেয়াদ বাড়িয়ে অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক একটি রায় দিল। অথচ আমরা ভেবেছিলাম, এরকম একটি নড়বড়ে অভিযোগে ভরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলায় ওই পাঁচ সমাজকর্মীর নিঃশর্ত মুক্তি শুধুমাত্র কেসটি সর্বোচ্চ আদালতে ওঠার অপেক্ষা। আমাদের বিস্মিত করে তা হল না। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার, সুপ্রিম কোর্টের যে বেঞ্চ এই রায় দিয়েছে, সেই বেঞ্চেরও সদস্য ছিলেন জাস্টিস ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় যিনি একই দিনে একটু আগেই সমকাম নিয়ে অমন প্রগতিশীল ও ঐতিহাসিক বিবৃতি দিলেন।

অর্থাৎ দুইয়ে দুইয়ে যে সর্বদা চারই হবে, এমন নয়। একই দিনে সুপ্রিম কোর্ট থেকে বেরোন দু'টি রায়ের একটি উদার, প্রগতিশীল, বাজারবান্ধব। অপর রায়টি আশ্চর্যজনকভাবে অগণতান্ত্রিক হলেও বৃহত্তর অর্থে বাজারবান্ধব কারণ তা পরোক্ষে রাষ্ট্র ও কর্পোরেটের স্বার্থকে রক্ষা করে। না, আমরা অবশ্যই এই দুটি রায়ের ভিত্তিতে এমন কোনও সরলীকরণে যাব না, যার দ্বারা মনে হতে পারে আমাদের বিচারব্যবস্থায় বিচারকরা সকালে পুঁজিবাদের হ্যান্ডবুক মুখস্থ করে নিয়ে তারপর আদালতে রায় দিতে যান। তবে এই সন্দেহটা মনে গেঁড়ে বসা স্বাভাবিক যে, বাজার অর্থনীতি যা চায় না, সেরকম কোনও নিদান ভারতবর্ষের আদালত থেকেও সহজে বেরিয়ে আসবে না। তাই দেশের বিচারব্যবস্থাকে সাধারণ মানুষ সংবিধানের রক্ষাকবচ জ্ঞান করলেও, তা খানিক সত্য হলেও, কোথাও না কোথাও সেও একই সিস্টেমের অঙ্গ। এ এমন এক সিস্টেম, যে রাষ্ট্রের পাশে অশরীরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে, পুলিশের সঙ্গে মিশে গিয়ে গুলি চালাচ্ছে নন্দীগ্রামে-কলিঙ্গনগরে, আবার সকলের অলক্ষ্যে নজর রাখছে আমার-আপনার ফেসবুকের পাতায়, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে, নীরবে বুঝে নিতে চাইছে আমাদের সমস্ত রাজনৈতিক মতামত, এমনকি ইন্টারনেটে আমার টাকা খরচ করার প্যাটার্ণটাও। আজ পণ্যরতির যুগে সান্দ্র, ঈষৎ চটচটে, সর্বব্যাপী, সর্বশক্তিমান এই বাজারকে ঈশ্বরের আসন দিতে বাধা কোথায়!

দণ্ডবিধি ৩৭৭-তে ফেরা যাক। সুপ্রিম কোর্টের এই রায় একটি চূড়ান্ত অসম ও রিগ্রেসিভ সমাজের উপরিতলকে ছুঁয়েছে মাত্র, পুকুরের জলের ওপর খোলা বাতাস বয়ে যাওয়ার পর মৃদু কাঁপনের মতো। কারণ এখনও বাজারের সবল উপস্থিতি শুধুমাত্র উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত নাগরিক বৃত্তেই। নাগরিক সমাজ ছেড়ে যত আমরা ভারতবর্ষের আত্মার দিকে যাব, শহর ছেড়ে মফস্বল বা গ্রামের ঢুকতে চাইব, বাজার অর্থনীতির স্টেক ক্রমশ কমতে থাকবে। যে ব্যক্তিমানুষ 'কনজিউমার' হিসেবে যত নন-পারফর্মিং, বাজারের কাছে তার সুখদুঃখের মূল্য তত কম। তাই চূড়ান্ত বৈষমমূলক দরিদ্র শিক্ষাহীন ভারতীয় সমাজে অসাম্য থাকল কি ঘুচল, মানুষ মরল কি বাঁচল, তা নিয়ে বাজারের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই, যতক্ষণ না সেই সমাজ থেকে নতুন গ্রাহক উঠে আসছে।  ঠিক যেমন নিয়মগিরি পাহাড়ের পরিবেশ ও ডোঙারিয়া কোণ্ডদের জীবন নিয়ে বাজারের কোনও হেলদোল ছিল না, তার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল কীভাবে ও কত কম সময়ে নিয়মগিরির নিচের খনিজ বক্সাইট নিজ অধিকারে আনা যায়।
তাই এইসব প্রান্তিক মানুষদের জীবন ও পরিবেশ নিয়ে যারা মাথা ঘামাচ্ছেন, তাদের অধিকার রক্ষায় লড়ছেন, সেই ভারভারা রাও, সুধা ভরদ্বাজ, গৌতম নওলাখার মতো মানুষেরাই এই দেশের প্রকৃত বিবেক। রাষ্ট্র ও বাজার অর্থনীতি প্রথমে এঁদের ব্যবহার করার চেষ্টা করে, তা করতে না পারলে ভয় দেখায়, হুমকি দেয়, চিরতরে মুখ বন্ধ করে দেবার পরিকল্পনা করে। এঁদের চোখের মণির মতো রক্ষা করতে হবে আমাদের। লিঙ্গসাম্যের জন্য লড়াই অবশ্যই একটা জরুরি সংগ্রাম, কিন্তু সেই লড়াইয়ে পাওয়া এই একটি ছোট্ট জয় যেন সমাজের গভীরতর স্তরে বিকট অসাম্য থেকে আমাদের চোখ সরিয়ে দিতে না পারে৷ বাজার আসলে একটি সবুজ শীতল সাপ, তার চোখের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকা, তার প্রতিটি পদক্ষেপ সম্বন্ধে সচেতন থাকাও এই মুহূর্তে আমাদের একটা বড় কাজ।

(প্রসঙ্গত, এই লেখাটি ছাপা হওয়ার আগে পর্যন্ত খবর যে আইনজীবীরা অন্যত্র ব্যস্ত থাকা ইত্যাদি টেকনিকাল কারণে আদালত সেপ্টেম্বর ১৭ অবধি গৃহবন্দিদশার মেয়াদ বাড়িয়েছেন৷ সেইসঙ্গে একটি সুসংবাদও, ঐতিহাসিক রোমিলা থাপারসহ দেশের কিছু বিশিষ্ট চিন্তক অবিলম্বে এই পাঁচ নাগরিকসহ একই ধরনের মামলায় ধৃত সকল অভিযুক্তদের নিঃশর্ত মুক্তি চেয়ে পিটিশন জমা দিয়েছেন, আদালত তা গ্রহণ করেছেন ও খতিয়ে দেখছেন।)

No comments:

Post a Comment

একনজরে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"ইস্কুল বলিতে আমরা যাহা বুঝি সে একটা শিক্ষা দিবার কল। মাস্টার এই কারখানার একটা অংশ। সাড়ে দশটার সময় ঘণ্টা বাজাইয়া কারখানা খোলে। ...