Friday, September 14, 2018

আমার ঝি-মা -- গোধূলি আলো দাশ





শোক -আঘাত সইতে পারত সে আমার ঝি-মা”। আমাদের মাতৃতন্ত্রিক অন্দর পরিবারে বড় হতে হতে খুব ভাল লাগত এই পূর্বজ নারীর প্রসঙ্গ।ঝি-মা আমার বৃদ্ধ প্রমাতামহী  বরদাসুন্দরী। 
তেরো বছরের বরদাসুন্দরী যখন দুরুদুরু বুকে শশুর ঘর করতে এলেন তখন দেখা গেল তার স্বর্গত শ্বশুরমশাই যিনি এই সদাহাস্যময়ী বালিকা কে দেখে সুলক্ষণা জ্ঞানে নিজের পরিবারে বধূমাতা করে এনেছিলেন তিনি এই নির্ণয়ে ভুল করেননি।

সন ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দ। কিশোরী বরদাসুন্দরী শ্বশুরবাড়িতে সংসার যাত্রার বিভিন্ন পরীক্ষায় পাশ করতে থাকলেন। যথা গৃহস্থালীর কাজ, শাশুড়ী মায়ের কাছে সংসার পাঠে নবিসী, গোয়ালে গরু-বাছুরের বিশেষ আদরযত্ন ইত্যাদি। নববধূর প্রতি অতি কৌতূহল স্তিমিত হয়ে এসেছিল এমন সময় সংসারে সবাই যা দেখলেন তা তাঁরা ইতিপূর্বে প্রত্যক্ষ করেন নি। এমনই রসায়ন বর ও বধুর মধ্যে দেখা দিচ্ছে ! এই নতুন বালাইটি ছিল দাম্পত্য-প্রেম।

নগেন্দ্রনাথ পিতৃহীন , স্ব-অভিভাবক, নিজের ২০ বিঘা জমিতে ধান, বিবিধ সবজি চাষ করান, শহরের আড়ৎদারের কাছে ধান বিক্রি করেন, পানের বরোজ, পুকুরে মাছের চাষ ইত্যাদি রয়েছে। এছাড়াও যে এরারুট কেবল পেটের রোগের পথ্য ও আটা তৈরিতে ব্যবহৃত হতো সেই এরারুট চাষ করে তিনি শহরের বিখ্যাত বিলিতি বিস্কুটের কোম্পানিকে সরবরাহ করতেন। নগেন্দ্রের সংসারে তাঁর মা ও স্ত্রী ছাড়াও অনেক সদস্য ছিলেন যারা দূর সম্পর্কের আত্মীয় হলেও নগেন্দ্র তাদের ভরণপোষণ করতেন।  এহেন নগেন্দ্রনাথ তার নব বধুর সাথে নানান বিষয়ে গল্প করতেন যা সেই যুগে বিরল ছিল। তিনি কোথায় কি কাজে যান, কিরকম কথাবার্তা হয়, কি কি হিসাব মিলাতে হয় ইত্যাদি কাজের কথা গল্প করে বরদাকে বলতেন। এরকম লুকিয়েই তিনি স্ত্রীর জন্য এরারুট বিস্কুট কারখানা থেকে আনতেন। হরেক রকম ব্যক্তিগত উৎসাহ তাঁর । যে দেশে কানু বিনে গীত নাই সেই শ্যামল বাংলায় বৈষ্ণব কীর্তনের জোয়ার, প্রথমে গান শুনে খাতায় লিখে জমাতে লাগলেন। ক্রমে নিজে লিখলেন কিছু পদ। কীর্তনের সরল সুরে সেগুলি গুন গুন করেন। বরদার কন্ঠেও সেই গান তুলিয়ে তবে তাঁর শান্তি। চালের ব্যাপারী নগেন্দ্রর খেরোর খাতার শুদ্ধতা আর রইল না।  বই পড়ে কবিরাজি বিদ্যা শেখার চেষ্টা করতেন আর তাতেও বরদাকেই সঙ্গী করে নিতেন।

গ্রামে একবার মড়ক লাগলে বরদার কথামতো নগেন্দ্র শহরের কবিরাজ ডেকে এনে নিজের বাড়িতে রেখে বিনামূল্যে গ্রামবাসীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেন। এই গভীর সখ্যই ছিল এই দুটি মানুষের দাম্পত্য প্রেম।


গ্রামেরই দুটি ছোট ছেলে মেয়ে, ভাই বোন তারা
সন্ধের কিছু আগে মহোৎসাহে গরম তেলেভাজা নিয়ে বাড়ি ফিরছে। গদাধর দাসের নাতি নাতনি তারা। একদা এই গদাধর দাস দলবল নিয়ে নগেেন্দ্রর পিতা ফকিরচাঁদের বাড়িতে ডাকাত সেজে হামলা করে, ভয় দেখিয়ে ঘর তছনছ করে ধানের গোলায় আগুন লাগিয়ে পালিয়ে যায়। সে অনেক কাল আগের কথা নগেন্দ্র তখন শিশু। গদাধর এখন শয্যাশায়ী বৃদ্ধ। 
একটা শিয়াল  হঠাৎ তাড়া করল শিশুদুটিকে। শালপাতায় মোড়া তেলেভাজা ছিটকে পড়ল পথে । এই দৃশ্য দেখে ঝাঁপিয়ে পড়লেন নগেন্দ্র।শিশুদুটিকে বাঁচাতে পারলেও  নিজে শিয়ালের কামড় খেয়ে, জলাতঙ্ক রোগে প্রাণ হারালেন নগেন্দ্র।


যাঁকে চোখে হারাতেন সেই স্বামীকে বিনা জলে তেষ্টায় পুড়ে, রোগের বিকারে মরতে দেখলেন বরদা। 

কন্যা তিনটির গৌরিদান আগেই করে গিয়েছেন নগেন্দ্র। বরদার কোলে এখন সাত বছরের পুত্র। জমি আবাদ কিন্তু ঘরের চাল বাড়ন্ত। ঊনত্রিশ বৎসরের বরদাসুন্দরী শিশু সন্তানকে বুকে বেঁধে বাড়ি থেকে বের হলেন। ঘরে ঘরে গিয়ে জনমজুরদের জোগাড় করলেন। নিয়মিত জমির কাজ দেখতে লাগলেন। 

ধান রোয়ার ব্যবস্থা হল। কিন্তু পানের বরোজ অতটা অবাধ নয়। এই পান পাতার আড়ালেই মুখ লুকিয়ে  থাকতেন সমস্ত বারুইজীবির লক্ষী।বাঁশ, গাছের ডাল দিয়ে বরোজ তৈরি হতো মজুরদের সাহায্যে । কিন্তু চাষের মাটি তৈরি, পান পাতার লতার ডগের অংশে উলু ঘাস সূক্ষ্মভাবে বেধে নেওয়া (গাছের ‘ন’ ধরানো) , পান তোলার কৌশল এই সকল লালনশৈলী বৃত্তিগত।  প্রতিবার পানের বরোজ পূজা করা হয়। অথচ পানের বরজে নারীর  প্রবেশ নিসিদ্ধ।  শিশু বয়সের  আবছা বরোজ স্মৃতি সম্বল করে  বরদা পানবরজের নরম ছায়াঘেরা ঘোমটায় প্রবেশ করলেন।জীবিকার তপস্যায় চিরাচরিত নিয়ম ভাঙতে হল।  আশ্রমকন্যাদের কাছে এমন স্নেহস্পর্শ তো আগেও পেয়েছে তপোবনের লতাবিতান। 
সেমিজ-সায়াহীন বরদাসুন্দরী একটি পাড়হীন ধুতি ও একটি থান কাপড় কে বিচিত্র ভাবে জড়িয়ে, ঘোমটা অক্ষুন্ন রেখে নিজের হাতে পানের বরজের হিসাব বুঝে, ঝাঁকা ভর্তি পান মজুরদের মাথায় তুলে দিয়ে একটু জিরোন। 
নগেন্দ্র নেই অথচ চাষবাস চলছে, তাঁর শিশুসন্তান নিশ্চিন্ত মনে খেলা করছে, এমন শোক বিয়োগের পরেও তিনি বেঁচে রয়েছেন! অনেকটা একলাপথ পাড়ি দিয়ে কখনো পরিস্থিতির সমপ্রবাহে কখনো বা তাকে বিস্মিত করে বরদাসুন্দরী যখন জীবনসায়ান্হে   এসে পড়লেন তখন স্বাধীনতাকামী বাংলায় পঞ্চশের মন্বন্তর। সর্বত্র কঙ্কালসার মানুষের আর্তি। অন্যবারের তুলনায় কম হলেও বরদার  ধানের গোলা খালি ছিলনা। তবুও শহরের আড়ৎদারের কাছে চাল পাঠানো হলনা। কারন ভোলা ঘরামি শহর থেকে ফিরে জানাল আড়ৎদারেরা গুদাম আটকে রেখেছে কালোবাজারে বিক্রি করছে  আর রাস্তাঘাটে বুভুক্ষু  মানুষের দল কাতরে মরছে। নিজের  পরিবারের প্রয়োজনের অতিরিক্ত ধান জমিয়ে রেখে দুর্গত মানুষকে তা দিয়ে বরদা সাহায্য করতে লাগলেন।কিছুদিন পরেই গোটা গ্রামে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ দেখা দিল। বরদাসুন্দরী তাঁর একমাত্র পুত্রকে হারালেন। এতটুকু ভেঙে পড়েননি বরদা বরং তিনি পৌত্রের সংসারের সহ কান্ডারী হলেন।শোকের ঢেউ পাছে বিচল করে তাই কাজ আরো বাড়ালেন।  হাতে কর কাম মুখে কর নাম-, পাটের সুতো কাটেন ঝি-মা আর সারাদিন নামগান করেন। বরদাসুন্দরীকে এখন সংসারে সবাই ঝি-মা বলেই ডাকে। তাঁর নাতবউয়ের কাছে তিনি বিপ্লবীদের কথা শুনেছেন। হিরণ্ময়হৃদয় ছেলে তারা। রক্ত দিয়ে দুর্দিন ঘোচাবে।কত মায়ের কোল খালি হয়ে তবে দেশমাতা স্বাধীন হবে। তাঁর কেবলই মনে হয় তাঁর খোকার কথা। অভিশপ্ত  দীর্ঘায়ু !তাঁর চোখের আলো নিভে এসেছে তবু স্বাধীন সূর্যদয় তিনি দেখতে পাবেন তাঁর খোকা নয় ! দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে তাঁর হঠাৎ মনে পড়ে যায় প্রাচীন কালের একটা প্রবাদ - "অল্প শোকে কাতর অধিক শোকে পাতর (পাথর)"। তিনি কাতর হন না, সন্ধ্যে হয়েছে গোয়ালে বড় মশা একটু ধুনো দিতে হবে...

1 comment:

একনজরে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"ইস্কুল বলিতে আমরা যাহা বুঝি সে একটা শিক্ষা দিবার কল। মাস্টার এই কারখানার একটা অংশ। সাড়ে দশটার সময় ঘণ্টা বাজাইয়া কারখানা খোলে। ...