Friday, September 14, 2018

ছয় মহলা বাড়ির উঠোনে -- তোর্সা চক্রবর্তী







গ্রন্থ- ছয় মহলা বাড়ি , বেবী সাউ
প্রকাশক- ভাষালিপি
প্রচ্ছদ- সঞ্জীব চৌধুরী
১২০টাকা



সহজ মেঘে বিষাদ গান এঁকে                                জমিয়ে রাখো স্বরলিপির খাতা 
                                   কাজল জলে যাচ্ছে নদী বেঁকে


হঠাৎ সেই নিপুণ আলোড়ন                                     হাঁটার পথে ধুলো ঝড়ের মেঘ 
                                      আঁচল ভেবে চাইছে সমর্পণ 


মন্দিরে সে কাঁসর বেজে ওঠে                                          উথাল মনে রৌদ্রশিস ঢেউ 
                                       হাঁটছে একা দীঘল পথ ঘাটে


আমিও আজ অজ্ঞানতা বশে                                           ঘরের মাঝে রাখি জন্ম মাটি
                                     খেলার ঝোঁকে তোমার কাছে এসে 


কথার ফাঁকে সাজাই শুক-সারি                                         ইঁটের ফাঁকে গড়ছি ইতিকথা
                                               উঠল গড়ে ছয় মহলা বাড়ি

তরুণ' কবি বেবী সাউয়ের কবিতাযাপনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, বারবার নিজেকে ভাঙা। এই তরুণ বয়সেই তিনি যে কোনও পথেই নিজের কমফোর্ট জোন তৈরি করার জন্য আগ্রহী নন, বরং, প্রতিটি পেরিয়ে আসা অভিযাত্রাই তাঁকে নতুন নতুন রাস্তার দিকে নিয়ে যায়, তা বাংলা কবিতার কাছে এক চরম আশাবাদের মতো। যেখানে উৎসবের আতিশয্যে অনেক কবিই ভুলে যান, নিজেকে ও নিজের ভাষাকে বারবার আক্রমণ না করলে একটি নির্দিষ্ট ভাষা ও ভাবনায় আবদ্ধ হয়ে পড়ার সম্ভাবনা আছে, যা ক্রমশ তাঁদের এক অভ্যস্ত কবিতাযাপনের কাছেই নিয়ে যায়, পাঠকদেরও আশ্বস্ত করে এক চেনা পরিসরের মধ্যেই ঘুরপাক খাওয়ার জন্য, সেখানে এই কাব্যদর্শন এক আশার মতোই।

ফিরে আসছে পুনরাবৃত্তিরা। পায়ে পায়ে বিদায় উচ্চারণ করছে হেঁটে যাওয়া রোদ্দুর। আর একঝাঁক ধূসর ঘুঘু, স্মৃতিভূমি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। মুহূর্তেরা কিলবিল আনন্দে পান করছে বিষাদের রস। রাগে কাঁপতে কাঁপতে গুমরে উঠছে সাঁঝবেলার শাঁখ। কীভাবে মনে পড়ে যাচ্ছে তোমার গোলাপসুন্দরীর কথা! যাকে তুমি উপহার দিতে সক্ষম ছিলে সাঁঝতারা। আমার হাসিতে তখন এক নীরব আস্তরণ, ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে তৈরি হচ্ছে আশ্চর্য বুনট আর ক্ষত সৃষ্টিকারী এক অব্যর্থ দাওয়াই ।
তখনই , চাঁদে ঝলসে উঠলো গাছ , শুকনো মাঠে বসল প্রেমের আসর । আর ত্রিশটা গৃহযুদ্ধ একপাতে বসলো আনন্দভোজনে ...


আরও একটি ভাবনার কথা বলা যায়, আর তা হল, একধরনের সিগনেচার ভাষা, যা এক বিশিষ্ট কবিকে 'বিশিষ্ট' করে। আমরা বুঝতে পারি, তাঁর কাব্যব্যক্তিত্বকে। বেবীর কবিতার অভিযাত্রার বৈশিষ্ট্য হল, এই কবির ব্যক্তিত্ব বা পারসোনার সিগনেচার তিনি ভাষায় রাখছেন, কিন্তু কাঠামোয় রাখছেন না। গান লেখে লালনদুহিতায় যেমন তিনি সনেটের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করেছেন তাঁর অন্তর্জগতের যাপনকে, তেমন ছয় মহলা বাড়ি শীর্ষক কাব্যগ্রন্থে তিনি এক বিশেষ দর্শন ও ক্রিয়ার রূপকে প্রকাশ করেছেন তাঁর জীবন ও মনোজগতের আধ্যাত্মিক জার্নিকেই।
সমগ্র বইটি মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, আজ্ঞা, মণিপুরম, অনাহত, বিশুদ্ধ, উপসংহার- এই ছটি পর্বে বিভক্ত। প্রতি পর্বে ছটি করে কবিতা আছে। সমগ্র কবিতার বইটি যেন এক অভিযাত্রার বর্ণনা।
যেমন

সাঁকোতে লেগে থাকা হাঁটাপথ-- হড়ের জল স্রোত ভাঙছে। কতদিনের এই অ-ধোয়া দেহ, অগুরু চন্দন; আচমনের নামে পেতে রাখে জলধারা। কোষে কোষে সমুদ্র গুঞ্জরিত হয় মৃদুস্বরে। জন্মদিন এসে নামে ধীরে। খেসারি-খিচুড়িতে পাত পেতে বসে মধ্যদুপুর। গাল-গল্প শেষে সেও মৎস্যকথা শোনে। কোলাহল শেষে ঘুমায়।  নিশ্চিন্তে।

ছয় মহলা বাড়ি কাব্যগ্রন্থটির বৈশিষ্ট্য এখানেই, যে তা, বহিরঙ্গে এক আধ্যাত্মিক ক্রিয়া হলেও, অন্তরঙ্গে, নানান ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাকৃতিক অনুষঙ্গে রচিত হওয়া এক কবির মানসিক আধ্যাত্মিক সংযোগ সাধন। 'যোগ' ও 'সংযোগ'- এই দুই ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার মধ্যে প্রকৃতির লীলার ক্ষেত্রগুলি কাজ করে চলে। ছয় মহলা বাড়ি সেই লীলাগুলিকেই বারবার তুলে ধরেছে আপাত গদ্য কিন্তু ছন্দময় গদ্যে লেখা, মিথ, প্রতীক, আবহমান দৃশ্যকল্প ও বোধির স্পর্শে নতুন করে দেখা দৃশ্যকল্পের সঙ্গীতের মাধ্যমে। বাউল, বৌদ্ধ ও তান্ত্রিক দর্শনের পারস্পরিকতার সঙ্গে মিলে মিশে গেছে সহজিয়া ও মরমীয়া বাকভঙ্গি। আধ্যাত্মিক ক্রিয়া ও আধ্যাত্মিক ভিশন মিলে মিশে গেছে তাঁর আপাত স্থির কিন্তু অন্তরে চঞ্চল কবিতাগুলির মধ্যে। প্রতিটি কবিতা যেন সামুদ্রিক ঢেউ, যা অপর একটি ঢেউয়ের জন্ম দিয়ে প্রবহমান রেখেছে স্রোতটিকে।

এই চর্চার বিভিন্ন মহল তথা বিভিন্ন স্তরের মাধ্যমে কবি নিজে তাঁর কাব্যিক অভিযাত্রাটিকে হাজির করছেন এমন এক বিমূর্ত চর্চার দোরগোড়ায়, সেখানে সম্ভবত আর কোনও মহল নেই, চরম শূন্যতা ছাড়া। রূপ থেকে অরূপে যাচ্ছেন তিনি, আমাদের অখণ্ড চৈতন্যের অনন্তকালীন অস্তিত্বের মতো।

যেমন-
যেভাবে বেঁধেছ ঘর এককোণে জীবিত ও মৃত
হেঁটে আসে প্রেম রূপী পিপাসার সর্পিল গমন
বিষের যাতনা নিয়ে পাখি ভাবে জন্মমৃতশোক
মায়াবলে মেয়ে সেই, দুবেলার নিঃশ্বাস প্রশ্বাসে
নদীর মতন জাগে আজন্মের পোষা ফ্যানাভাতে
আজ সেই দেবী, ভবে, শ্মশান মণ্ডিত কালো রূপে

বাংলা কবিতায় এই চর্চাগুলি করেছেন খুব কম কবি। কিন্তু এই চর্চাগুলিই বড় কথা নয়, বড় কথা হল, কবির প্রত্যেকটি চর্চার ভিতরে যে নিজেকে সন্নিবিষ্ট করে দেখার প্রক্রিয়া, সেটি। যেন, তিনি নিজেকে ঘুমন্ত দেখছেন নিজের ঘুমন্ত শরীরের সামনেই দাঁড়িয়ে। সংযুক্তি ও বিযুক্তির এ হেন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তাঁর কবিতায় ফুটে উঠছে কিছুটা নির্মোহ অথচ আসক্ত ভাবেই। ভোগ ও ত্যাগের যুগপৎ এক ভাষ্যে সূচিত হচ্ছে মিথের মধ্যে, প্রতীকের মধ্যে অবগাহনরত সমসময়কে দেখার প্রক্রিয়া-

একটাই চ্যানেল
ঘুরে ফিরে ছায়া বাদবাকি
এ শুকিয়ে যাওয়া পথ
পিঙ্গলবর্ণের শোক
ধীরে ধীরে কাছে আসে। বসে।
পাতা উল্টায়
ধীরচোখ হিসেব কষে
দ্যাখে
এপর্যন্ত, গূঢ় ঊর্ণনাভচক্রে পথ হারিয়েছে কারা কারা!

মূলাধার, বিশুদ্ধ, স্বাধিষ্ঠান, আজ্ঞা, মণিপুরম, অনাহত, এবং উপসংহার -- এই ছটি মহলের মধ্যে দিয়ে তাঁর এই বাড়িটি তৈরি হচ্ছে আর আমাদের নিয়ে যাচ্ছে বাউল ও বৌদ্ধ দর্শনের মূল কথায়। কিন্তু কী বলছেন তিনি সেই বিমূর্তের কাছে পৌঁছিয়ে?
হয়ত আবার নতুন করে শুরু করছেন তাঁর জার্নি। মাধুকরী শীর্ষক কবিতায় তাই তিনি বলছেন-
নদীজল ভুলে গেছে ঘরে ফেরা। ঈশানে পেতে রাখা ভাত। মাছি ওড়ে। যুগ যুগ থেকে শুরু ভ্রমণের ঝুলি। জলবিবাহ। তীব্র রোদ ভেঙে, মনোরম পাখি ছেড়ে হেঁটে যায় মোহানার দিকে।আলো নেই। অন্ধকার শেষ। এই ক্ষণে, সেও নিজেকে ঈশ্বর সাজিয়ে তোলে। ধূপ-ধুনো জ্বালে।
তন্ত্র বা অন্যান্য দর্শন বড় কথা নয়, আসলে একটি মানুষের জন্ম থেকে শূন্য পর্যন্ত, শূন্য থেকে অনন্ত পর্যন্ত চিরকালীন হেঁটে যাওয়ার অভিযাত্রাটিকেই কবি রচনা করেছেন এই কাব্যগ্রন্থটিতে।
কবিতা পড়ার যে তথাকথিত অভিজ্ঞতা, তা থেকে বেশ কিছুটা পৃথক তাঁর এই কবিতার বইটি। তাঁর এই বইটি পড়তে পড়তে আমরা চলে যাই গীতা চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার কাছে, যেখানে খুঁচিয়ে ঘা করে পাঠকের মনের মধ্যে থেকে যাওয়ার প্রবণতা নেই, বরং পাঠকের সঙ্গে দীর্ঘকালীন সহবাস করে, নানা সময়ে আবিষ্কৃত হওয়ার আকাঙ্খা আছে।

বইটি সবে প্রকাশিত। শ্রী সঞ্জীব চৌধুরীর অনবদ্য প্রচ্ছদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভাষালিপির নিপুণ প্রডাকশন।

No comments:

Post a Comment

একনজরে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"ইস্কুল বলিতে আমরা যাহা বুঝি সে একটা শিক্ষা দিবার কল। মাস্টার এই কারখানার একটা অংশ। সাড়ে দশটার সময় ঘণ্টা বাজাইয়া কারখানা খোলে। ...