Friday, September 14, 2018

মেয়ে মনস্তত্ত্ব ঘিরে-- শিপ্রা বিশ্বাস









আমাদের সমাজের মেয়েদের মনোভাবটা ঠিক স্কুলের শেষের শ্রেণীর ছাত্রীদের মত। ওরা বোঝে যে ভালো করে পড়াশোনা করলে আমিও ভাল ছাত্রী হতে পারি। তার যে আনন্দ তাও তারা গ্রহণ করতে চায়। কিন্তু ভালো ফলের জন্য তো অনেক পড়তে হয়, কষ্ট, পরিশ্রম করতে হয়। তাই তারা কোন রকমে পাশ করে উঠেছে এই নিয়েই সুখি থাকার চেষ্টা করে।
সমাজে মেয়েরাও ঠিক তাই। স্বাবলম্বী হতে গেলে তো অনেকটা পরিশ্রম আবার দায়িত্ব বেড়ে যায়। সমাজে গড়ে দেওয়া নিয়ম গুলো তো হালকা একটু চেষ্টা করে অভ্যাস করে নিলেই হয়। অন্যের পয়সায় খবরদারি করার সুখই আলাদা। সে কি আর ওই স্বাধীনচেতা স্বাবলম্বী মেয়েগুলো বোঝে? না হয় সে মাঝেমধ্যে স্বামীর দু'ঘা খেলাম তাতে এমনই বা কি অসুবিধা। সব সময় তো আর নয়। অত প্রেস্টিজ জ্ঞান থাকলে কি আর চলে নাকি! স্বামী তো, শেষমেষ তো সেই মাসের খরচাটা আমারই হাতে দেবে। বাবার ঘাড়ে বসে খাওয়া, স্বামীর ঘাড়ে চেপে খাওয়ার সুখই আলাদা।
তারপর ওই মাঝারি গোছের ছাত্রীগুলো আস্তে আস্তে যখন একটু একটু করে উপরের শ্রেণীগুলোতে ওঠে তখন দেখা যায় দুই-একটা বিষয়ে ব্যাক আসতে শুরু করে। যদিও তাতেও টেনে হেঁচড়ে আরো কয় ক্লাস ওঠে। কিন্তু শেষমেশ বোর্ডের পরীক্ষায় গিয়ে আটকে যায়। মেয়েরাও তাই। সব কিছু মেনে নিয়ে নিজের ইচ্ছে, ভালো লাগা, মন্দ লাগা গুলোর বহিঃপ্রকাশ চেপে রেখে মেয়েদের সব কিছু, হাঁটাচলা, কথাবার্তা, মনোভাব সবকিছু অভ্যাসগত পরিবর্ত ক্রিয়ায় চলতে থাকে। তারপর যেদিন নিজের পাশের বন্ধুরা সরে যায় সেদিন আর নিজের ফেলে আসা অতীতটার দিকে ফিরে তাকাতে পারে না তারা। ভয়ে আড়ষ্ট তখন। তবু তো বেঁচে থাকতে হবে তাদের। নিজের ফেলে আসা সাদা কাগজের মতো সুন্দর সময়গুলোকে যে সে নিজে হাতে দুমড়ে-মুচড়ে ছিঁড়ে ফেলেছিল একদিন সেই দিনগুলো আজ বড় কঠিন বাস্তব মনে হয়।
মেয়েরা তাদের গতিশীল মনোভাব গুলোকে ডিপ ফ্রিজে আটকে রেখে দিয়েছে। বাইরের পরিবেশে যত উত্তাপই থাকুক না কেন ওই ডিপফ্রিজ অবধি আর পৌঁছাতে পারে না। বছরের পর বছর যে সংস্কারগুলো মজ্জায় মজ্জায় মিশে গেছে তা কি অত সহজে ঝেড়ে ফেলা সম্ভব? আর ঝেড়ে ফেলতে চাইলেই বা তুমি পারছো কি ভাবে? তোমার পথ আটকাবার মানুষের তো আর অভাব নেই।
আমি একদিন এই হিন্দু মেয়েদের শাঁখা সিঁদুর পরা নিয়ে আপত্তি জানালাম। আমার মনে হয় যে, এই সিঁদুর জিনিসটা One kind of symbol of dependence on someone.
মেয়েদের মাথায় সিঁদুর থাকলেই বোঝা গেল যে, যাক তার একটা গতি হয়েছে। বাবার ঘাড় থেকে নেমে আর একজনের ঘাড়ে চেপেছে। যদিও সমাজে এমনটাই অবস্থা মেয়েদের। কিন্তু যারা সাবলম্বী শুধুমাত্র তাদের জন্যই আমি বলি সিঁদুর পরার দরকার নেই। কিন্তু আমার এই শাঁখা সিঁদুরের আপত্তিতে আমার পাশে আমার মা, দিদি কেউই দাঁড়াইনি। আমার যুক্তির সাথে শুধু খানিকটা একমত হয়েছিল আমার বাবা। মা বলতে শুরু করে দিলো হিন্দু মতে এসব নিয়ম এমনি এমনি আসেনি। এর পেছনে অনেক কারণ আছে। তারপর শাঁখা পরা শরীরের পক্ষে খুব ভালো। সে কথা আমিও শুনেছি তাহলে শাঁখাটা বিয়ের পর থেকেই পরতে শুরু করতে হবে কেন? ভালো যখন তাহলে আগে থেকেই শাঁখা-সিঁদুর পরতে শুরু করে দিই।
মেয়েরা রাতের অন্ধকারে নিজেদের যে মাত্রাতিরিক্ত মূল্য পায় সেই চড়া দামে নিজেদেরকে দেখে তারা সব ভুলে সবটাই হারায়। যখন সকালের আলোয় তাদের অত্যধিক মূল্যটা বিনামূল্যের জিনিসেরও নিচের সারিতে স্থান পায় তখন বুঝতে পারে যে জগতে পুরুষের কাছে মেয়েদের জায়গাটা শুধু বিছানায়, হৃদয়ে নয়।
আমার ভারি অবাক লাগে এই বিয়ের নিয়ম গুলো। বিয়ে হয় একটা মেয়ে এবং একটা ছেলের। এক নতুন সংসার সৃষ্টি। কিন্তু বিয়ের শুরু থেকে শেষ অবধি সব নিয়ম গুলো তৈরি করার সময় কি ওই আলোচনা সভায় একটি মেয়ের কাছে অনুমতি কেউ নিয়েছিল? ওই তৈরি নিয়মগুলোতে মেয়েদের আদৌ বিশ্বাস, ভরসা আছে কিনা কেউ জিজ্ঞেস করেছিল? কিন্তু সবাই বলবে হয়তো, তাহলে মেয়েরা এসব মেনে নিয়েছিল কেন? কিন্তু এখানে মানা না মানার প্রশ্নটাই তো উঠছে না। সমাজ তৈরি করেছে মানতে হবে। আর কালে কালে এসব মাথা পেতে নিয়ে মেয়েদের চলাটা হয়েছে পদার্থের জাড্য ধর্মের অনুরূপ। বিয়ের সময় মেয়েদের উপোস করাটা মাস্ট কিন্তু ছেলেদের বেলায় বাধ্যবাধকতা নেই। তারপর গোত্রান্তর, পদবী রূপান্তর তারপর তাকে ঘরকন্নার মধ্যে সূক্ষ্ম ভাবে ঢুকিয়ে দেওয়া। সব মিলিয়ে মেয়েদের একটা মজার উপভোগের বস্তুর রূপ দেয়া হয়েছে। অতঃপর একটা মেয়েকে, দুটো মেয়েকে এভাবে এই নিয়ম সমুদ্রে ডুবিয়ে দেওয়ার পর তারাই পরবর্তীতে প্রেতাত্মার মতো পৃথিবীর সব মেয়েকে এই নিয়মের মধ্যে আনার আপ্রাণ চেষ্টা করে যায়। আর যদি কেউ এর বিরোধিতা করে তো অনেক দূরের কথা, শুধু নিজের মতটা, নিজের বিশ্বাসের কথাটার প্রকাশ করে তবেই তাকে এই সমাজ সংসার থেকে বিতাড়িত করা হয়, নয় ভগবানের ভয় দেখানো হয়। এই ভগবান লোকটিকে আসলে একপ্রকার জুজু হিসাবে ব্যবহার করে চলেছে এই সমাজ।
সমাজ সংস্কারের মেয়েদের হতে হবে তরল পদার্থের মত। যখন যে পাত্রে রাখা হবে তখন সেই পাত্রের মতো আকার ধারণ করতে হবে, অর্থাৎ জন্মের পর থেকে এক পরিবারে থেকে সেখানকার শিক্ষা সংস্কারের ছোঁয়ায় তুমি নিজেকে গড়ে তুলবে। তারপর হঠাৎই সবাই তোমাকে এসে বলবে এসব শিক্ষা সংস্কার একদম ভুলে যাও। এবার তোমাকে এক নতুন পরিবারে যেতে হবে। সেই পরিবারের সব শিক্ষা সংস্কার তোমাকে রপ্ত করতে হবে। তুমি কি বলো 'কেন'? কেন আমি এসব করব? আমার দাদা অথবা ভাই তো এসব করে না। তখন একটাই কথা শুনতে পাবে," এটাই সমাজের নিয়ম মেয়েদের"। আর আমিও ভাবি মেয়েরা সেই পুরাতন কাল থেকেই কত Smart, well prepare এসব মেনে নেওয়ার জন্য।
কোন একটা কুৎসিত জিনিসকে যদি হাজারটা লোক সুন্দর বলতে থাকে তখন যদিও বা কারো মনে হয় জিনিসটি তো কুৎসিত তাও সে মুখ খুলে কিছুই বলবে না। সবার তালে তাল মিলিয়ে যাবে। আমাদের সমাজে মেয়েরাও ঠিক এভাবেই এইসব কুৎসিত নিয়মগুলোকে ভারী সুন্দর নিয়ম ভেবেই মেনে নিয়ে এগিয়ে চলেছে।
আমার মাথায় ঠিক ঢোকে না যে মেয়েরা কেন সব সময় আশা করে যে স্বামীরাই শুধু তাদের গিফট করবে, সব সমস্যা থেকে তাদের রক্ষা করবে। স্বামীর পাশে দাঁড়িয়ে নিজের গর্ব করতে থাকবে? মেয়েরা কি পঙ্গু নাকি অথর্ব যে তারা কিছু করবে না? নিজেকে এমন ভাবে তৈরি করতে সমস্যা কোথায় যে, তাদের স্বামীরা তাদেরকে নিয়ে গর্ব করবে? স্বামীর কোনো সমস্যায় তারা তাদের রক্ষা করবে, স্বামীর বাহুবল হয়ে মেয়েরাও কারো 'ভরসা' হবে, এবং সেই বল, ভরসা গ্রহণ করতে যখন আমাদের মা-বাবা, স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি আপামর সমাজ কুণ্ঠিত ,লজ্জিত হবে না সেদিনই বুঝতে হবে মেয়েরা স্বাধীন। সমাজে ছেলে আর মেয়ের মধ্যে আর কোন ব্যবধান নেই। এতকালের 'সমান অধিকার', 'সমান অধিকার' বলে গলা ফাটানো সংগ্রাম তবে শেষ হয়েছে।

No comments:

Post a Comment

একনজরে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"ইস্কুল বলিতে আমরা যাহা বুঝি সে একটা শিক্ষা দিবার কল। মাস্টার এই কারখানার একটা অংশ। সাড়ে দশটার সময় ঘণ্টা বাজাইয়া কারখানা খোলে। ...