Friday, September 14, 2018

দিবসীয় --শ্রীজাতা গুপ্ত






পাপা আন্টির কথা কাউকেই বলা হয়নি৷ তার কারণ আমার ক্রমশ আবছা হয়ে আসা স্মৃতি আর কৃতজ্ঞতায় উপচে ওঠা শ্বাসরুদ্ধ আবেগ৷ পাপা আন্টি আমার প্রথম শিক্ষিকা৷ খেলনা-ইস্কুল গড়ে তোলার সঙ্গী৷অনেকখানি ছেলেবেলা সাজিয়ে দেওয়ার দালানবাড়ির এক চিলতে রোদ্দুর৷

আমি তখন দুই কি তিন৷ কয়েকদিনের কলকাতা সফরে দেখেছি, আমার দাদাভাই, আমার থেকে মাত্র একমাস দশদিনের বড় দাদাভাই, রোজ সকালে স্কুলে যায়৷ কাঁধে ছোট্ট ব্যাগ, গলায় মিল্টনের ভারী ওয়াটারবটল, আর পরনে কী সুন্দর ইউনিফর্ম৷ বাবার পোস্টিং তখন ধুবুলিয়া টিবি হস্পিটাল৷ নদিয়ার প্রত্যন্ত সেই গ্রামের আসেপাশে কোনও স্কুল নেই তখন, কিন্ডারগারটেন তো দুরস্ত৷ তবু আমি বায়না জুড়ি নিয়ম করে ইস্কুল যাওয়ার৷ আমার চোখে তখনও শহরগ্রাম সীমানা ফোটেনি৷ মা রোজ পড়তে বসান, কলকাতা থেকে কিনে আনা ক্যাসেট এ প্রিতি সাগর আর অন্তরা চৌধুরীর গান বাজে সুপারিন্টেন্ডেন্ট কোয়ার্টার্সে৷ তবু, আমি ইস্কুল চাই, আন্টিদের কাছে পড়তে চাই৷ অগত্যা, মা আমার জন্য বেগনি-সাদা ইউনিফর্ম বানিয়ে দেন, শর্টস, শার্ট, সঙ্গে ম্যাচিং টাই৷ টিনের একটা স্যুটকেস কিনে আনেন কৃষ্ণনগর থেকে৷ টিফিন বক্স, জলের বোতল, পেন্সিল বই খাতা গুছিয়ে আমি রোজ ইস্কুল যাওয়া শুরু করি পাপা আন্টির বাড়ি৷ আমাদের কোয়ার্টার্স থেকে দু'মিনিটের পথ, কখনও বাবা গাড়ি করে পৌঁছিয়ে দিয়ে যান, রাউন্ডে যাওয়ার পথে৷ সব মফস্বলে পাপা আন্টিরা যেমন থাকেন- রোজ সকালে স্নান করে মাড় দেওয়া ছাপা শাড়ি পরে লম্বা বিনুনি আর কপালে টিপ এঁকে নানা কাজে ব্যস্ত রাখেন নিজেদের; সেলাই করেন বাহারি আসন, শীতকালে হালফ্যাশানের পঞ্চো বোনেন বছর-বছর, উঠোনের খাঁচায় পোষা ময়নাকে দানা দেওয়ার সময় চুপিসাড়ে বলে দেন পছন্দের পুরুষের কথা, দুপুরে অবিন্যস্ত আঁচলে উপন্যাসের ভাঁজে চোখ লেগে আসে, পথচলতি সাইকেলের  বেল হঠাৎ জানান দিয়ে যায়, বিকেলের চা বসাতে হবে, সন্ধে দিতে হবে ঘরে, সেইসমস্ত কাজ সামলে, আরও একটু সময় কাটানোর অজুহাতে, এবং আমার অদ্ভূত আবদার রাখতে পাপা আন্টির ঘরেই শুরু হল আমার প্রথম ইস্কুল৷

সকালে এক দফা পড়াশোনার পরে ঢংঢং ঘন্টা বেজে উঠত৷ পাপা আন্টির মা ডিউটিতে যাওয়ার আগে পুজোর ঘরে তাঁর পেতলের ঘন্টি বাজিয়ে টিফিন ব্রেক দিতেন৷ মা কী খাবার পাঠাতেন মনে নেই, তবে দিদা কোলে বসিয়ে গরম রুটি আর হলুদ-হলুদ আলুভাজা খাইয়ে দিতেন, স্পষ্ট মনে আছে৷ আমাদের বাড়িতে কেবল সাদা আলুভাজা, দিদার রান্নাঘরের আলুভাজা তাই আমার কাছে অমৃতের চেয়ে কম নয়৷ পাপা আন্টি যখন মন দিয়ে বুঝিয়ে দিতেন ১+, আমার তখন ভিকো টার্মারিকের আশ্চর্য্য গন্ধ আবিষ্কার৷ অনেক পরে বুঝেছি কোনটা ভিকো কোনটা নিভিয়া৷ তার আগে পর্যন্ত একটি ছিল পাপা আন্টির আর অপরটি মায়ের পরিচয়৷

এই খেলনা-ইস্কুলের কথা  শুনে অনেকেই হেসেছেন পরে, তাচ্ছিল্যে৷ পাপা আন্টি কিন্তু হাসেননি কোনওদিন৷ আমার প্রথম ইস্কুলের একমাত্র উৎসাহী শিক্ষার্থীর অশেষ কৃতজ্ঞতা টিনের স্যুটকেসে তাই আজও বাড়বাড়ন্ত সতেজ চারাগাছ৷

বাবা এরপর বদলি হয়ে আসেন বারাসাত৷আমি তখন চার পাঁচ বা ছয়৷ ভাড়া বাড়ির বিশাল বারান্দা জুড়ে অস্থায়ী চেম্বার৷ বাবা টেবিলে বসবার আগেই আমি পৌঁছিয়ে যেতাম পেশেন্টদের সঙ্গে গল্প করতে৷ তাঁদের মধ্যে একজনকে বাবা সবসময়  'মাস্টারমশাই' সম্বোধন করতেন৷ আমরাও তাই৷ মাস্টারমশাই এলেই আমাকে নানা প্রশ্ন করতেন৷  স্কুলের কথা, পড়াশোনার কথা, ইংরিজি গ্রামারের কথা৷ মাস্টারমশাই প্রথম আমাকে রেন আ্যন্ড মার্টিন কিনে দিলেন একদিন, সঙ্গে আপেল, মোসাম্বি লেবু৷ বাবার রুগি দেখার ফাঁকে ফাঁকে আমাকে পড়াতে শুরু করলেন প্রপার নাউন, ইন্টারজেকশন, এক্সক্ল্যামেশন৷ বিস্ময় বহিঃপ্রকাশের সহজপাঠ৷ অতঃপর, মাস্টারমশাইয়ের আসার সময় বদলে গেল৷ ভোর ছ'টার মধ্যে আমাদের বাড়ি পৌঁছিয়ে যেতেন৷ বাবা হিসাব করে বুঝেছিলেন, সেই দূরের মফস্বল থেকে আমাদের টাউনে আসার জন্য অন্তত ভোর চারটের সময় বাড়ি থেকে বেরোতে হয় ওঁকে, নইলে অসম্ভব৷
এত সকালে আসবার প্রয়োজনই বা কি?
'মাদারের' পড়া মনে থাকবে বেশি, সকাল সকাল গ্রামার পড়া ভালো! 'মাদার' বলে ডাকতেন আমায়৷ কোনওদিন নাম ধরে ডাকেননি৷
রোজ ফল আনেন কেন? এত খরচ!

নিজের জন্য কিনি, তাই, মাদারের জন্যও৷ ভিটামিন খেলে পড়া মনে থাকবে বেশি৷
আমাকে পড়ানো শেষ করে, বাবার কাছে পরামর্শ নিয়ে ফিরে যেতেন বনগাঁ-এ নিজের ইস্কুলে৷ মাস্টারমশাই প্রাইমারি ইস্কুলে পড়াতেন৷বছর ঘোরে, বাবার চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে ওঠেন মাস্টারমশাই৷ আমাদের বাড়ি বদল হয়৷ তবু ঠিকানা খুঁজে নিয়মিত আসতেন, নতুন বই নিয়ে, কেবলই পড়ানোর, শেখানোর নেশায়৷ একদিন কাউকে কিছু না বলে, এক মফস্বল থেকে আরেক মফস্বলের ভিড়ে হঠাৎ হারিয়ে যান মাস্টারমশাই-পেশেন্ট৷ আমি তখন বড় হয়েছি অনেক৷

পাপা আন্টি বা মাস্টারমশাই আমাকে যত শিখিয়েছেন, তার মূল্যায়ন করতে  শেখাননি কখনও৷ ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের সঠিক পদ্ধতির পাঠটিও ছিল সিলেবাস বহির্ভূত৷ তবু, যার কাছে ঋণের বোঝা ক্রমবর্ধমান, তা আমার মফস্বলের অনামী বাসভূমি৷ ঘুমভাঙা দুপুরের ছাদের আ্যন্টেনায় অপূর্ব ফিঙেপাখি হৃদয়৷ কাছারি ময়দানের পাশ কাটিয়ে, ডিএম বাংলো পেড়িয়ে আদি পাল ব্রাদার্স থেকে কিনে আনা 'পাগলি, তোমার সঙ্গে', মাছরাঙা তীক্ষ্ণ সাঁঝবেলা৷ বড়বাজার, কালী মন্দির, হরিতলা মেডিকাল হ'ল, রিক্সাস্ট্যান্ডের কৃষ্ণচূড়া গাছ থেকে খসে পড়া ময়ূরপালক পাপড়ি৷  বইয়ের ফাঁকে সযত্নে রাখতে হয়, শিখিয়েছিল টাউনশিপের বৈশাখী ট্রেনের হুইসল৷ কদবেলে তেল-লঙ্কা মাখা দুপুর ছিল গভর্নমেন্ট কলেজের গলি, নাচের তালিম শেষে কাঁঠালের কোয়া ভরা জামবাটি বাড়িয়ে দিতেন স্নেহময় তুষার দে৷ ভালোবাসিস খেতে, আমাদের গাছের! তার কাছে জীবনের তাল লয় ভয় দৃষ্টি মেক-আপ গ্রীবা-সঞ্চালনের আজন্মের ঋণ৷ খোঁপায় জুঁই মালা বাঁধার অনুশীলন৷ খুনী মফস্বল শিখিয়েছে অনেক,  অনাত্মীয়ের সুখ- চোরাটান, মানুষের মুখ৷ আমাদের মফস্বলি 'সহজ' বাঁচা-মরা৷ মফস্বল শিখিয়েছে নস্ট্যাজিক বেদনা আকুলতা৷

সব শিক্ষকের  মুখ-দেহ-নাম হয়না, জানেন! সব শিক্ষকের নির্দিষ্ট কোনও দিবস নিষ্প্রয়োজন৷

1 comment:

  1. চমৎকার স্মৃতিচারণ। আর শিক্ষক দের প্রতি সম্মান প্রদর্শ। চমৎকার।

    ReplyDelete

একনজরে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"ইস্কুল বলিতে আমরা যাহা বুঝি সে একটা শিক্ষা দিবার কল। মাস্টার এই কারখানার একটা অংশ। সাড়ে দশটার সময় ঘণ্টা বাজাইয়া কারখানা খোলে। ...