Friday, September 14, 2018

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে





"ইস্কুল বলিতে আমরা যাহা বুঝি সে একটা শিক্ষা দিবার কল। মাস্টার এই কারখানার একটা অংশ। সাড়ে দশটার সময় ঘণ্টা বাজাইয়া কারখানা খোলে। কল চলিতে আরম্ভ হয়, মাস্টারেরও মুখ চলিতে থাকে। চারটের সময় কারখানা বন্ধ হয়, মাস্টার-কলও তখন মুখ বন্ধ করেন, ছাত্ররা দুই-চার পাত কলে ছাঁটা বিদ্যা লইয়া বাড়ি ফেরে। তার পর পরীক্ষার সময় এই বিদ্যার যাচাই হইয়া তাহার উপরে মার্কা পড়িয়া যায়।
কলের একটা সুবিধা, ঠিক মাপে ঠিক ফরমাশ-দেওয়া জিনিসটা পাওয়া যায়—এক কলের সঙ্গে আর-এক কলের উৎপন্ন সামগ্রীর বড়ো-একটা তফাত থাকে না, মার্কা দিবার সুবিধা হয়।
কিন্তু এক মানুষের সঙ্গে আর-এক মানুষের অনেক তফাত। এমন-কি, একই মানুষের একদিনের সঙ্গে আর-একদিনের ইতর-বিশেষ ঘটে।
তবু মানুষের কাছ হইতে মানুষ যাহা পায় কলের কাছ হইতে তাহা পাইতে পারে না। কল সম্মুখে উপস্থিত করে কিন্তু দান করে না—তাহা তেল দিতে পারে কিন্তু আলো জ্বালাইবার সাধ্য তাহার নাই।
য়ুরোপে মানুষ সমাজের ভিতরে থাকিয়া মানুষ হইতেছে, ইস্কুল তাহার কথঞ্চিৎ সাহায্য করিতেছে। লোকে যে-বিদ্যা লাভ করে সে-বিদ্যাটা সেখানকার মানুষ হইতে বিচ্ছিন্ন নহে—সেইখানেই তাহার চর্চা হইতেছে, সেইখানেই তাহার বিকাশ হইতেছে—সমাজের মধ্যে নানা আকারে নানা ভাবে তাহার সঞ্চার হইতেছে, লেখাপড়ায় কথাবার্তায় কাজেকর্মে তাহা অহরহ প্রত্যক্ষ হইয়া উঠিতেছে। সেখানে জনসমাজ যাহা কালে কালে নানা ঘটনায় নানা লোকের দ্বারায় লাভ করিয়াছে, সঞ্চয় করিয়াছে এবং ভোগ করিতেছে তাহাই বিদ্যালয়ের ভিতর দিয়া বালকদিগকে পরিবেশনের একটা উপায় করিয়াছে মাত্র।
এইজন্য সেখানকার বিদ্যালয় সমাজের সঙ্গে মিশিয়া আছে, তাহা সমাজের মাটি হইতেই রস টানিতেছে এবং সমাজকেই ফলদান করিতেছে।
কিন্তু বিদ্যালয় যেখানে চারি দিকের সমাজের সঙ্গে এমন এক হইয়া মিশিতে পারে নাই, যাহা বাহির হইতে সমাজের উপরে চাপাইয়া দেওয়া, তাহা শুষ্ক তাহা নির্জীব। তাহার কাছ হইতে যাহা পাই তাহা কষ্টে পাই, এবং সে-বিদ্যা প্রয়োগ করিবার বেলা কোনো সুবিধা করিয়া উঠিতে পারে না। দশটা হইতে চারটে পর্যন্ত যাহা মুখস্থ করি, জীবনের সঙ্গে, চারি দিকের মানুষের সঙ্গে, ঘরের সঙ্গে তাহার মিল দেখিতে পাই না। বাড়িতে বাপমা-ভাইবন্ধুরা যাহা আলোচনা করেন বিদ্যালয়ের শিক্ষার সঙ্গে তাহার যোগ নাই,বরঞ্চ অনেক সময়ে বিরোধ আছে। এমন অবস্থায় বিদ্যালয় একটা এঞ্জিন মাত্র হইয়া থাকে—তাহা বস্তু জোগায়, প্রাণ জোগায় না।
এইজন্য বলিতেছি, য়ুরোপের বিদ্যালয়ের অবিকল বাহ্য নকল করিলেই আমরা যে সেই একই জিনিস পাইব এমন নহে। এই নকলে সেই বেঞ্চি, সেই টেবিল সেইপ্রকার কার্যপ্রণালী সমস্তই ঠিক মিলাইয়া পাওয়া যায়, কিন্তু তাহা আমাদের পক্ষে বোঝা হইয়া উঠে।
পূর্বে যখন আমরা গুরুর কাছে বিদ্যা পাইতাম শিক্ষকের কাছে নহে, মানুষের কাছে জ্ঞান চাহিতাম কলের কাছে নয়, তখন আমাদের শিক্ষার বিষয় এত বিচিত্র ও বিস্তৃত ছিল না এবং তখন আমাদের সমাজে প্রচলিত ভাব ও মতের সঙ্গে পুঁথির শিক্ষার কোনো বিরোধ ছিল না। ঠিক সেদিনকে আজ ফিরাইয়া আনিবার চেষ্টা করিলে সে-ও একটা নকল হইবে মাত্র, তাহার বাহ্য আয়োজন বোঝা হইয়া উঠিবে, কোনো কাজেই লাগিবে না।"

(শিক্ষাসমস্যা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)


সম্পাদকীয় দপ্তর- বেবী সাউ মণিশংকর বিশ্বাস সন্দীপন চক্রবর্তী
                            হিন্দোল ভট্টাচার্য শমীক ঘোষ






যোগাযোগ  ও লেখা পাঠানোর ঠিকানা - abahaman.magazine@gmail.com



লেখা পাঠাবেন অভ্রতে। মেল বডিতে পেস্ট করে অথবা ওয়ার্ড ফাইলে। কবিতা কমপক্ষে পাঁচটি পাঠাবেন। আমন্ত্রিত লেখাও অনুমোদনযোগ্য। প্রেরিত লেখা প্রকাশ পাবে কিনা, তা আমরাই মেল করে জানিয়ে দেব। অপেক্ষা করতে হবে কমপক্ষে দুই মাস। অনুবাদ পাঠালে মূল কবিতাও পাঠাতে হবে। কোনও লেখার কোনও শব্দসীমা নেই। 



অগ্রন্থিত কবিতা- জয়দেব বসু.









আমার উঠোনে নাচত, তুই কেন ভাগিয়ে আনলি? 
– আমি শুধু ছোবড়া...তুই শাঁসটুকু কেন একা খেলি? 

এসব কুতর্ক থেকে দূরে কোন উপত্যকা থাকে 
সেখানে ঘাসের কোলে কেউ তার ক্লান্ত মাথা রাখে; 
লোকটা পথিক ছিল, বিধিবদ্ধ ছিল না নিবাস 
কুঁড়ে বা প্রাসাদও নয়, এমনকি নয় কৃত্তিবাস। 
টলোমলো পদক্ষেপ – হৃদয়ে গভীর ছিল গান, 
কখনো প্রলাপ ছিল, কখনো বা সূফীর আজান... 
আজ দেখো শুয়ে আছে...বন্ধুদের দমফাটা বুক, 
সন্ততিরা অধোমুখ, তাদের অই সিক্ত চিবুক 
কে আর মুছায়ে দেবে, কে আর বলবে : আলো জ্বালো, 
বাউল, সৃজন করো, দেখো। গোষ্ঠে আঁধার ঘনালো...। 


বাকিটা ছাড়ুন ভাই, মাল্যদান কেরাণীরই  পেশাদার কাজ, 
খোকা ঘুমোবার পর এখন তো বেশরম সাংবাদিক-রাজ।।# 

#( বাকিটা ছাড়ুন ভাই, মাল্যদান অনেকেরই পেশাদার কাজ,
খোকা ঘুমে, পাড়া হিমে, এখন তো কেরাণীর রাজ।।)  

২৮/৩/৯৫ 
  সন্ধ্যা

# কবি এই দুটি ভার্সন রেখেছিলেন। দুটি ভার্সন-ই পাওয়া গেছে। যেহেতু তিনি নিজে কোনও ভার্সন স্থির করে যাননি, তাই দুটি ভার্সন-ই রাখা হল-- সম্পাদক)


মাছি 
 

পচা জল-অবতল ফেটে যাচ্ছে বুড়বুড়ি কেটে; 
বন্ধুরা, 
এই আমাদের অবতরণক্ষেত্র। 

...প্রতিটি গাছের নিচে শনি কিংবা শীতলার থান, 
নর্দমার অন্তরালে সার-সার লুক্কায়িত মদের বোতল, 
প্রতি মোড়ে ক্লাবঘর, নামগান, মাটি বহনের লরি, 
সাট্টা-ঠেক থেকে সপ্তাহান্তে টপ্‌কে দেওয়া নাড়ু, 
আর, হ্যাঁ – পৌরসভা-পঞ্চায়েত ইদানিং উন্নয়নে 
আধলাও খরচ করেনি... 

বন্ধুগণ, জমি কেনো, চারপাশে সীমাচিহ্ন দাও। 
কবাডির কোর্ট কাটো, চালু হোক লাঠি-ছুরি এবং কারাতে, 
সনাতন আগ্নেয়াস্ত্র আধুনিকীকরণের কাজ শেষ হলে 
সন্ধ্যায় শাস্ত্রপাঠ, তারপর অপরের পাতে 
নৈশভোজ বমি করে সমবেত ধ্বনি তুলি এসো :  
‘আমাদের প্রিয় নেতা রাম...।’ 

‘জয় ছিরি রাম।’

কবিতাগুচ্ছ সুদীপ চট্টোপাধ্যায়







জলের স্মৃতি

আমাদের রক্ত তৈরির কারখানা থেকে বেরিয়ে আসছে অন্য কারো ছায়া—মেধাবী ও গোল
বেরিয়ে আসছে এমন সব হাওয়াজালক যাদের সঙ্গে আমাদের খোলা জানলারা কোনওদিন
কথা বলেনি—বিপরীতে কবেকার ত্রুবাদুর, কবেকার বীরগাথা মৃদু সুরে কুয়াশা বাজায়

হে অনেক নাবিকের দেশ, মদ ও নারীর ভেতর কেবলই ধাতব খনিজ খুঁজেছ তুমি
সঙ্গমের আগে ও পরে ছড়িয়ে দিয়েছ স্থূল ও লম্বা যুদ্ধের ইতিহাস  
আমাদের রক্ত তৈরির কারখানা থেকে লণ্ঠনের নরম শিখা কবে যেন খোলস ছেড়েছে

আর জলে ও জঙ্গলে পড়ে আছে অনাবিল কাড়ানাকাড়ার শব  
স্নানবিম্ব। যত্ন তুলে রাখি আর শরীর অশ্রুময়
রাধা আসে, আসে ধারা

তুমি নেই—এমনই উঠোন নিয়ে আমাদের রোদ্দুর ক্রমশ গরিব হল
শীত এল। এল যে পশমবেলা, গোড়ালি ডুবিয়ে দেখি নাকছাবি পড়ে
আছে একলা দূরের মাঠে

হাতে তার নিরীহ কুরুশ—সূর্য বুনতে বুনতে পড়ে এল বেলা
জিভ ও লালার এই কারুকাজ কীভাবে তৈরি করে নরম পোশাক
রাত আসে—
খুলে ফেলি। দেখি দেহ, দেখি ত্বক—আখরে আখরে তার স্নানধারাপাত
 
কৃপাণ ফলের নাম। ফল জানে কতবেশি তক্ষক ভিতরে রয়েছে তার
আছে হেম—করুণ সেলাই
হৃদয় নামিয়ে নিলে দিকে দিকে জয়ের পতাকা ওড়ে
ওড়ে মরু, ঝড়, তাল ও তমালসারি
পাতাটি তোমার দেশ—ব্যথারং

আহার করেছ যেই অমনি ফলের নাম শানিত কৃপাণ
আমুল বিদ্ধ করে, রাহাজানি, গোপন গুহার থেকে সবেগে গড়িয়ে নামে
                                                                আঁধারতটিনী

সেও আসে। আসে তার বিম্ব। তখন জাদুকর মুদ্রা গুনে বলে দেন বালিঘড়ির সময়
হাত একটা উপমা হয়ে ওঠে, নাভি বরাবর তোমাদের রাস্তাগুলোর গন্তব্য বদলে যায়
এত রেড জোন, এত ছায়ার শহর—দাঁত ও জিভের কারুশিল্প নিয়ে একএকটা ফ্ল্যাট
কী ভীষণ উড়তে থাকে, আর শরীর ছেড়ে দিলে লাফ দিয়ে উঠে যায় আকাশে

আকাশ চতুর প্রাণী—কেবলই উড়াল বোঝে, মাংস ও মেদ পৃথক করে
দেখায় হিসেব। ঝাঁকি দিলে নড়ে ওঠে টাকাগাছ—টুপাটাপ পাখি ঝরে

আর ফ্ল্যাটগুলো পুনরায় ঢাকা পড়ে মাইল মাইল বরফের নীচে


কথাফুল, ফেলে রাখি। অতঃপর একএকটা ট্রামলাইন ধরে হারিয়ে যায় মেষপালকেরা
হলুদ ঈশ্বর তোমার সদ্য টুকরো হাতে নিয়ে দেখি তখনও উষ্ণ আছে আমাদের লোভ ও অবসাদ
ঘাসের পাতলা ফিনিফিনে ঠোঁট শুষে নিচ্ছে হালকা রোদ্দুর— এভাবেই সন্ধে আসে
আমাদের একান্ত শহরে
আর সন্ধে নামলেই টিভির ভেতরে এসে কারা যেন পরে নেয় তাদের লাল হয়ে যাওয়া দাঁত 
খুলে রাখে ব্যক্তিগত মাথা

তখন ঘরবাড়ি রান্না করে ঘুমিয়ে পড়েন হলুদ ঈশ্বর

বিছানা ও আসবাব সঙ্গে যায়। সঙ্গে যায় দু-চারটে আলোর পুতুল। আর আমি যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠি
সাদা পাতার ওপর মুখ থুবড়ে পড়ি। এসব জানলা জানে, কোনও কোনও রাতে পাঠিয়ে দেয় 
শুকনো খড়খড়ে জ্যোৎস্না। হাতে নিলে ভেঙে যায়
হাত কেটে গড়িয়ে নামে ঈষৎ গোলাপি শূন্য—গোল ও স্বচ্ছ
বিছানা ও আসবাব বরাবর সন্দেহপ্রবণ, সারা দেহ শোঁকে, গোলাপি শূন্য মুখে নিয়ে রেখে আসে দূরে

তারপর বাড়ি আসে, অসংখ্য বাড়ি। ডানা ঝাপটায়
তাদের প্যাঁচানো সিড়ি দিয়ে কেবলই ওঠেনামে আলোর পুতুল
আর শহরের দীর্ঘ সিক্ত জিভ ঘুরে ফিরে আসে, কেবলই লেহন করে
                                                                      চাপ চাপ রক্তরজনী



আমার প্রথম শিক্ষক - একরাম আলি






সেসব বাচ্চাবেলার কথা। মানে সত্যযুগের। আমাদের গেঁয়ো স্কুলঘরটা ছিল লম্বাটে, কাদামাটির তৈরি। মাথায় তার খড়ের ছাউনি। মাঝে দু-দেওয়ালে দুটো দরজা, মুখোমুখি। এ-দিকে ঢুকে সটান ওদিকে বেরিয়ে যাওয়ার মতো। যেমন বছর-বছর ফেল করে বাচ্চারা বেরিয়ে গিয়ে স্কুলছুট হত। দরজার ডাইনে তিনটে, বাঁয়েও তাই, ঘুলঘুলির মতো জানলা। স্কুলঘরের সামনে খোলা জায়গা খানিকটা। তারপর বাঁহাতি গেরেম্ভারি চালের ইঁদারা। বড়োসড়ো। সম্ভ্রম জাগানো। সারাদিন জলও উঠত বালতি-বালতি।

পাঁচ বছর বয়সে যখন ঢুকি, বসবার আসন ছিল চটের। ক্লাস ফোর শেষ করে স্কুল ছাড়বার দিনও সেই চটের আসন। মাস্টারমশাইদের জন্যে একই নড়বড়ে চেয়ার।
আশ্চর্যের যে, এ-হেন প্রাইমারি স্কুলে কী করে যেন সেঁধিয়ে গিয়েছিল কাঠখোট্টা এক আলমারি। আর তাতে কিছু শিশুপাঠ্য গল্পের বই, ম্যাপ, গ্লোব, এমনকী দু-একটা খেলনাও! কেননা, মাত্র বছর সাতেক আগে দেশ স্বাধীন আর দু-টুকরো হয়েছে যদিও, শরণার্থীর চাপে সরকারের আর মানুষের শত অনটনও সীমাহীন, তবু চারদিকে কেমন যেন কোমর বেঁধে কাজে লাগবার তৎপরতা। যাকে বলে দেশগঠনের কাজের মতো কিছু একটা উদ্দীপনা চারদিকে।

আমাদের ছোটোকুষ্টিকুরি প্রাইমারি স্কুলেও তার ছোঁয়া লেগেছিল। সদ্য হেড টিচার হয়ে এলেন মহম্মদ ইউসুফ নামের এক তরুণ। হাফহাতা শার্ট আর ধুতি ছিল তাঁর নিত্যদিনের পোশাক। খালি পা। কিন্তু পাশের বাঁশুলিপুকুরের ঘাটে পা-দুটো ধুয়ে তবে স্কুলে ঢুকতেন, যেমন গাঁয়ের গৃহস্থেরা নিজের বাড়িতে ঢোকার আগে তখনকার দিনে করত।

সেই ভগ্নপ্রায় কুঁড়েঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে বাড়ি থেকে আনা টর্চ জ্বেলে তিনি গ্লোবটাকে কোলে রাখতেন— স্কুলে টেবিলও ছিল না-- আর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাতেন দিন-রাতের রহস্য। ভরদুপুরে আমরা যখন দেখতাম, জানতে পারতাম-- কোথাও তখন সবে সকাল হচ্ছে, কোনো দেশে গভীর রাত, কোথাও ভোর হবে-হবে। কচি চোখে বিস্ময়ের ভিড় জমে যেত। তিনিই আবার মালকোঁচা মেরে ধুতি পরে ব্রতচারী শেখাতেন। পিছনের আমবাগানের ছায়ায় তাঁর নাচের তালে আমরা পা মিলিয়ে গাইতাম— চল কোদাল চালাই/ভুলে মানের বালাই...।

আরও দু-জন মাস্টারমশাই ছিলেন। কিন্তু ওই বলে না, অগণন ভিড়ে খ্যাপার সংখ্যা দু-একজনই! ইউসুফ মাস্টার (আমরা আড়ালে এমনই বলতাম। স্যর বা সার শব্দটি আমাদের মতো গেঁয়ো শিশুদের তখনো সড়গড় হয়নি।) ছিলেন তেমনই। তাঁরই উৎসাহে সামনের জমিতে আমরা একটা তাক লাগানো বাগান করেছিলাম। রূপ, রং আর গন্ধ চিনেছিলাম নানা জাতের গোলাপ, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, সূর্যমুখী, বোগেনভিলিয়া, জুঁই আর কামিনী ফুলের। কচি হাতে কোদাল আঁটছে না দেখে ভসভস করে তিনিই কুপিয়ে দিতেন নরম মাটি আর ঘাড় ফিরিয়ে বলতেন— ‘এই তো। নে, এবার বাকিটা কুপিয়ে ফেল।‘ কিন্তু, তখন আর কোপানোর মতো মাটি বাগানে থাকত না।

একটা ঝাঁকড় গাছে ছোট্ট-ছোট্ট, গোল, বেগুনি রঙের, বাহারি বোতামের মতো, কিন্তু গন্ধহীন, অসংখ্য ফুল ফুটত। আমরা বলতাম বোতাম ফুল। কী যে তার আসল নাম, আস্ত একটা বাগান করেও, আজও জানি না। গাছে জল দেওয়ার জন্যে ঝারি কেনা হয়েছিল। নল দিয়ে ঝিরঝির করে জল পড়ত পল্লবিত পাতা চুইয়ে গাছের গোড়ায়। সেই গৌরবটুকুর অংশীদার হওয়ার জন্যে ঝারির দখল নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যেত।
স্কুলের চাবি থাকত কোনো সিনিয়র, অর্থাৎ ক্লাস থ্রির অথবা ফোরের, ছেলের কাছে। সে-ই এসে স্কুল খুলত। বন্ধও করতে হত তাকেই। কোনো বিশেষ প্রশিক্ষণ ছাড়াই, ওইটুকু বয়সে, এক গেঁয়ো শিক্ষক কোথা থেকে যে শিখেছিলেন তাঁর ছাত্রদের এমন দায়িত্বসচেতন করে তুলতে!

আদর্শ শিক্ষক কাকে বলে, তখন কি জানতাম! জানলে তাঁকে তো মাথায় করে রাখার কথা। যদিও আমাদের মাথাগুলো ছিল এইটুকু আর তাঁর ছিল পেটানো চেহারা। হলে কী হবে, মনটা ছিল কেমন যেন; আমাদেরই মতো কচি আর নরম–নরম? হবে হয়তো। ইস, তখন যদি জানা থাকত!

কী করতাম, জানা থাকলে? আজ যে তাঁর চওড়া-পাতার ধুলোমলিন পা-দুটোর কথা মনে পড়ছে, সে-কি একবার প্রণাম করতে চাওয়ার জন্যে?

চিরন্তন আনন্দঋণ- পিয়াল রায়






সকালেই খবর পেলাম কবি পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, আই সি ইউতে তাঁর চিকিৎসা চলছে। আশা করি তিনি দ্রুত আরোগ্য লাভ করবেন।বাংলা সাহিত্যের তাঁর কাছে আরো কিছু পাবার আশা আছে। প্রথমে আমি যেভাবে এই লেখাটি শুরু করব ভেবেছিলাম, তা আর করা গেল না। কারন কবিতার কাছাকাছি থাকা এক পাঠক হিসেবে সকালের এই দুঃসংবাদটি মনকে উদ্বিগ্ন করে তুলল এবং যারপরনাই ব্যাকুল করে তুলল কবির স্বাস্থ্য সম্পর্কিত ভাবনাটি। একনিষ্ঠ কবিতা পাঠকের কাছে যে একজন অগ্রজ  কবি কতখানি শিক্ষকের ভূমিকা পালন করেন, তা আর নতুন করে বলে বোঝাবার প্রয়োজন নেই। কবি পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলালের কবিতার কাছে আমি তেমনিভাবেই ঋণী।  না, কবির সাথে সশরীর আলাপ আমার হয় নি, যেটুকু হয়েছে তা তাঁর কবিতার সূত্রে এবং আন্তরিক টানের এই সুতো যে কত মজবুত তারই প্রমাণ  আজকের এই মন খারাপ। ঘুম থেকে উঠেই দেখার কথা ছিল শরতের ঝকঝকে আকাশ, তার বদলে নেমে এল ঘনঘোর মেঘের চাবুক। কাকতালীয় ভাবে এর কিছুক্ষণ পরেই  এক বাল্যবন্ধু দুর্গাপুর থেকে ফোন করল যাঁর হাতে আমাদের বাংলা শিক্ষার হাতেখড়ি তিনিও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন আচমকা। উপায় নেই যে শুনেই ছুটে যাব স্যার কে দেখতে।  ঘরে বসেই ওলটপালট করলাম নিজেকে। প্রার্থনা করলাম দ্রুত সেরে উঠুন তিনি। গান আর কবিতার যুক্তবেণী রচনার শিক্ষা তো তিনিই প্রথম দিয়েছিলেন।

      কবি বিকাশ নায়ক আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন। কবিতার কলম ওর বেশ শক্তিশালী।  ইদানিং গল্প লিখতে শুরু করেছে, এবং প্রথম গল্পটিই পরিবেশিত হয়েছে আনন্দমেলার কচিকাচা পড়ুয়াদের কাছে। গল্পটি আমার পড়া হয়নি, কিন্তু জানি বিকাশ  ছোটদের জন্য যা লিখবে তা শিশুদের ধারণ ক্ষমতাকে অতিক্রম করে যাবে না।  প্রায়শই আমাদের গল্প হয় ফোনে। ওঁর চিন্তাধারার স্বচ্ছতা আমায় খুশি করে। শিশুদের মনস্তত্ত্ব যে বিকাশ এত ভালো বুঝতে পারে তার কারন শিশুদের সাথেই বেশির ভাগ সময় কাটাতে ও বেশি ভালোবাসে। সম্পূর্ণ বিনা পারিশ্রমিকে ও একটি আবৃত্তি ক্লাস চালায়, সেখানে ওদের থেকে শেখে নিত্যদিন। আর আমি শিখি বিকাশের কাছে। বাবামায়েরা যখন বেতন দেবার কথা বলে, সসম্মানে তাদের ফিরিয়ে দেয় বিকাশ। অর্থনৈতিক কোনো চাহিদা ওঁর নেই। শিশুদের কলকোলাহল যে আনন্দে বিকাশকে ভরিয়ে রাখে তেমনটা বোধকরি টাকাপয়সা বিনিময়ে সম্ভব নয়।বিকাশের নিজের কথাতেই অর্থের বিনিময় এলেই একটা কেজো দায়বদ্ধতা এসে পড়ে শিক্ষক এবং অভিভাবকের মাঝে। মাঝখান থেকে শেখা এবং শেখানোর  সারল্যটাই যায় হারিয়ে।যখন আমাদের কথা হয়, আবৃত্তি শিখতে আসা এই বাচ্চাদের কোনো না কোনো প্রসঙ্গ আসবেই। বাচ্চাদের চট করে শিখে ফেলার ক্ষমতা আনলিমিটেড। শঙ্খ ঘোষের সাথে ফোনে কথা বলে বলে বিকাশ কবিতায় ছন্দ আয়ত্ত করেছিল এবং আমার সাথে আলাপের পর সে শিক্ষা আমাকে চেয়েছিল দিতে। বলা বাহুল্য, আমার মতো নিরেট ছাত্রী বিকাশ ইহজন্মে দেখেনি, ফলে হাল ছেড়ে দিয়েছিল অল্প ক'দিন পরেই। আমি তো আর শিশু নই, হায়, কেন যে আমি আর শিশু হতে পারিনা?  

     কলেজে পড়ার সময় কণিকা বিশ্বাস ছিলেন আমাদের বাংলার শিক্ষিকা।  কেন যেন আমাকে বেশ স্নেহের চোখে দেখতেন। আমিও তাঁকে পছন্দ করতাম খুবই।  আমি একা নই, বাংলা ডিপার্টমেন্টের সব ছেলেমেয়েরাই পছন্দ  করত ওঁর পড়ানোর স্টাইল।এমন কোনো ছাত্রছাত্রী ছিল না যারা ওঁর ক্লাশ না করতে চাইত।সারাদিন আড্ডার পরে বেলাশেষের ক্লাশ থাকলেও কোনোদিন দেখিনি কে.বি.র ক্লাশ কেউ মিস করেছে। প্রশ্নই নেই।  তবে ব্যাপারটা শুধু পড়ানোতেই আটকে ছিল না। তিনি ছিলেন যেমন সুন্দরী  তেমনই ছাত্রদরদী। যখনই যে সাহায্য চেয়েছে, তা সে যে সাহায্যই হোক না কেন, তিনি হাসিমুখে সাহায্য করেছেন। এমন কি কলেজের ছাত্র ইউনিয়নও কে.বি.র কথা শুনতো মন দিয়ে, এমনই ছিল তাঁর সহজ ভালোবাসার টান।  কে.বি.র কাছে জীবনের অনেক সহজ কঠিন পাঠ নিয়েছি আমি নিজের এবং তাঁর অজ্ঞাতসারেই। অনেক ঋণ জমে আছে।  যখন দুর্গাপুর ছেড়ে লেডি ব্রেবোর্ণে চলে এলেন, তখন ওঁর ইচ্ছে ছিল কলকাতায় থেকে মাস্টার্স করি আমি। কলকাতায় ওঁর ফ্ল্যাটে থেকে পড়াশোনাটা করলে নানা ভাবে তিনি আমায় সাহায্য করতে পারবেন। কিন্তু ওই যে, কপাল, বঙ্গ,সঙ্গ, সর্বত্রই নাকি তারা একসাথেই যান। ইয়ে ফেবিকলকা জোর হ্যায়, টুটে গা নেহি।  বিস্তর বাধাবিপত্তিতে তা আর সম্ভব হয়নি, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই আমাকে কমপ্লিট করতে হয় মাস্টার্স।  ভারি খুশি হয়েছিলেন যে বিয়ের পর পড়াটা জলাঞ্জলি না দিয়ে সেটা শেষ করেছি দেখে। কিছুদিন আগেই আমার এক বোনের বর,তিনি আবার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক,   দেখা হয়েছিল কণিকা ম্যাডামের সাথে সম্ভবত লেডি ব্রেবোর্নেই(ঠিক খেয়াল পড়ছে না), শুনেছি আমার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন তার কাছে স্টাফ রুমে বসে। এসব কানে এলে আনন্দে বুক ফুলে ওঠে। এত দীর্ঘ ব্যবধানেও তিনি মনে রেখেছেন আমার মতো সামান্য এক ছাত্রীকে। আমার বিয়েতে তাঁর দেওয়া মহাশ্বেতা দেবী ও মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় সমগ্র এখনও যত্নে রাখা আছে। একমাত্র ছেলের বিয়েতে ম্যাডাম যে দুজন ছাত্রীকে নেমন্তন্ন করেছিলেন, আমি ছিলাম তারমধ্যে একজন।ততদিনে আমি দুর্গাপুর ছেড়ে শালবনী চলে এসেছি।মনে আছে বিয়ে উপলক্ষ্যে  আমাকে একটা ভীষণ জমকালো জারদৌসি শাড়ি দিয়েছিলেন। সে শাড়ি আজও তেমনি নতুনটি রাখা আছে, প্রাণে ধরে ব্যবহার করতে পারিনি। এক জীবনে সেসব অমূল্য সম্পদ।  শিশুর মতো মন ছিল তাঁর তাই সহজেই পারতেন আলো ছড়িয়ে দিতে। 
'তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা... '


     শিশুর মতো মনের প্রসঙ্গে আরো একজনের কথা না বললেই নয়, তিনি হলেন কবি মঞ্জুভাষ মিত্র। তাঁর কাছেও পড়ার সৌভাগ্য হয়েছিল দুর্গাপুরে থাকাকালীন।  পড়াতেন বৈষ্ণব পদাবলি।  ডায়াসে উঠেই উর্ধ্বমুখ। জানিনা ছাদের দিকে তাকিয়ে কোন্ ছাত্রছাত্রীকে তিনি কল্পনা করে নিতেন ও তাদের পড়িয়েই হন্তদন্ত বেড়িয়ে যেতেন। চুলে কোনোদিন চিরুনি চালাতেন কিনা বুঝতে পারতাম না। ভারী খামখেয়ালি মানুষ ছিলেন। অধ্যাপক সুলভ গাম্ভীর্য বিন্দুমাত্র ছিল না। মন খুলে কথা বলা যেত। কিন্তু তখনও আমার কবিতার রুচি গড়ে ওঠেনি, ফলে হাতের কাছে পেয়েও হারিয়ে ফেলতে হল কবিকে। এখন খুঁজি, কিন্তু পাই না। যখন দুর্গাপুর ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, এত ছাত্রছাত্রী থাকতে কেন যে আমার হাতেই তাঁর লেখা বৈষ্ণব গ্রন্হের একখানি কপি দিয়ে গেছিলেন, জানিনা। অবাক হয়েছিলাম প্রচন্ড। সে বইও রাখা আছে।এর পিছনে কে.বি.র কোনো হাত ছিল কিনা জানিনা। শিক্ষক ভাগ্য চিরকালই আমার বেশ ভালো তা স্বীকার করতেই হবে। এম এ করার সময় তাহের স্যারের কাছে যখনই বই চেয়েছি, তিনি দিয়েছেন। ছাত্রছাত্রী বই নিয়ে আর ফেরত দিতে চাইত না বলে তিনি একটা খাতায় ব্যাপারটা মেনটেন করতেন। কে কবে কোন বই নিল, কবে ফেরত দিল, তারিখ দিয়ে স্বাক্ষর করে রাখতেন। বই ফেরত না দিলে নতুন বই পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই থাকত না। সুখের বিষয় আমার বেলায় তেমন কড়াকড়ি করতেন না। নিজে থেকে সিলেবাসের ও সিলেবাসের বাইরের অনেক বই পড়তে দিয়েছিলেন। প্রচুর গবেষণাধর্মী বই ছিল তাঁর বাড়িতে। আমারও সুবিধে হয়েছিল সে সময়।এমনিতে আমি বই পড়তে নিলে সবসময়ই ফেরত দেওয়ার পক্ষপাতী এবং সেটাই আমি করে থাকি। কেউ কেউ বিশ্বাস করে দেয় কেউ কেউ দেয় না।  যতবারই কেউ দিয়েছে ততবারই পড়া হওয়ার পর ফেরত দিয়েছি। কিন্তু স্যারের  বই ফেরৎ দেওয়া আর হত না, তিনিও চাইতেন না। এই করে অনেক বই ওঁর বাড়ির তাক থেকে আমার বাড়ির তাকে এসে জমে বসে গেছে। বৃহৎ কলেবর সেসব বই আর ফিরে যেতে চায়নি পূর্বের ঠিকানায়। কেন যেতে চায় নি, এ ব্যাপারে আমাকে জিজ্ঞাসা না করাই ভালো, উত্তর মিলবে না। দু'হাত ভরে শুধু নিয়েই গেলাম, ফিরিয়ে দেওয়া হল না কিছুই। এ আনন্দঋণ শুধব তেমন আমার সাধ্য নেই। 




     আমার তো মনে হয় প্রেমের ফাঁদের মতোই ভুবনজুড়ে ছড়ানো আছে শিক্ষার ফাঁদ। কেউ তোমাকে ধাক্কা দিল আর তুমি গিয়ে পড়লে সে ফাঁদের মধ্যে। তবে শিক্ষা কতটা নেবে সেটা নির্ভর করবে কোন দরজাটা তুমি কতটা খুললে তার ওপর। যদি সদর অন্দর দুটোই খুলে দাও তাহলে পেয়ে গেলে বহুমূল্য মণিহার, যার ব্যপ্তির সীমানা নেই। অপরদিকে যদি শুধু সদর খোলা রইল অথচ অন্দরের দরজা রইল বন্ধ,  তাহলে সত্য এসেও ফিরে গেল নির্মম নিষ্ঠুরতায়। তবে প্রেমের সাথে শিক্ষার একটা মূলগত পার্থক্য হল প্রেম সদাই চঞ্চল। শুধু পাওয়ার জন্যই নয় ধরে রাখার জন্যও বিশেষ প্রয়াস প্রয়োজন,নইলে কপালে জোটে বাবাজি কা ঠুল্লু আর শিক্ষা একবার গৃহীত হলে তা আর ছেড়ে যায় না কোনোদিন।  প্রেমের ক্ষয়বৃদ্ধি থাকলেও শিক্ষার তা নয়। ক্ষয় নেই তার, যা আছে তা হল গহনে লুকিয়ে থাকা। খুঁজলেই আবার সামনে এসে দাঁড়ায়, এতদিন খোঁজ না রাখার জন্য অভিমান করে মুছে যায় না। বন্ধুতা, প্রেম, যৌনতা,রাজনীতি,  পৃথিবী, বর্হিপৃথিবী, পক্ষ, বিপক্ষ, একটা গোলাপ এবং তাকে রক্ষা করে থাকা কাঁটা,খাটো ইজেরে রাস্তার ধারে বসে থাকা শিশুটি সবাই এই শিক্ষার রসদ, জন বিশেষে তা আপেক্ষিক হতে পারে কিন্তু মূল্যহীন নয়।  মরুতেও ক্যাকটাসের সবুজ দেখা যায়, সে সবুজে ফুটে ওঠে রঙিন ফুল। আর সে ফুলের সৌন্দর্যরূপে মোহিত না হয় এমন বেরসিক কে আছে?  

আমার শিক্ষক- সৌম্য দাশগুপ্ত






কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গত মিলেনিয়ামের বিখ্যাত বাংলার অধ্যাপক সুকুমার সেন তাঁর আত্মজীবনী দিনের পর দিন যে গেলবইয়ে তাঁর একেবারে ছোটবেলাকার শিক্ষকদের সম্বন্ধে অনেকটা অংশ লিখেছিলেন | সেইসব শিক্ষকদের নানারকম ব্যক্তিত্ব, পড়ানোর পদ্ধতি, ও ছাত্রদের সঙ্গে অম্লমধুর সম্পর্কের গল্প বলার পরে তিনি মন্তব্য করেন – ‘আজ সেই শিক্ষকদের চরণে শতকোটী প্রণাম নিবেদন করি’ | এই জায়গাটা পড়বার সময় মনে হয়, বাপরে এত মারধোর খেতেন, তারপরও ছাত্রদের কিকরে এত ভক্তি ! কিছু একটা নিশ্চয়ই ছিল, র‍্যাডিকাল সুকুমার সেন মশাই তো ফট করে এরকম লিখবেন না সুকুমার বাবুর সম্পর্কে অনেক গল্প তিনি এম এ ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের আপনি করে কথা বলতেন, আবার বকুনিও দিতেন – ‘আপনারা কেউ পড়াশোনা করেন না , আপনারা এক-একটি গাধা!জীবনের উপান্তে এসে পৌঁছোনার পর যখন তাঁর সাক্ষাতকার নেন এক সাংবাদিক, তখন তাঁকে প্রশ্ন করা হয় তাঁর সেরা ছাত্র কে ? তিনি জানান ওরকম কেউ নেই | বিস্মিত সাংবাদিক পাল্টা প্রশ্ন করেন, সেকী, কেউ নেই, এতদিন কী করলেন তাহলে এত ছাত্র পড়িয়ে? সুকুমারবাবুর উত্তর, কি করেছি? ভস্মে ঘি ঢেলেছি !
এইরকম চাঁচাছোলা কথা-বলা পাবলিক ইমেজের মস্ত বড় পন্ডিত যখন তাঁর মাস্টারমশাইদের সম্পর্কে ঐরকম বিনম্র মন্তব্য করেন, তখন আমাদের মন আর্দ্র হয়ে ওঠে , স্বাভাবিক ভাবেই কৌতুহল হয় যে কী এমন প্রভাব সেই বিংশ শতাব্দীর দরিদ্র টোলপন্ডিতরা রেখেছিলেন বালক সুকুমারের ওপর যে তাঁর আজও এত শ্রদ্ধা জাগে | সুকুমারবাবুর গল্প তাঁর নিজের, আমি আমার অভিজ্ঞতার কথা বলে আমাদের শিক্ষকদের দিকে তাকিয়ে দেখতে চাই সেরকম শ্রদ্ধা জাগে কিনা | স্কুলের গল্পই আজ করব আরেকদিন লিখব প্রেসিডেন্সির কথা |
আমি একেবারে বাল্যকালে পড়েছিলাম দুর্গাপুর শহরে জেসুইট পাদ্রীদের চালানো সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে , যেখানে ক্লাস ফোর অবধি পড়ার পরে আমাকে দেওয়া হয় নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন  আশ্রমে | তখন মাধ্যমিকউচ্চমাধ্যমিকে নরেন্দ্রপুরের খুব ভাল রেজাল্ট হতো, আর হোস্টেলে কৃচ্ছ্রসাধনের বিধি থাকায় আমার বাবার (তিনিও সুকুমার সেনের ছাত্র) মনে হয়েছিল এতে আমার চরিত্র তৈরি হবে | কৃচ্ছ্রসাধনের মধ্যে যেটা সবচেয়ে কষ্টের ছিল, সেটা হল আমাদের হোস্টেলের ঘরে ফ্যান ছিল না | দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ওই গুমোট গরম, চারপাশে ভয়ানক বাঁশবন , তার মধ্যে ফ্যান না থাকার সঙ্গে চরিত্রগঠনের কী সম্পর্ক জানি না , তবে আজকাল  এ-সি ছাড়া থাকতে পারি না তাতে টের পাই যে ওসবে বিশেষ কাজ হয় না | ওদিকে আমরা স্কুল ছাড়ার পরপরই হোস্টেলেও ফ্যান এসে গেছে | নিজেদের ঘর পরিষ্কার রাখা, নিজের বাসন মাজা, কাপড় কাচা,  এইসব কাজ সেই দশ বছর বয়েস থেকেই অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল |
আবাসিক স্কুলের শিক্ষকরা অনেকেই ছাত্রদের সঙ্গে হোস্টেলে থাকেন, তাঁদের তত্ত্বাবধানে থেকে তাঁদের সাহচর্যের নিরাপত্তার তুলনায় তাঁদের ভয়ই পেতাম বেশি ,সাতের দশকে আমাদের দেশে পিটুনির কোনও কার্পণ্য ছিল না | কিন্তু এইসবের পরেও আজ পিছনে ফিরে তাকিয়ে মনে হয় যে এই নিম্নমধ্যবিত্ত, উচ্চাশাহীন, নির্লোভ ছাত্রপ্রেমী মানুষগুলি সম্পূর্ণভাবে আত্মসুখবিসর্জন দিয়ে আমাদের তৈরি করার জন্য ব্রতধারণ না করলে আমাদের কিছু শেখা হতো না | এইরকম কয়েকজনের কথা আজ বলব | আমি নিশ্চিত যে আপনাদের সবারই এরকম শিক্ষক-কাহিনীর স্টক আছে, আমি শুরু করলেই আপনাদের কাছ থেকে আরো অনেক গল্প শুনতে পাব |

নরেন্দ্রপুরের সর্বকালের সবচেয়ে খ্যাতিসম্পন্ন শিক্ষক ছিলেন শ্রী অজিত সেনগুপ্ত | ইনি বায়োলজি পড়াতেন| এইখানেই দাঁড়ি দেওয়া যেত, কিন্তু এইখানে থামলে তিনি আরকি কি করতেন  তার কিছুই বলা হয় না | অজিতদা (রামকৃষ্ণ মিশনে মাস্টারমশাইদের দাদা বলে ডাকার চল, শান্তিনিকেতনের মতই, পরে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে বা তারও পরে প্রেসিডেন্সি কলেজে গিয়ে স্যার বলে ডাকার রেওয়াজ আমাকে ফের রপ্ত করতে হয়েছিল ) বায়োলজি পড়াতেন, নাটক করাতেন, ফুটবলে কিক করা শেখাতেন ধুতি তুলে, পাঞ্জাবি ছেড়ে লাফ দিয়ে উঠে ভলিবলে চাপ মারতেন, সাঁতার কাটতেন, প্রেয়ারহলে গলা ছেড়ে আমাদের সঙ্গে গান করতেন, ধ্যান-নিমগ্ন হয়ে থাকতেন বহুক্ষণ, আবার ক্লাসে গিয়ে পড়ানোর সুত্রে আমাদের ভাষা শিক্ষাও দিতেন | ভাবতে পারেন, বায়োলজি ক্লাসে ভাষা শিক্ষা ! আমাদের সেকশনটি ছিল ইংলিশ মিডিয়াম, অন্যগুলি বাংলা । আমাদের সঙ্গে রাস্তাঘাটে, হোস্টেলে, অন্যান্য জায়গায় দেখা হলে বরিশালের এই সাদা ধবধবে ধুতি আর গিলে করা পাঞ্জাবি পরা নিপাট বাঙাল মানুষটি একদম কলকাতাইয়া বাংলাতেই কথা বলতেন, কিন্তু ক্লাসে ঢোকামাত্র সুইচ করে যেতেন একবারে কুইন্স ইংরেজিতে । তখন আমাদের কাছে নতুন নতুন সব শব্দ ব্যবহার করে আমাদের লাইফ সায়েন্সের ডিকটেশন দিতেন তিনি । সেল ডিভিশন হওয়ার সময় সেগুলো লম্বাটে হয়ে টানটান হয়ে যায়, বোঝাতে গিয়ে ব্যবহার করলেন 'টঅট্ কন্ডিশন' । তারপরে কারো একটা দিকে তাকিয়ে বলতেন 'স্পেল ইট' । বোর্ডে এই নতুন শেখা শব্দটি লিখতেন । বোঝাতেন, সায়েন্স পড়ো আর আর্টসই  পড়ো, ভাষার ওপর প্রকৃত দখল তৈরি না করতে পারলে শিক্ষিত হতে পারবে না ।

          অজিতদা সেকালের হিসেবে শৌখিন ছিলেন ।  অসম্ভব রোগা ছিলেন, একদম হাড়গোড় বার করা বলতে যা বোঝায়, আর গলার স্বর ছিল গমগমে । চুল পাটপাট করে ব্যাকব্রাশ করতেন, আর খশ সাবান মাখতেন । বহুদূর থেকে সেই খশ-এর সুগন্ধ পাওয়া যেত, আমরা বুঝতাম অজিতদা আশেপাশে আছেন । সেভেনে অজিতদাকে প্রথমে পাই, তারপর ফের নাইন-টেনে । ওই প্রবল ব্যক্তিত্ব, মোটা ফ্রেমের চশমার ভিতর দিয়ে মর্মভেদী তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, আর মাঝেমাঝেই কোনো না কোনো পাকা ছেলের কাণ্ড লক্ষ্য করে এমন একেকটা তির্যক মন্তব্য করতেন যে অতি চালাকেরও বুদ্ধিভ্রংশ হয়ে যেত, একদম ছিন্নভিন্ন করে দিতেন | সুতরাং প্রয়োজন হলে অজিতদার জিভই ছিল প্রচণ্ড মারের মতন, তাঁর আর কারো ওপর হাত তোলার দরকার হত না । মাঝেমাঝেই আমাদের বলতেন, আমি পিতৃহীন মাতৃহীন অবস্থায় বড়ো হয়েছি, আমার কাছে স্নেহ দয়া মায়া প্রত্যাশা করিস না।

          অথচ এই মানুষটির কাছে কী বিপুল পরিমানে আমরা পেয়েছি তা বলার নয় ।  ছয়ের দশক থেকে দশের দশক ব্যাপী পঞ্চাশ বছরে নরেন্দ্রপুর থেকে পাশ করা অন্তত চারশ জন বিখ্যাত ডাক্তারের মধ্যে প্রায় প্রতেকে এক বাক্যে বলবেন তাঁরা অজিতদার ক্লাস করে বায়োলজি ভালোবেসেছিলেন, আর সেই থেকে ডাক্তারির শখ । অথচ মজার কথা হলো যে অজিতদা ডাক্তারি আর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াকে শিক্ষা লাভ করা বলতেন না । বলতেন এগুলো হলো পেশাদারী ট্রেনিং । বলতেন, সাহিত্য, সঙ্গীত, নাটক, ইতিহাস, দর্শন, নানান ভাষায় ব্যুৎপত্তি, এগুলো হলো প্রকৃত 'শিক্ষা', এবং পৃথিবীর সমস্ত কারিকুলামে এগুলি বাধ্যতামূলক  করে দেওয়া উচিত, যাতে কিছু বিবেকবান, রুচিবান, হৃদয়বান প্রকৃত শিক্ষিত ব্যক্তি তৈরী হয়, তারা যাতে সমাজ গঠনের কাজে লাগে ।

          অজিতদার কাছে সেই আটের দশকে যা শুনেছি, আজকে টের পাই তা কতো সত্য । এম আই টি-তে ইঞ্জিনীয়ারিং কারিকুলামে কবিতা পড়া বাধ্যতামূলক হয়ে গেছে, নতুন করে আন্দোলন উঠেছে যাতে প্রাইমারি বা মিডল স্কুল থেকে ছেলে মেয়েদের দর্শন পড়ানো হয়, ভাবতে শেখানো হয় ।

          আমাদের যিনি ইতিহাস পড়াতেন, সেই সুভদ্র নীরব মানুষটিরও নাম ছিল অজিত দা, অজিত চট্টোপাধ্যায় । আমাদের শিক্ষকদের অনেকেই অন্যান্য স্কুলে হেডমাস্টার ছিলেন দীর্ঘদিন | হেডমাস্টারি করার পর রিটায়ার করলে নরেন্দ্রপুরে তাঁদের সসম্মানে নিয়ে আসা হতো, ইনি ছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন । ইনিও ধুতি আর পাঞ্জাবি-শার্ট  পরতেন, এঁরও শাদা চুল ব্যাক ব্রাশ করা, আর যখন যে ভাষায় কথা বলতেন তখন সেটার মধ্যে ভুলেও অন্য ভাষা ঢোকাতেন না । অর্গলহীন ভাবে মৃদুস্বরে  টানা পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে ইতিহাসের এমন সুন্দর ইংরেজিতে লেকচার দিতেন যে মনে হতো যেন হীরেন মুখোপাধ্যায়ের 'তরী হতে তীর' পড়ছি,  যেখানে বিখ্যাত সব ইতিহাসের ছাত্রদের গল্প শুনেছি, যাঁদের এম এ পরীক্ষার উত্তর পড়ে সেকালের ইংরেজ শিক্ষক মন্তব্য করেছিলেন, 'দ্য এক্জামিনী ইজ বেটার ইনফরম্ড  দ্যান দ্য একজামিনর, হেন্স ইট ইজ পয়েন্টলেস টু অ্যাসাইন এ মার্ক অন দিস এক্সেম্প্লারি পেপার'

          একদিন এই ইতিহাসের অজিতদা প্রশ্ন করেছেন, 'হু ডু য়ু কনসিডার টু বি দ্য আশারার অব রেনেসাঁ ইন বেঙ্গল?' সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সহপাঠী বোঁদে (বর্তমানে বস্টনের অর্থনীতিবিদ ডক্টর রাজীব রঞ্জন ভট্টাচার্য) সব-প্রশ্নের-উত্তর-জানি গোছের একটা স্মার্টনেস নিয়ে উৎসাহের সঙ্গে হাত তুলে কায়দা মেরে বলতে শুরু করলো, আই কনসিডার পান্ডিট ঈশওয়ার চন্ড্রা ভিড্যাসাগর টু বি দ্য আশারার...' কথা শেষ না হতেই আমাদের সদা শান্তশিষ্ট অজিতদা গর্জন করে উঠলেন, একে বারে শম্ভু মিত্রের কণ্ঠে ক্রেয়নের প্রতি অয়দিপাউসের ক্রুদ্ধ ডায়ালগের মত, 'য়্যান্ড আআই কনসিডার য়ু টু বি এ ফুউউল..... সিট ডাউন!!আরেক দিন উনি আমাদের কোনো একটা ব্যপারে হাসাহাসি করতে দেখে খেপে গিয়ে বললেন 'হোয়াই আর ইউ ঈডিয়টস লাফিং? হ্যাভ ইউ রেড ল' স্ত্রেঞ্জ (দ্য আউটসাইডার), অর ফ্রান্ৎজ কাফকাজ মেটামরফসিস? ইজন্ট ইট রিডিক্যুলস দ্যাট ইউ  অর ইন ক্লাস টেন, ইয়েট ইউ অর সো গ্রোসলি ইমবেসাইল দ্যাট ইউ হ্যাভনট রেড দিজ বেসিক বুকস ?' ব্যাস - সেই লজ্জায় পরের দিন লাইব্রেরিতে গিয়ে দেখি সব কটা কাম্যু-কাফকা সেদিনই চেক আউট হয়ে গেছে !

রেগে গিয়ে গালি দিয়েও কিভাবে ছাত্রদের শিক্ষিত করা যায়, সেদিন বুঝিয়ে দিলেন ইতিহাসের অজিতদা ।

          বাংলার শিক্ষক বেণু সান্যাল ছিলেন বেশ হৃষ্টপুষ্ট গোলগাল, ইনিও ধুতিবংশীয় । মুক্তোর মত হাতের লেখায় ছাত্রদের খাতার ওপর যেসব মন্তব্য লিখতেন, সেগুলো পড়ে মনে হতো যে আমরা আসলে অনেক কিছুই জানি, কিন্তু লেখার সময় উল্লেখ করতে ভুলে গেছি । জয়াশিসের খাতায় লিখলেন, 'আজকাল ওই যে কথা উঠেছে শোননি যে বিভূতিভূষণ নাকি পলায়নবাদী ছিলেন, তাই যদি হবে তো আর্ট ফর আর্টস সেক -এর যুক্তিই এক লবটুলিয়া দেখিয়ে খারিজ করে দিতে হয় ! কেন সর্বজয়ার কথা কি হারানো মানুষের কথা নয় ? - 'জয়াশিস পলায়নবাদ বা এসকেপিজম শব্দগুলি ওই প্রথম শুনলো । আমরাও তাই । কিন্তু এমন ভাবে বেণুদা লিখেছিলেন, যেন ওঁর ধারণা আমরা সবাই এগুলো জানি, অন্তত জানার কথা তো বটেই । তখন তো উইকিপিডিয়া, গুগল, আর য়াহু সার্চ ছিল না, আস্ত একটা কম্পুটারই কেউ চোখে দেখেনি, তাই আমাদের চট করে সার্চ করারও উপায় ছিল না । অগত্যা বেণুদার কাছেই গিয়ে বললাম, স্যার পলায়নবাদ কি জিনিস । যত্ন করে বুঝিয়ে দিলেন ।

          অংকের শিক্ষক নীলাচল সামন্ত আমাদের সহপাঠি শুভ্রকান্তি লোধ-এর টেরিকাটা চুল দেখে একদিন বললেন, ওরে, টেরি আরও ভালো করে কাট, আমার ভাইয়ের ছবিতে তোকে হিরো করে নেবে । নীলাচলদার ভাই ছিলেন শক্তি সামন্ত, আর তাঁর ছবির বাজার আটের দশকে রমরমা, অনুসন্ধান সবে হিট করেছে  । এই নীলাচলদা আরেক বিস্ময় । একজন অংকের শিক্ষক যে স্রেফ বিপুল স্নেহ আর ভালবাসায় ছাত্রদের ভরিয়ে দিয়ে তাদের অংকভীতি দূর করতে পারেন, সেটা তাঁকে না দেখলে বিশ্বাস হতো না । অংক নিয়ে বেশি বকবক করতেন না, কেবল ভালবাসতেন,  আমাদের সঙ্গে সুখদুঃখের গল্প করতেন । অন্য ক্লাসঘরে কোনো শিক্ষক মারধোর করলে উঠে গিয়ে তাঁকে নিরস্ত করতেন । আর এতেই আমাদের তাঁর প্রতি এমন একটা শ্রদ্ধা আর ভালবাসা তৈরি হয়েছিল যে কেবল তাঁর মুখ রাখতে হবে বলেই আমরা আরো মন দিয়ে ওঁর পড়া শুনতাম, আর সেইভাবে একদিন অংক শিখে গেলাম সবাই । রবীন্দ্রনাথ পালধি কেমিস্ট্রিতে বি এস সি করেছিলেন, বাংলার ক্লাসে কেমিস্ট্রিও পড়াতেন, বাংলাও । সবচেয়ে মজার কাণ্ড ছিল যে উনি কেমিস্ট্রির ধাতু আর এসিডের সংমিশ্রনে তৈরি কম্পাউন্ড-এর ফর্মুলা উদাহরণ দিয়ে বাংলা ব্যাকরণের ধাতু ও প্রত্যয় শেখাতেন । বলতেন সংস্কৃত ভাষাটা কি সায়েন্টিফিক দেখ, কেমিস্ট্রি বুঝলে  সংস্কৃত ব্যাকরণটাও বুঝবি, আর সেটা শিখলে বাংলায় শব্দ তৈরি করতে পারবি ইচ্ছেমতো ! ব্যাকরণ পড়াতে পড়াতে গম্ভীর মুখে এমন সব মজার কথা বলে হাসাতেন যে আমাদের ব্যাকরণ-ভয় কেটে যেত !

          আরেকজন রবিনদা ছিলেন রবীন্দ্রনাথ দত্ত। ইনি ক্লাসে কারো অমনোযোগ দেখলে বাঁ হাত দিয়ে পিছনে বোর্ডের দিকে না তাকিয়ে তার ওপরে একটি নিটোল ছড়া বা লিমেরিক লিখে দিতেন । তার দু একটি মনে পড়ে আজও, এই তিরিশ বছর পরেও:

"অনুপ কুমার সাহা/ সত্যি নাকি তাহা/ চেয়ার থেকে পড়লে সবাই/ বলে, 'আহা , আহা !"
কিংবা
"বাংলা দেশের ছেলে/ গঙ্গাপ্রসাদ নাম/ হুল্লোড় আর করে হৈ চৈ/ কী আছে তার দাম ?"

রবীনদা ক্লাসে একটা চমৎকার গল্প বলে একজন ডাক্তার ঔপন্যাসিকের প্রতি আমাদের উৎসাহ বাড়িয়ে দিয়েছিলেন । এই লেখক যখন স্কুলে পড়তেন, তখন ক্লাসে গোরুর রচনা লিখতে দেওয়া হয়েছিল । সবাই যেমন লেখে, সেরকম না লিখে তিনি একটি ছড়া লিখেছিলেন । শিক্ষক তাঁকে ফুল মার্কস দিয়েছিলেন । তার কয়েকটা লাইন এই রকম (তিরিশ বছরের পুরানো সেই ক্লাসের স্মৃতি থেকে লিখছি, পাঠক ভুল হলে ক্ষমা করবেন):

'মানুষ তোমায় বেজায় খাটায়, টানায় তোমায় লাঙল গাড়ি
একটু যদি ভুল করেছো, পড়বে পিঠে লাঠির বাড়ি
মানুষ তোমার মাংস খাবে, অস্থি দেবে জমির সারে
চামড়া দিয়ে পরবে জুতো, বারণ কে তায় করতে পারে !
তোমার ওপর এ-অত্যাচার, হে মরতের কল্পতরু
কারণ, নহ সিংহ কী বাঘ, কারণ তুমি নেহাত গোরু !'

এই লেখকের নাম ডাক্তার বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়, ওরফে বনফুল!

যেসব শিক্ষক এইভাবে আমাদের প্রকৃত শিক্ষিত করার চেষ্টা করে গেছিলেন, এঁদের প্রায় কেউই আজ নেই । আজ এই মহানুভব, আত্মত্যাগী, পরার্থপর ছাত্রদরদী শিক্ষকদের কথা মনে করে তাঁদের পায়ে শতকোটি প্রণাম নিবেদন করি । 

ধারা ৩৭৭, সুপ্রিম কোর্ট এবং একটি সবুজ সাপ - দেবব্রত শ্যাম রায়












সমকামকে দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা থেকে বিযুক্ত করে দেওয়ার রায়ে নবীন প্রজন্মের মধ্যে যে আন্তরিক উচ্ছাস ও সংবেদন চোখে পড়ল, তা অভূতপূর্ব। বিগত এক দশক ধরে নানা সময়ে সমকাম জনপরিসরের নানা চর্চায় উঠে এসেছে, কিন্তু এর আগে কখনও ভারতের নাগরিক সমাজকে বিষয়টির জন্য এতটা প্রস্তুত বলে মনে হয়নি। পাশাপাশি, বেশ কিছু প্রতিস্বরও শোনা গেল, যা মূলত বিরক্তি ও হতাশার প্রকাশ। বোঝা যায়, এর বেশিরভাগটাই অজ্ঞতাপ্রসূত, আজন্মলালিত বিশ্বাস ভেঙে যাওয়ার জাড্য, আর বাকিটা মৌলবাদী অন্ধত্ব। শাসক দল বিজেপি এই নিয়ে কোনও মন্তব্য না করলেও আর এস এস সরাসরি এই রায়ের নিন্দা করে বিবৃতি দিয়েছে। সমকাম নাকি একধরনের 'জেনেটিক অ্যাবারেশন', সন্তান উৎপাদনের উপযোগীতাহীন, তাছাড়া সমকামে নাকি বেশি করে এইডস হয়, অতএব ঘৃণার্হ। কেউ কেউ সমকামীদের সুস্থ করার জন্য হরমোনজনিত চিকিৎসার নিদান দিচ্ছেন, জোর করে তৈরি করা হচ্ছে সংখ্যাগুরুর যাপনের বিপরীতে এক সংখ্যালঘু 'অপর'-এর সংজ্ঞা।  ঠিক যেভাবে মধ্যযুগের অন্ধকার ইউরোপ 'অপর'কে নির্মাণ করেছিল, যাদের ডাইনি অপবাদে দলবদ্ধভাবে পুড়িয়ে মারা হত।

এই রায়ের সূত্র ধরে আগামী দিনে একটি দু'টি ঘটনা আমরা দেখতে পাব। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই হয়তো টিভিতে নতুন বিজ্ঞাপন দেখা যাবে, কন্ডোম, শ্যাম্পু বা শেভিং ক্রিমের বিজ্ঞাপনে চলতি হেটেরো-ইরোটিক অন্তঃস্রোতের বাইরে গিয়ে উঠে আসতে পারে কিছু সূক্ষ সমকামী ইশারা। অথবা টেলিভিশনের পর্দায় নতুন সমকামী দম্পতীকে দেখতে পাব, যারা বাড়ির জন্য ফ্রিজ বা মাইক্রোওভেন কিনতে এসেছেন। বিখ্যাত প্রেসার কুকার প্রস্তুতকারক সংস্থা এবার হয়তো লিঙ্গ-নিরপেক্ষ ট্যাগলাইন নামাবেন, 'পার্টনারকে যদি সত্যিই ভালোবাসো, তবে আজই....' ইত্যাদি ইত্যাদি। এভাবেই নতুন স্বীকৃতিপ্রাপ্ত গ্রাহক সমাজকে অনুমোদন দিতে ক্লজেট থেকে বেরিয়ে আসবে বাজার।
অর্থাৎ যেটা লক্ষণীয়, এই রায় বাজারবিরোধী নয়। বরং এই রায়কে বাজার ব্যবহার করবে, সমকামীদের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ হবে, আরও কিছু রুপো ঘরে তোলবার জন্য। বাজারের কাজই তাই। তবে সমালোচনার ঝুঁকি নিয়ে একটা প্রশ্ন তুলে ফেলা যাক, কোনওভাবে সমকামীদের অপরাধী তকমা থেকে নিষ্কৃতি সংক্রান্ত রায়টি যদি বাজারবিরোধী হত, এই রায়টি কি এত সহজে দিনের আলো দেখতে পেত? অথবা একটু অন্যভাবে বলা যায়, উদার-প্রগতিশীল-গণতান্ত্রিক, এমন সব কিছুর সঙ্গেই কি বাজার অর্থনীতির সম্পর্ক সবসময় বন্ধুত্বপূর্ণ? পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় দেশের বাজার কি সেই মসিহা যে পাশে থাকলে কোনও প্রগতিমুখী পদক্ষেপকে আটকে রাখতে পারবে না কেউ, এমনকি রাষ্ট্রও পারবে না? দাঁড়ান বন্ধু, বাজার অর্থনীতির সদর্থক ভূমিকা নিয়ে খুব বেশি গদগদ হয়ে পড়ার আগে আমরা আরও একটি সংবাদের দিকে চোখ ফেরাই।

তারিখটাও এক। ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮। ঘটনাস্থলও এক। ভারতের সর্বোচ্চ আদালত। অর্থাৎ ঠিক যেদিন সুপ্রিম কোর্ট ঐতিহাসিক রায়ে সমকামকে অপরাধের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করে দিলেন, ঠিক সেদিনই আরেকটি রায়ে ভীমা-কোরেগাঁও ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে গত মাসে গ্রেফতার হওয়া পাঁচ সমাজকর্মীর গৃহবন্দিত্বের মেয়াদ ১২ই সেপ্টেম্বর অবধি বাড়িয়ে দিলেন। অথচ একথা স্পষ্ট যে ডিসেম্বর ৩১, ২০১৭ তারিখে ভীমা-কোরেগাঁও-এ ঘটে যাওয়া দলিত বিক্ষোভের ঘটনার সঙ্গে এই মামলার কোনও যোগ নেই, পুণের সেই বিক্ষোভের পর বেশ অন্য কয়েকজনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল কয়েকমাস আগেই, এবং সেই চার্জশিটে এই পাঁচ সমাজকর্মীর নামের উল্লেখমাত্র ছিল না। বস্তুতঃ, এবারই এই পাঁঁচজনকে ধরপাকড়ের সময় এঁদের বিরুদ্ধে অন্য একটি অভিযোগ শোনা যাচ্ছিল। এই পাঁচজন অর্থাৎ আটাত্তর বছর বয়সী কবি ভারভারা রাও, সুধা ভরদ্বাজ, গৌতম নওলাখা প্রমুখেরা নাকি প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার ছক কষছেন। সেই অভিযোগ হালে পানি পাবে না বুঝতে পেরে পুলিশ শেষ পর্যন্ত আদালতে তা উল্লেখ করা থেকে পিছিয়ে আসে এবং ভীমা-কোরেগাঁও বিক্ষোভের সঙ্গে যোগাযোগটিকে অভিযোগ হিসাবে হাজির করে। অর্থাৎ, বোঝাই যাচ্ছে, এক্ষেত্রে পুলিশের (পড়ুন রাষ্ট্রের) মূল উদ্দেশ্য ছিল এই পাঁচজনকে যেনতেনপ্রকারেণ নিগ্রহ করা, ভয় দেখানো৷ এবং এর মাধ্যমে এঁরা যেসব 'রাষ্ট্রবিরোধী' কাজের সঙ্গে যুক্ত, তা থেকে দূরে সরিয়ে আনা। সেটা করার জন্য যা যা দরকার, যেমন ভীমা-কোরেগাঁও-এর বদলে গরুচুরির অভিযোগ যদি বেশি কার্যকরী হত, সেটাই দায়ের করা হত। রাষ্ট্রবিরোধিতার মুখ ছলে-বলে-কৌশলে বন্ধ করাই তো রাষ্ট্রের কাজ। সুধা ভরদ্বাজ রাষ্ট্রবিরোধী কারণ তিনি একজন আইনজীবী হিসেবে বিনা পারিশ্রমিকে আদিবাসীদের অধিকারের পক্ষে লড়াই করছেন। গৌতম নওলাখা রাষ্ট্রবিরোধী কারণ তিনি রাফালে ডিল নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি বারবার নগ্ন করে দেন নিজের লেখায়। কবি ভারভারা রাও, ভারনন গঞ্জালভেস রাষ্ট্রবিরোধী কারণ তাঁরা রাস্তায় নেমে উন্নয়ন নামক এই কর্পোরেট লুটের বিরুদ্ধে সচেতন করে দেন দেশের কৃষক, শ্রমিক, অরণ্যচারী আদিবাসীদের। আর কে না জানে, পুঁজিবাদী দেশে আদিবাসীসহ দেশের প্রান্তিক মানুষজনের অধিকার সুরক্ষিত করার জন্য লড়াই করার অর্থ সরাসরি রাষ্ট্র ও কর্পোরেট আঁতাতের বিরুদ্ধে যাওয়া, যে আঁতাত দেশের পাহাড় নদী অরণ্যের সম্পদ ছলেবলেকৌশলে কেড়ে নিতে চায়, দেশের প্রাচীন কৃষিব্যবস্থাকে তামাদি করে দিয়ে বিদেশি বীজ, সার, ও দামি কীটনাশকের আগ্রাসন নামিয়ে আনে। নিয়মগিরি থেকে খাম্মাম, সরদার সরোবর বাঁধ থেকে তুতিকোরিণ, সর্বত্রই উন্নয়নের নামে পরিবেশ ও ভূমিপুত্রদের উৎখাত করার এক দানবিক রোডরোলার চলে আমাদের দেশে, রবীন্দ্রনাথের 'রক্তকরবী' বহুবছর আগেই যার কদর্য মুখ আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে। এই পাঁচ সমাজকর্মী প্রান্তিক মানুষের সরব সহযোদ্ধা অর্থাৎ গণিতের সামান্য নিয়মে রাষ্ট্রের শত্রু, মুনাফার শত্রু, বাজার অর্থনীতির শত্রু।  স্বাভাবিকভাবেই, এঁদের শাস্তি রাষ্ট্রনির্ধারিত, সম্ভব হলে সাতদিনের ফাঁসি। সেকারণে ভীমা-কোরেগাঁও বা ওই জাতীয় কোনও ঘটনাকে শিখণ্ডী খাড়া করার দরকার ছিল, কিন্তু তাড়াহুড়োয় মিথ্যা অভিযোগের কাঠামোটিও অতিশয় দুর্বল। তা সত্ত্বেও, সুপ্রিম কোর্ট এই পাঁচ সমাজকর্মীর গৃহবন্দিদশার মেয়াদ বাড়িয়ে অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক একটি রায় দিল। অথচ আমরা ভেবেছিলাম, এরকম একটি নড়বড়ে অভিযোগে ভরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলায় ওই পাঁচ সমাজকর্মীর নিঃশর্ত মুক্তি শুধুমাত্র কেসটি সর্বোচ্চ আদালতে ওঠার অপেক্ষা। আমাদের বিস্মিত করে তা হল না। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার, সুপ্রিম কোর্টের যে বেঞ্চ এই রায় দিয়েছে, সেই বেঞ্চেরও সদস্য ছিলেন জাস্টিস ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় যিনি একই দিনে একটু আগেই সমকাম নিয়ে অমন প্রগতিশীল ও ঐতিহাসিক বিবৃতি দিলেন।

অর্থাৎ দুইয়ে দুইয়ে যে সর্বদা চারই হবে, এমন নয়। একই দিনে সুপ্রিম কোর্ট থেকে বেরোন দু'টি রায়ের একটি উদার, প্রগতিশীল, বাজারবান্ধব। অপর রায়টি আশ্চর্যজনকভাবে অগণতান্ত্রিক হলেও বৃহত্তর অর্থে বাজারবান্ধব কারণ তা পরোক্ষে রাষ্ট্র ও কর্পোরেটের স্বার্থকে রক্ষা করে। না, আমরা অবশ্যই এই দুটি রায়ের ভিত্তিতে এমন কোনও সরলীকরণে যাব না, যার দ্বারা মনে হতে পারে আমাদের বিচারব্যবস্থায় বিচারকরা সকালে পুঁজিবাদের হ্যান্ডবুক মুখস্থ করে নিয়ে তারপর আদালতে রায় দিতে যান। তবে এই সন্দেহটা মনে গেঁড়ে বসা স্বাভাবিক যে, বাজার অর্থনীতি যা চায় না, সেরকম কোনও নিদান ভারতবর্ষের আদালত থেকেও সহজে বেরিয়ে আসবে না। তাই দেশের বিচারব্যবস্থাকে সাধারণ মানুষ সংবিধানের রক্ষাকবচ জ্ঞান করলেও, তা খানিক সত্য হলেও, কোথাও না কোথাও সেও একই সিস্টেমের অঙ্গ। এ এমন এক সিস্টেম, যে রাষ্ট্রের পাশে অশরীরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে, পুলিশের সঙ্গে মিশে গিয়ে গুলি চালাচ্ছে নন্দীগ্রামে-কলিঙ্গনগরে, আবার সকলের অলক্ষ্যে নজর রাখছে আমার-আপনার ফেসবুকের পাতায়, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে, নীরবে বুঝে নিতে চাইছে আমাদের সমস্ত রাজনৈতিক মতামত, এমনকি ইন্টারনেটে আমার টাকা খরচ করার প্যাটার্ণটাও। আজ পণ্যরতির যুগে সান্দ্র, ঈষৎ চটচটে, সর্বব্যাপী, সর্বশক্তিমান এই বাজারকে ঈশ্বরের আসন দিতে বাধা কোথায়!

দণ্ডবিধি ৩৭৭-তে ফেরা যাক। সুপ্রিম কোর্টের এই রায় একটি চূড়ান্ত অসম ও রিগ্রেসিভ সমাজের উপরিতলকে ছুঁয়েছে মাত্র, পুকুরের জলের ওপর খোলা বাতাস বয়ে যাওয়ার পর মৃদু কাঁপনের মতো। কারণ এখনও বাজারের সবল উপস্থিতি শুধুমাত্র উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত নাগরিক বৃত্তেই। নাগরিক সমাজ ছেড়ে যত আমরা ভারতবর্ষের আত্মার দিকে যাব, শহর ছেড়ে মফস্বল বা গ্রামের ঢুকতে চাইব, বাজার অর্থনীতির স্টেক ক্রমশ কমতে থাকবে। যে ব্যক্তিমানুষ 'কনজিউমার' হিসেবে যত নন-পারফর্মিং, বাজারের কাছে তার সুখদুঃখের মূল্য তত কম। তাই চূড়ান্ত বৈষমমূলক দরিদ্র শিক্ষাহীন ভারতীয় সমাজে অসাম্য থাকল কি ঘুচল, মানুষ মরল কি বাঁচল, তা নিয়ে বাজারের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই, যতক্ষণ না সেই সমাজ থেকে নতুন গ্রাহক উঠে আসছে।  ঠিক যেমন নিয়মগিরি পাহাড়ের পরিবেশ ও ডোঙারিয়া কোণ্ডদের জীবন নিয়ে বাজারের কোনও হেলদোল ছিল না, তার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল কীভাবে ও কত কম সময়ে নিয়মগিরির নিচের খনিজ বক্সাইট নিজ অধিকারে আনা যায়।
তাই এইসব প্রান্তিক মানুষদের জীবন ও পরিবেশ নিয়ে যারা মাথা ঘামাচ্ছেন, তাদের অধিকার রক্ষায় লড়ছেন, সেই ভারভারা রাও, সুধা ভরদ্বাজ, গৌতম নওলাখার মতো মানুষেরাই এই দেশের প্রকৃত বিবেক। রাষ্ট্র ও বাজার অর্থনীতি প্রথমে এঁদের ব্যবহার করার চেষ্টা করে, তা করতে না পারলে ভয় দেখায়, হুমকি দেয়, চিরতরে মুখ বন্ধ করে দেবার পরিকল্পনা করে। এঁদের চোখের মণির মতো রক্ষা করতে হবে আমাদের। লিঙ্গসাম্যের জন্য লড়াই অবশ্যই একটা জরুরি সংগ্রাম, কিন্তু সেই লড়াইয়ে পাওয়া এই একটি ছোট্ট জয় যেন সমাজের গভীরতর স্তরে বিকট অসাম্য থেকে আমাদের চোখ সরিয়ে দিতে না পারে৷ বাজার আসলে একটি সবুজ শীতল সাপ, তার চোখের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকা, তার প্রতিটি পদক্ষেপ সম্বন্ধে সচেতন থাকাও এই মুহূর্তে আমাদের একটা বড় কাজ।

(প্রসঙ্গত, এই লেখাটি ছাপা হওয়ার আগে পর্যন্ত খবর যে আইনজীবীরা অন্যত্র ব্যস্ত থাকা ইত্যাদি টেকনিকাল কারণে আদালত সেপ্টেম্বর ১৭ অবধি গৃহবন্দিদশার মেয়াদ বাড়িয়েছেন৷ সেইসঙ্গে একটি সুসংবাদও, ঐতিহাসিক রোমিলা থাপারসহ দেশের কিছু বিশিষ্ট চিন্তক অবিলম্বে এই পাঁচ নাগরিকসহ একই ধরনের মামলায় ধৃত সকল অভিযুক্তদের নিঃশর্ত মুক্তি চেয়ে পিটিশন জমা দিয়েছেন, আদালত তা গ্রহণ করেছেন ও খতিয়ে দেখছেন।)

একনজরে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"ইস্কুল বলিতে আমরা যাহা বুঝি সে একটা শিক্ষা দিবার কল। মাস্টার এই কারখানার একটা অংশ। সাড়ে দশটার সময় ঘণ্টা বাজাইয়া কারখানা খোলে। ...